ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

কেমন হবে ঈদ-উল-আজহা

প্রকাশিত: ২৩:৩৮, ২৪ জুন ২০২০

কেমন হবে ঈদ-উল-আজহা

এবার পালিত রমজানের পর ঈদ-উল-ফিতরও তার আনন্দের বার্তা নিয়ে হাজির হলেও করোনার কারণে তা উৎসব হিসেবে পালন করতে পারেননি ধর্মপ্রাণ মুসলমান। করোনাভাইরাসের সর্বব্যাপী সংক্রমণের আশঙ্কায় হাত মেলানো কিংবা কোলাকুলির ওপরও আসে নিষেধাজ্ঞা। এ শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়। সারা বিশ্বকেও অবরুদ্ধতার কঠিন নিগড়ে আটকে দেয়া হয়। তখন থেকেই আশঙ্কা করা হয় সামনে রয়েছে আরেক মহান গণজমায়েত। পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। মুসলিম বিশ্বের হজ পালনের এক মহান ব্রত। সারা বছর মুসলমানরা এই হজব্রত পালনের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। সমস্ত ধর্মীয় বিধি পালনের মধ্য দিয়ে এর শুভযাত্রা শুরু হয়। সেও মুসলমানদের একত্রিত হওয়ার এক মহাসমাবেশ। সামনে সেই হজ পালনের পবিত্র সময়টিতে কিভাবে তা মেনে চলা হবে তাও এক অজানা আশঙ্কার বিষয়। কারণ করোনাভাইরাস তার স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যে প্রতিনিয়তই সংক্রমণ ছড়িয়ে যাচ্ছে। হজ পালনের পবিত্র স্থান সৌদি আরবও এর বহুল সংক্রমণ থেকে মুক্ত নয়। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। আর এই সংক্রমিত রোগটি মানুষের মিলনযোগে যে অনাকাক্সিক্ষত প্রাচীর তুলেছে সেটা ভেঙ্গে ফেলাও এক কঠিন ব্যাপার। তার পরেও সৌদি কর্তৃপক্ষ ভাবছে সারা বিশ্ব থেকে ২০ শতাংশ মুসলমান এই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলেই হজ পালনে যোগ দিতে পারবে। ধর্মীয় জমায়েত এবং উপসনালয়েও এসেছে এক অনাবশ্যক দুর্যোগ যা আগে পৃথিবী এ যাবত কখনই প্রত্যক্ষ করেনি। শুধু কি তাই? অসুস্থ, আক্রান্ত মানুষদের আলাদা করে দেয়াই শুধু নয় সমস্ত সুস্থ মানুষও আজ গৃহবন্দী অবস্থায় অসহনীয় জীবন কাটাচ্ছে। কার্যত কর্মক্ষম, সুস্থ মানুষগুলো কার্যক্ষমতা হারাতে বসেছে। আর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতেও সময় লাগছে না। এমন আপৎকালীন দুর্যোগ যা সারা পৃথিবীকে এক অবরুদ্ধতার কঠিন জালে ফেলে দিয়েছে সেখান থেকে কবে মুক্তি মিলবে কিংবা আদৌ কোন সুরক্ষা কবচ তৈরি হবে কিনা তাও এক অজানা বিষয়। হজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো কোরবানির ঈদ। আর কোরবানি মানেই সারা বছরের গরু-ছাগল ব্যবসায়ীরা এই দিনের অপেক্ষায় বসে থাকেন। জমজমাট হয়ে ওঠে পশুরহাট। তেমন দৃশ্য এবার কতখানি দেখা যাবে তা বলা মুশকিল। বাংলাদেশ এখন সংক্রমণের মধ্য গগনে। সেখান থেকে নামার কোন পূর্বাভাস এখন অবধি নেই। সামনে আরও ভয়ঙ্কর দুর্যোগ অপেক্ষা করছে কিনা সময়ই তার যথাযথ জবাব দেবে। দেশের পশু ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা আর আতঙ্ক নিয়ে তাদের বেচা-বিক্রির বিষয়ে ভাবলেও ক‚ল-কিনারার আভাস পাওয়াও কঠিন। কারণ দেশের সার্বিক ব্যবসা বাণিজ্যও স্থবিরতার আবর্তে। রোজার ঈদে সীমিত আকারে দোকানপাট খোলার নির্দেশনা আসলেও ঈদের বাজার সেভাবে জমে