ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সারাদেশেই ছড়িয়েছে

করোনার নকল সুরক্ষা সামগ্রীতে বাজার সয়লাব

প্রকাশিত: ২৩:১১, ২৫ জুন ২০২০

করোনার নকল সুরক্ষা সামগ্রীতে বাজার সয়লাব

শংকর কুমার দে ॥ পেশা পরিবর্তনের কৌশল রপ্ত করে ফেলেছে নকল ও ভেজালসামগ্রী প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতারা। করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপকরণ নকল ও ভেজাল সুরক্ষাসামগ্রীতে বাজার সয়লাব। সারাদেশেই বিক্রি হচ্ছে পিপিই, মাস্ক, অক্সি মিটার, পোর্টেবল ভেন্টিলেটর, স্যানিটাইজার, হ্যান্ড গ্লাভস বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে নকল ও মানহীন পণ্য। করোনায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় নকল ও ভেজাল সুরক্ষাসামগ্রীর দামও বেশ চড়া। কোনটা নকল আর কোনটা আসল তা যাচাই করতে পারছেন না করোনা থেকে রক্ষা পেতে উদগ্রীব ক্রেতারা। নকলটাই আসল ভেবে ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই। নকল ও ভেজাল সুরক্ষাসামগ্রীর বিরুদ্ধে পরিচালিত হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান। কিন্তু জীবনের নিরাপত্তার জন্য হুমকির নকল ও ভেজাল সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয় ঠেকানো যাচ্ছে না। নকল ও ভেজাল স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিরোধী অভিযান পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সোমবার, ২২ জুন দুপুরে বরিশালে নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রির দায়ে সজল জমাদ্দার ওরফে রাজিব (৩৪) ও ঢাকার মোস্তফা কামাল নামের দুই খুচরা ব্যবসায়ীকে এক বছর করে কারাদ-াদেশ দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। রাজধানী ঢাকার মিডফোর্ড এলাকার জনৈক মোঃ রাকিবের সহায়তায় লঞ্চে এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এসব নকল সুরক্ষাসামগ্রী চলে যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা, শহর থেকে গ্রামে-গঞ্জের বাজারে। সাজাপ্রাপ্ত দুই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া বিপুল পরিমাণ নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সুরক্ষাসামগ্রী জব্দ করে ধ্বংস করা হয়। সাজা পাওয়া দুই ব্যবসায়ীই ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে স্বীকার করেছেন, রাজধানী ঢাকা থেকে নকল ও ভেজাল সুরক্ষাসামগ্রী এনে বিক্রয় করছিল তারা। রাজধানী ঢাকা থেকে বরিশালে নকল ও ভেজাল স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রীর বাজারজাত ও বিক্রি করার অভিযোগে সাজা দেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ জিয়াউর রহমান। নকল ও ভেজাল স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রির অভিযোগে সাজা দেয়ার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে দুই ব্যবসায়ীকে। র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, গত ১০ জুন নকল ও অনুমোদনহীন স্যানিটাইজার বিক্রির অভিযোগে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ৪টি দোকানকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে প্রায় ৫ লাখ টাকা মূল্যমানের নকল ও অনুমোদনহীন স্যানিটাইজার জব্দ করা হয়েছে। করোনার সুরক্ষা সামগ্রী এবং ওষুধ নিয়ে নানামুখী অনৈতিক বাণিজ্য হচ্ছে। কেউ কেউ ভেজাল ও মানহীন পণ্য তৈরি করছে। আবার কেউ দেশের বাইরে থেকে এনে কয়েকগুণ দাম রাখছে। রাজধানীর পান্থপথে বিপুল পরিমাণ নকল গ্লাভস ও গাউন জব্দ করেছে র‌্যাব। এ সময় ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও গোডাউন সিলগালা করা হয়। এএসএম ট্রেডিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নকল ও মানহীন পণ্যের গোডাউনের তথ্য পায় র‌্যাব। অভিযানের সময় বিপুল পরিমাণ পুনঃব্যবহৃত গ্লাভস, মাস্ক এবং বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গ্লাভসের খালি প্যাকেট জব্দ করা হয়। এসব পণ্য বিক্রির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানের মালিক এ এস এম মুসাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে তিন মাসের কারাদ- দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেয়া হয়। এর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বাংলামটরে জহুরা টাওয়ার থেকে উদ্ধার করা হয় করোনা পরীক্ষার অনুমোদনহীন কিটের মজুদ। এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় চারজনকে। তারা হলেন আনোয়ার হোসেন, অমিত বসাক, শোয়াইব ও শুভ। এ্যাডভান্স বায়ো কেমিক্যাল (এবিসি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তা এনে তাদের কার্যালয়ে মজুদ করেছিল। যার বৈধ কোন কাগজ তারা দেখাতে পারেননি। এ ছাড়াও এন-৯৫ বলে নকল মাস্ক কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করছিল প্রতিষ্ঠানটি। তাদের গুদামে থাকা অননুমোদিত ২৭৫ পিস করোনা টেস্টিং কিট, ৯ হাজার ৫০ পিস সাধারণ মাস্ক, ১০০ পিস নকল এন-৯৫ মাস্ক, ১৯৮ পিস পিপিই, ৯৬০ জোড়া হ্যান্ড গ্লাভস, ২৫০ জোড়া গগলস, ৯০০টি ক্যাপ, এক হাজার ৪৪০টি শু কভার জব্দ করা হয়। অভিযান পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, চীন থেকে আনা করোনা পরীক্ষার যে কিট ওই প্রতিষ্ঠানে পাওয়া গেছে তা মানসম্মত কিনা এমন কোন সনদ তাদের কাছে ছিল না। এ ধরনের কিট শুধু সরকারী হাসপাতালেই থাকার কথা। এ ছাড়া সেখানে এন-৯৫ ছাপ দেয়া অনেক মাস্কের খালি প্যাকেট পাওয়া গেছে। নকল মাস্কগুলো এসব ব্যাগে ভরে বিক্রি করছিল তারা। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ করোনা সুরক্ষাসামগ্রী মজুদ করেছিল বেশি দামে বিক্রির জন্য। চীন থেকে নিম্নমানের মাস্ক এনে এন-৯৫ বলে বিক্রি করে আসছিল। এ ছাড়া চীন থেকে করোনার আরও অনেক সুরক্ষাসামগ্রীও তারা এনেছিল। ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এসব সরঞ্জাম আনা হয়েছে। প্রত্যেকটি পণ্য ১০-১৫ গুণ দামে তারা বিক্রি করত। পণ্য আমদানির কোন বৈধ কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি। এমনকি বিক্রির রসিদও তাদের নেই। এই চক্রের সদস্যরা ২০টি মাস্কের মূল্য হিসেবে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা রেখেছিল। অতি মুনাফার জন্যই তারা নকল পণ্য এনে বাজারজাত করছে। এর আগে মিটফোর্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার নকল ওষুধ ও নিম্নমানের মাস্ক জব্দ করেন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের লাগাম টানতে বেশ কিছু অভিযান চালানো হয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, করোনাভাইরাসের ভয়াবহতার বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী চাহিদার কারণে এন-৯৫ মাস্ক, টেস্ট কিট, গ্লাভসসহ করোনার নানা সুরক্ষাসামগ্রী তৈরি করতে শুরু করেছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশে নকল ও ভেজাল এন-৯৫ মাস্ক, টেস্ট কিট, গ্লাভসসহ করোনার নানা সুরক্ষা সামগ্রী তৈরি করতে শুরু করেছে একাধিক সংঘবদ্ধ চক্র। রাজধানী ঢাকার বিশেষ করে পুরান ঢাকার অলিগলিতে তৈরি হচ্ছে নকল এসব পণ্য। আবার কেউ কেউ বিদেশ থেকে মানহীন পণ্য এনে অভিজাত ব্র্যান্ডের মোড়কে বাজারজাত করছে। নকল পণ্যই বিক্রি হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি দামে। পুলিশের উদ্ধারকৃত নকল ও ভেজাল স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী পরীক্ষায় দেখা গেছে, আসল হ্যাক্সিসল, হ্যান্ড রাবের বোতল সংগ্রহ করে রং মেশানো পানি ভরেও বাজারে চড়া দামে বিক্রি করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ ধরনের বেশিরভাগ পণ্যের উৎপাদন ও মেয়াদের কোন তারিখ নেই। পণ্যগুলো কোন প্রতিষ্ঠান আমদানি করছে, তা-ও কোথাও উল্লেখ নেই।
×