ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভবন সংস্কার সম্পন্ন, নতুন স্থাপনা হচ্ছে বেঙ্গল স্টুডিওতে

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২৫ জুন ২০২০

ভবন সংস্কার সম্পন্ন, নতুন স্থাপনা হচ্ছে বেঙ্গল স্টুডিওতে

মোরসালিন মিজান ॥ শহর ঢাকায় নতুন-পুরনো অসংখ্য বাড়ি। কিছু বাড়ি বহুকাল আগের রুচি ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কিছু বাড়ি নজর কাড়ে আধুনিক নির্মাণশৈলীর জন্য। তবে, রোজ গার্ডেনে দুটো বৈশিষ্ট্যই বর্তমান। ভবনটি একইসঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। মূলত এ কারণেই আলাদা তাৎপর্যের। বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে এর নাম জড়িয়ে আছে। বর্তমানে ভবনটিতে জাদুঘর নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। করোনার বাধা কাটিয়ে ওঠা গেলে আগস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ নিদর্শন স্থানান্তর শুরু হবে। রোজ গার্ডেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সর্বোপরি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিধন্য। নেতারা এখানে বসে গুরুত্বপূর্ণ অনেক মিটিং করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বাড়িটিতে বসে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। নান্দনিক সৌন্দর্যে অতুলনীয় রোজ গার্ডেন টিকাটুলির কেএম দাস লেনে অবস্থিত। যতদূর তথ্যÑ এটি নির্মিত হয়েছিল সেই ১৯৩০ সালে। উন্নত রুচি ও অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভবনটি নির্মাণ করেন জমিদার হৃষিকেশ দাস। সাত একর জমির ওপর বিশাল দৃষ্টিনন্দন ভবন। বাড়ির মতোই সুন্দর চারপাশ। উদ্যানে চমৎকার ফুলের বাগান করা হয়েছিল। বিশেষভাবে দৃশ্যমান হতো গোলাপ। হরেক রকমের গোলাপ ফুটে থাকত বাগানে। বাগানের জন্য চীন, ভারত, জাপান ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে মাটিসহ গোলাপের চারা এনে লাগানো হয়েছিল। জানা যায়, এ কারণেই বাড়িটির নাম রোজ গার্ডেন। অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপনা উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সাত হাজার বর্গফুট আয়তনের প্রাচীর। ১৯৮৯ সাল থেকে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতর স্থাপনাটি সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, বাড়িটি হৃষিকেশের সময়ই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল। ভারত বিভাগের পর অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সভা এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বড় বড় নেতার এখানে আসা-যাওয়া ছিল। বরেণ্য ইতিহাসবিদ মুন্তাসীর মামুন জানান, ১৯৪৯ সালে রোজ গার্ডেনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। নব গঠিত দলের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।’ এর পর থেকেই দলটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পরিচিতি লাভ করে। ক্ষণজন্মা পুরুষ অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নতুন প্রাণ পায় দীর্ঘদিনের পুরনো এই দল। বাড়িটির এক সময়ের মালিক আব্দুর রশিদের মেজ ছেলের স্ত্রী লায়লা রকীবের বর্ণনা থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি কাজী মোহাম্মদ বশিরের সঙ্গে দেখা করতে রোজ গার্ডেনে গিয়েছিলেন। সাদা গাড়িতে করে আসা নেতাকে সেদিন বাড়ির দোতলার বারান্দা থেকে অবাক বিস্ময়ে দেখেছেন বলে জানান তিনি। ভবনটির উপরিভাগ গম্বুজ আকৃতির। উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট। ভিত্তির ওপর ছয়টি বিভিন্ন উচ্চতার থাম। প্রতিটি থামের উপরিভাগে দৃষ্টিনন্দন নক্সা করা। পাঁচটি অংশে বিভক্ত বাড়ির সব বাড়ান্দা থেকে বাগানের সৌন্দর্য দেখা যায়। পশ্চিমদিকে মুখ করা বাড়ির সামনের অংশ সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সুন্দর। দূর থেকে দেখেই মন ভরে যায়। ভবনের প্রবেশদ্বারগুলোয় কাঠ ছাড়াও ব্যবহার করা হয়েছে লোহা ও রঙিন বেলজীয় কাঁচ। ফুল, লতাপাতার নক্সা করা হয়েছে। আছে বিভিন্ন প্রাণীর চেহারা। তিন তলা বাড়িতে মোট ১৩ টি ছোট-বড় কক্ষ। দ্বিতীয় তলায় বিশাল বলরুম। শ্বেতপাথরে গড়া মেঝে। সিলিংয়ে সবুজ কাঁচ। সেখানে ফুলের নক্সা। ভবনের অভ্যন্তরে দারুণ সব ঝাড়বাতি। ছাদে যাওয়ার জন্য রয়েছে প্যাঁচানো সিঁড়ি। এটিও নক্সা করা। বাগানে সুনিপুণ হাতে গড়া ভাস্কর্য। আছে ঝর্ণা ও পুকুর। সব মিলিয়ে অপূর্ব। ইতিহাসবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৩ সালে বাড়িটি কিনে নেন ব্যবসায়ী খান বাহাদুর কাজী আবদুর রশীদ। ১৯৩৭ সাল থেকে বাড়িতে সপরিবারে বাস শুরু করেন তিনি। তখন রোজ গার্ডেনের নতুন নাম হয় রশীদ মঞ্জিল। ১৯৬৬ সালে রশীদের দ্বিতীয় পুত্র কাজী আব্দুর রকিব বেঙ্গল স্টুডিও এ্যান্ড মোশন পিকচার্সের কাছে এই সম্পত্তি লিজ দিয়ে দেন। রাজা, বাদশা, জমিদারদের কাহিনীনির্ভর অনেক চলচ্চিত্রের শূটিং হয় এখানে। সে সময় বেঙ্গল স্টুডিও নামে পরিচিতি পায় ঐতিহাসিক ভবনটি। এভাবে বহুবিধ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তবে বাঙালীর আন্দোলন/সংগ্রাম এবং আওয়ামী লীগের জন্মের সঙ্গে যুক্ত থাকায় বাড়িটি ইতিহাসের অমূল্য স্মারক হয়ে উঠেছে। ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তুলে ধরার ক্ষেত্রেও রাখতে পারে বড় ভূমিকা। এসব বিবেচনায় এখানে জাদুঘর নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। সে লক্ষ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন এ প্রতœসম্পদ নগদ অর্থে ক্রয় করে নেয় সরকার। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অনুসারে ৩৩১ কোটি ৭০ লাখ ২ হাজার ৯০০ টাকায় এটি কিনে নেয়া হয়। সর্বশেষ তথ্য মতে, বাড়ি সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে। জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কাজও শুরু হয়েছিল। তবে গতি ছিল মন্থর। লম্বা সময় নিয়েও কাজ গুছিয়ে আনতে পারেনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার সমালোচনাও হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। এর পর পরই শুরু হয়ে যায় করোনার কাল। তাহলে কি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাজ আবারও অনিশচয়তার মুখে পড়ল? এমন প্রশ্নের উত্তরে আশার কথা শোনালেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। বুধবার জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা ভবনের সংস্কার কাজ বেশ ভালভাবেই শেষ করেছি। এর পর জাদুঘর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্যান্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছিল। কিন্তু বর্তমানে করোনার কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে বিশেষ বাধার মুখে না পড়লে আগামী জুলাই থেকে নিদর্শন স্থানান্তর শুরু হবে বলে জানান তিনি। রোজ গার্ডেন ঘিরে পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, মূল ভবনটি যা আছে তাই থাকবে। এর কোথাও তেমন হাত দেয়া হবে না। বেঙ্গল স্টুডিওতে নতুন একটি স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। নগর ভবনে ঢাকা জাদুঘর নামে যে জাদুঘরটি রয়েছে সেটি এখানে স্থানান্তর করা হবে। সব নিদর্শন চলে আসবে এখানে। জাদুঘরটি আলোকচিত্রসহ অমূল্য নিদর্শন দিয়ে সাজানো হবে। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ও সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরা হবে এখানে। পাশাপাশি শহর ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা নানা মাধ্যমে বর্ণনা করা হবে। পরিকল্পনা মতো এগোনো গেলে এটি সমৃদ্ধ একটি জাদুঘর হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
×