ওঠেনি। করোনা দুর্যোগকালে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যে সমূহ ক্ষতির আবর্তে হিমশিম খাচ্ছে সেখান থেকে নতুন ভাবে ঘুরে দাঁড়ানো সেও এক কঠিন যুদ্ধ। রফতানি বাণিজ্যও পড়েছে মহাদুর্বিপাকে। আন্তর্জাতিক বলয়ে ব্যবসায়িক কার্যকলাপের যে সঙ্কট ক্রমান্বয়ে মাথাচাড়া দিচ্ছে তার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও আসছে। বিদেশে প্রবাসী বাঙালীদের চাকরি হারানোর দুর্ভোগও পোহাতে হবে বাংলাদেশকেই। বিদেশ থেকে ফিরে আসা বাঙালীরা আর তাদের মূল কাজে ফিরতে না পারার আশঙ্কাই ঘনীভ‚ত হচ্ছে। করোনাভাইরাস শুধু যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ওপর তার কালো থাবা বসিয়েছে তা কিন্তু নয় মানুষের প্রতিদিনের জীবনেও নিয়ে এসেছে মহাবিপর্যয়। খেটে খাওয়া অতি সাধারণ মানুষ তার রুজি রোজগারের পথে বার বার হোঁচট খাচ্ছে। আগের মতো তার প্রতিদিনের পেশাগত জীবন মুক্ত কিংবা অবারিত নয়। করোনা সংক্রমণের ভয় তো আছেই তার ওপর মানুষের সঙ্গে ফারাক রাখতে গিয়ে কর্মজীবনও এক প্রকার গতিহীনতার পর্যায়ে। আর পোশাক শিল্প শ্রমিকদের দুর্ভোগের কথা বলেও শেষ করা যাবে না। ঈদ-উল-আজহা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের একটি আনুষঙ্গিক ধর্মীয় উৎসব। ইসলামের ইতিহাসে বর্ণিত আছে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর সময় থেকেই এই কোরবানি দেয়ার ধর্মীয় বিধি চালু হয়। কথিত আছে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার প্রিয় জিনিস কোরবানি দিতে গিয়ে পুত্র ইসমাইলকেই বিবেচনায় আনেন। কিন্তু রহমতের নিয়ামক আল্লাহ মানুষের জীবন উৎসর্গকে কোনভাবেই মানেননি। পরবর্তীতে হুকুম হয় যে কোন পশু কোরবানি দিলেই রহমাতুল আমিন আল্লাহ সন্তুষ্ট হবেন। সেই থেকে মুসলমানরা কোরবানির রেওয়াজ শুরু করলে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক যুগেও তা স্বমহিমায় এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় পার করে যাচ্ছে। দেশ, জাতি ও ব্যক্তিত্ব ভেদে এই ধর্মীয় পর্বটিও আপন বৈশিষ্ট্যে নিজের ধর্মবিধিকে আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করে আসছে। উল্লেখ করা যেতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের কড়া মুসলিম দেশগুলোর কোরবানি দেয়ার বিধি আমাদের বাঙালীর থেকে ভিন্ন মাত্রার। অনেকটাই আল্লাহর নির্দেশ যতটুকু ঠিক ততখানি। অর্থাৎ শুধুমাত্র ধর্মীয় নিয়মকে মেনে চলা। উৎসব আয়োজনকে সেভাবে তোয়াক্কা করা হয় না। আরেক ধর্মীয় ব্রত হজ পালনের পর পর কোরবানির রেওয়াজই সবাই মেনে চলে। নিয়মমাফিক দুম্বা কিংবা খাসি জবাই দিয়ে ধর্মীয় আবেদনকে সম্মান জানানো নয়। মাংস সংরক্ষণ কিংবা ফ্রিজে রেখে তা পরবর্তীতে খাওয়া তেমন সামাজিক আচার সৌদি আরব থেকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোন দেশে দেখা যায় না বলে উল্লেখ করেন যারা হজব্রত পালন করে দেশে ফিরে আসেন। আর আমরা বাঙালীরা উৎসবপ্রিয় জাতি। বারো মাসে তেরো পার্বণ পালন করা বাঙালী আনন্দ আয়োজনে সমস্ত ধর্মীয়, সামাজিক, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যিক অনুষ্ঠানগুলো পালন করে। সেটা নববর্ষ থেকে শুরু করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, জাতীয় দিবস এবং সামাজিক উৎসব যাই হোক না কেন। