ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেমিটেন্স এবং বিদেশী ঋণ ও অনুদানের যোগফল

রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলার ॥ করোনার মধ্যেও রেকর্ড

প্রকাশিত: ২২:৫২, ২৪ জুন ২০২০

রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলার ॥ করোনার মধ্যেও রেকর্ড

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফের রেকর্ড ভেঙ্গে ৩৫ বিলিয়ন (৩ হাজার ৫০৯ কোটি) মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। দেশের ইতিহাসে এটি সর্বোচ্চ রিজার্ভ। এ নিয়ে এক মাসের মধ্যেই দুই রেকর্ড হলো রিজার্ভে। এর আগে গত ৩ জুন প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে সাড়ে আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। প্রতিমাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয়ের খরচ হিসাবে হাতে থাকা রিজার্ভ দিয়ে বর্তমানে সাড়ে আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। যা পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। জানা গেছে, করোনার ধাক্কায় দেশের অর্থনীতিতে প্রতিমুহূর্তে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন খারাপ খবর। গত চার মাসে রফতানি নেমে গেছে তলানিতে। দেশের আমদানিও কমেছে তরতর করে। খারাপ খবরের ছড়াছড়ির মধ্যেও সুসংবাদ দিচ্ছেন প্রবাসীরা। করোনা সঙ্কটের মধ্যেও বৈধ পথে প্রচুর রেমিটেন্স দেশে আসছে। চলতি মাসের ১৮ জুন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশীরা ১২০ কোটি ৮০ লাখ ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। আগের বছরের পুরো জুন মাসে রেমিটেন্স এসেছিল ১৩৬ কোটি ৮২ লাখ ডলার। সুতরাং আগের বছরের একই মাসের তুলনায় চলতি জুনে রেমিটেন্স বাড়বে। এভাবে রেমিটেন্স বাড়লেও আমদানি দায় পরিশোধের তেমন চাপ নেই। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রচুর ডলার কিনতে হচ্ছে। মঙ্গলবারও কয়েকটি ব্যাংক থেকে ১০ কোটি ডলার কেনা হয়। এছাড়া বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি থেকে প্রচুর ঋণ আসছে। যে কারণে রিজার্ভে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। বুধবার বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রিজার্ভের পরিমাণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ দশমিক শূন্য ৯ বিলিয়ন ডলার বা তিন হাজার ৫০৯ কোটি ডলার। এর আগে গত ৩ জুন প্রথমবারের মতো দেশের রিজার্ভ ৩৪ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে। জুন মাস শেষ হওয়ার আগেই রিজার্ভ বাড়ল আরও এক বিলিয়ন ডলার। তারও আগে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ রেকর্ড ৩৩ বিলিয়ন ডলার উচ্চতায় ওঠে ২০১৭ সালের ২১ জুন। সেইদিন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ৩০১ কোটি ডলার। এরপর কিছুটা কমলেও ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর, ২ নবেম্বর ও ২৮ ডিসেম্বর আবার ৩৩ বিলিয়ন ডলারে ফেরে। এদিকে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু বিদেশী ঋণ ও দান অনুদানও। আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ায় রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রবাসীরা দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। একইসঙ্গে বিদেশী ঋণ ও অনুদান আসছে। আমদানি ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় দেশের রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে। তবে রফতানি আয় বাড়ানো সম্ভব না হলে রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা কঠিন হবে। জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডি’র অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, করোনা মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সহায়তার কারণেই এই দুর্যোগকালেও রিজার্ভে রেকর্ড হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। না হলে ব্যাংকগুলো সঙ্কট কাটিয়ে সঠিকপথে ফিরতে পারবে না। জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। যা পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশকে দুই মাস পরপর পরিশোধ করতে হয় আকুর বিল। প্রতি মাসে ৪ বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয়ের খরচ হিসাবে হাতে থাকা রিজার্ভ দিয়ে বর্তমানে সাড়ে আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মে মাস পর্যন্ত প্রবাসীরা মোট ১ হাজার ৬৩৬ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। আগের বছরের একই সময় পর্যন্ত এসেছিল এক হাজার ৫০৫ কোটি ডলার। এ হিসাবে মে পর্যন্ত রেমিটেন্স বেশি আছে ১৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার বা ৮ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত মার্চ থেকে মে পর্যন্ত টানা তিন মাস রেমিটেন্স কমার পরও এ হারে প্রবৃদ্ধি আছে। করোনাভাইরাসের প্রভাব শুরুর আগে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অবশ্যই রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি ছিল ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি থাকলেও রফতানির পাশাপাশি আমদানি দায় পরিশোধও একেবারে কমেছে। যে কারণে রিজার্ভ বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত রফতানি আয় দেশে এসেছে তিন হাজার ৯৬ কোটি ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ১৮ শতাংশ কম। এর মধ্যে মে মাসে রফতানি কমেছে ৬১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর গত এপ্রিলে কমেছিল ৮৩ শতাংশ। গত এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৪ হাজার ৬৪৪ কোটি ডলারের পণ্য। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষদিকে বাংলাদেশের বিদেশী মুদ্রার সঞ্চয়ন এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নেমে আসে। এরপর বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখন রিজার্ভে ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের সামান্য বেশি। সে সময় আকুর বিল বাবদ ২০ কোটি ডলার পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু তাতে রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসত। আর রিজার্ভ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ হবে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ দাতাদের সহায়তা পাওয়া যাবে না- এই বিবেচনায় আকুর দেনা পুরোটা শোধ না করে অর্ধেক দেয়া হয় তখন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ওই একবারই আকুর বিল বকেয়া রাখা হয়েছিল বলে জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। জানা গেছে, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ- এই ৯টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুই মাস পরপর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করে থাকে।
×