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে এবার আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বর্ষ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা দিবস, বাংলার নববর্ষ পরবর্তীতে ঈদ-উল ফিতরের ধর্মীয় উৎসবও ঘরে বসেই তথ্য-প্রযুক্তির বলয়ে উপভোগ করি। সেভাবে আমরা তৃপ্ত হইনি, মনও ভরেনি। শুধুমাত্র নিয়মটুকু রক্ষা হয়েছে মাত্র। তাই আগামী ঈদ-উল আজহা উৎসবও কিভাবে পালন করা বাঞ্ছনীয় হবে সেটাও যেন এখন সময়ের প্রশ্ন। তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে আছে আরও এক ধর্মীয় নির্দেশ। পবিত্র হজ পালন করা, যা শুধু মুসলিম বিশ্বের নয় সারা পৃথিবীর লাখো মুসলমানের সর্ববৃহৎ জমায়েতে অনুষ্ঠিত এক অসাধারণ ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পবিত্র পরিবেশ। যেখানে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর মাজার শরীফ জিয়ারত করা মুসলমানদের পবিত্র দায়িত্ব। আর কাবা শরীফ দর্শন তো কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানের আজন্ম লালিত স্বপ্ন, সাধনা। কিন্তু এবার সেই কাক্সিক্ষত স্বপ্নের দরজায় কঠিন কষাঘাত বর্ষণ হচ্ছে। পর্বতপ্রমাণ প্রাচীর খাড়া করে এমন মিলন উৎসবকে বিপন্নতার শিকার করছে। প্রায়ই ৩ মাস শেষ হতে চলল বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে সামাজিক দূরত্বকে আমলে নিয়ে শুধু বিধি পালন করার কঠিন বিষয়টি। সামনে অপেক্ষা করছে মহান হজ পালনের ধর্মীয় নির্দেশনা। সঙ্গত কারণে সৌদি সরকারও অন্য বারের মতো এই সময় বড় ধরনের জমায়েতকে পরিহার করতে তার দেশে হজ করতে যাওয়া মানুষের সংখ্যার ওপর বিধিনিষেধ জারি করেছে। সামাজিক দূরত্বকে অনুসরণ করে স্বাস্থ্যবিধির আওতায় পবিত্র হজ পালনকেও শামিল করা হবে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য একটি কষ্টকর অবস্থা তো বটেই। আর বাঙালী মুসলমানদের জন্য সেখানে আরও একটি দুর্ভোগ যুক্ত হয়েছে কোরবানি দেয়াকে কেন্দ্র করে। আমরা এই ধর্মীয় বিধিকেও পালন করি উৎসব, আয়োজন আর সাড়ম্বরে। প্রস্তুতি চলতে থাকে বছরের শুরুতেই। কোরবানির পশুরহাটে দেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্য করার প্রাসঙ্গিক বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। আগস্ট মাসের শুরুতেই কোরবানির দিনক্ষণ স্থির হয়েছে চাঁদের হিসাব অনুযায়ী। হাতে মাত্র এক মাস কয়েকদিন। এই স্বল্প সময়ে করোনার বিস্তার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা হিসাব করা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ ধর্মীয় এই উৎসবটিকে প্রতিবারের মতো উপভোগ করতে পারবে কি না, তা বলা কঠিন। আর পশু ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিক কর্মযোগে বিপত্তি দেখা দেয়ার আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। লেখক : সাংবাদিক
×