ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

করোনা কি পরাজিত করা সম্ভব?

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ২৪ জুন ২০২০

করোনা কি পরাজিত করা সম্ভব?

লিখতে বসলে করোনা ছাড়া আর কোন সাবজেক্ট খুঁজে পাই না। কিন্তু তা নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে না। এত আতঙ্ক, এত মৃত্যু নিয়ে কি লিখতে ইচ্ছে করে? ব্রিটেনের বর্তমান রানী এলিজাবেথের বাবা কিং জর্জ দ্য সিক্সথ যখন মারা যান, তখন তার বড় ভাই সিংহাসন ত্যাগী এডোয়ার্ড দ্য এইট্থ্ শবানুগমন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কুইন ডিক্টোরিয়া থেকে শুরু করে আমার ছোট ভাই পর্যন্ত এই নয়বার রয়্যাল ফ্যামিলির শবানুগমন করলাম। আমার শবানুগমনের জন্য কেউ হয়তো থাকবে না।’ আমি রাজা নই, সামান্য কলাম লেখক। কিন্তু বাংলাদেশে যে হারে আমার বন্ধুরা মারা যাচ্ছেন, তাতে মনে হয়, আমি চলে গেলে আমার জন্য শোক প্রকাশের কেউ থাকবে না। দুঃখ এটা নয় যে, আমি চলে গেলে শোক প্রকাশের কেউ থাকবে না। দুঃখ, আমার চোখের সামনে একজনের পর একজন বন্ধু চলে যাচ্ছেন। আমার বন্ধু হওয়ার চাইতে বড় কথা তারা ছিলেন দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর শীর্ষ মানুষ। যারা দেশকে আলোকিত করেছেন। দেশের মানুষকে আলোর দিশা দেখিয়েছেন। প্রায় একই সঙ্গে চলে গেলেন. ড. বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামান, কামাল লোহানী এবং আরো অনেকে। এরা সকলেই ছিলেন আমার বন্ধু। তাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নিজের মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাই। মৃত্যু ভয়ে আমি ভীত নই এমন কথা বলবো না। তবে স্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আমাদের প্রয়াত নির্মলদা (নির্মল সেন) লিখেছিলেন, ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’। আমি সেই স্বাভাবিক মৃত্যু চাই। করোনায় মৃত্যু চাই না। এই রোগ মানুষকে মৃত্যুর আগেই নিঃসঙ্গ করে দেয়। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি স্ত্রী-সন্তানকেও কাছে আসতে দেয় না। লন্ডনে লকডাউনের সময় ডিভোর্সের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সেখানে সমাজ বিচ্ছিন্নতা বর্তমানে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে, ভবিষ্যতে কী করবে তা ভেবে দেখার মতো। চিকিৎসকেরা বলছেন লকডাউনের ফলে মানসিক রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। দারুণ আতঙ্কিত হয়েছিলাম আমার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার অসুস্থতার খবরে। তার শরীরেও করোনাভাইরাস পজিটিভ হয়ে ধরা পড়েছে জেনে মনে হয়েছে বন্যার কিছু হওয়ার চাইতে আমার মৃত্যু হওয়া ভাল। বন্যা আমার ছেলের চাইতে বছর দুয়েকের বড়। তাকে একজন শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে শ্রদ্ধা করি। নিজের মেয়ে অথবা বোনের মতো ভালবাসি। বন্যাও আমাকে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান দেন। তার ছোট বোন উর্মি মাজহারও তাই। বন্যাকে দুই বাংলার মানুষই কতটা ভালবাসে, সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে সম্মান করে তার পরিচয় পেয়েছি শান্তিনিকেতন এবং কলকাতায় গিয়ে। বিশ্বভারতীতে আমি বক্তৃতা দিয়েছি রবীন্দ্রনাথের ওপরে। সেখানে সকলে আমার কাছে বন্যার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। কনিকা বন্দোপাধ্যায়ের (মোহরদি) ছোট বোন শান্তিনিকেতনে মোহরদির বাড়িতে (মোহরদি তখন নেই) আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাদের সকলের মুখে মুখে ছিল বন্যার কথা। বন্যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্র্রীয় সম্মান স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। আবার পশ্চিম ‘বঙ্গের বঙ্গভ‚ষণ’ পদক পেয়েছেন। সারা ভারতেই তার জনপ্রিয়তা। এখন টেকসাসে আমার আরেক প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শ্রেয়া গুহ ঠাকুরতা থাকেন। কয়েকদিন আগে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হতেই বন্যার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। কলকাতা এবং শান্তিনিকেতন থেকেও এখন টেলিফোন পাচ্ছি বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে। সবাই জানতে চাইছেন বন্যা কেমন আছেন? দুই বাংলাতেই বহু বিশিষ্টজনের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখেছি ড. আনিসুজ্জামানের শেষ অসুস্থতার সময়ে। কলকাতায় ড. আনিসুজ্জামানকে সাহিত্যে আনন্দ পুরস্কার দেয়ার সময় বলা হয়েছিল, ‘তিনি দুই বাংলার গর্ব।’ বন্যা সম্পর্কেও ওই একই কথা বলা হয়েছে। আমি বন্যা সম্পর্কে বলি, সারা বিশ্বের বাঙালী তাকে নিয়ে গর্ব করে। যা হোক, বন্যাকে নিয়ে আমার উৎকণ্ঠা একটু কমেছে। তিনি বাসাতেই আছেন। রোগ তেমন সিরিয়াস নয় জেনে স্বস্তি পেয়েছি। মাত্র ক’দিন আগে চ্যানেল আইয়ে প্রচারিত আমার একটি কবিতার ব্যাকগ্রাউন্ড সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’ গানটি গাইতে তাকে অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আমার অনুরোধ রেখেছেন। কখনই আমার কোন অনুরোধ তিনি উপেক্ষা করেননি। আমি তার পূর্ণ আরোগ্য কামনা করি। ঢাকা থেকে আমার এক তরুণ সাংবাদিক বন্ধু টেলিফোনে বলেছেন, গাফ্ফার ভাই, একাত্তর সালে পাকিস্তানের হানাদারেরা আমাদের সু-বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সকলকেই হত্যা করে গেছে। করোনা এসে সম্ভবত বাকি সকলকেই নিয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকবে কু-বুদ্ধিজীবীরা। তাহলে দেশের কী হবে? দেশের বুদ্ধিজীবীদের সু আর কু দু’ভাগে ভাগ করায় মনে মনে অস্বস্তি বোধ করেছি। কিন্তু হিসাব করে দেখেছি দেশে মারা গেছেন শুভ বুদ্ধির বুদ্ধিজীবীরাই বেশি। ঢাকায় মারা গেছেন কামাল লোহানী। একই সময়ে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেছেন ‘বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত-শিল্পী’ হিসেবে পরিচিত ভেরা লীন (উধসব ঠবৎধ খুহহ)। অবশ্য তার বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। করোনায় তার মৃত্যু হয়নি। বার্ধক্যজনিত রোগে মারা গেছেন। তার মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন ব্রিটেনের রানীসহ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রনায়ক। ভেরা ব্রিটেনের রানীর শৈশবকালের খেলার সঙ্গী ছিলেন। তার গানের গলাও ছিল যেমন অসাধারণ, তেমনই তিনি ছিলেন অসাধারণ রূপসী। মহাযুদ্ধের সময় তিনি স্বেচ্ছায় মিত্রপক্ষের সেনাশিবিরে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে সৈন্যদের মনে সাহস ও প্রেরণা জোগাতেন। সৈন্যরা তার গান শুনলে আশায় আনন্দে জেগে উঠত। তিনি পাশ্চাত্যে হয়ে উঠেছিলেন গানের জগতে ‘আইকন’। রানী এলিজাবেথ এবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ‘উই উইল মিট এগেইন’ গানের ছত্রটি আবৃত্তি করে করোনাপীড়িত সারা বিশ্বে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছেন, সেটি ভেরা লীনের গান থেকে নেয়া। গানটি হচ্ছেÑ‘উই উইল মিট এগেইন/ডোন্ট নো হোয়েয়ার/ ডোন্ট নো হোয়েন/বাট আই নো উই উইল মিট এগেইন/সাম সানি ডে।’ (আমাদের আবার দেখা হবে/ কোথায় দেখা হবে জানি না/ কখন দেখা হবে তাও জানি না/কিন্তু আমি জানি আমাদের দেখা হবে/ কোন এক সূর্যকরোজ্জ্বল দিবসে)। এই গানটি এখন সারা পশ্চিমা জগতে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষের মনে আশা ও প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে রানী এলিজাবেথের ভাষণটিও। সেটি এখন পরিচিত কবি লিলিবেথের (রানীর ডাক নাম) কবিতা হিসেবে। বাংলাদেশেও কোন কোন কবি ‘আবার আমাদের দেখা হবে’ এই লাইনটিকে কেন্দ্র করে কবিতা ও গান লিখে মানুষের মনে করোনাভীতি দূর করেছেন। এর মধ্যে তরুণ কবি অপূর্ব শর্মার গান ও কবিতা অনলাইনে প্রচারিত হয়ে প্রশংসিত হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতিসেবীরা যেমন দাঙ্গা প্রতিরোধে প্রাণ তুচ্ছ করে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, ঝড় বন্যায় দুর্গতদের রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, আজও তেমনি করোনার আতঙ্ক দূর করা এবং মানুষের মনে সাহস জোগানোর জন্য তাদের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ করা দরকার। অনলাইনে ভিডিও সম্মিলন দ্বারাই তারা এ কাজটি করতে পারেন। অনেকে তা শুরু করেছেনও। এই প্রচেষ্টা আরও সম্মিলিতভাবে করা দরকার। করোনা বিশ্বগ্রাসী দৈত্য হলেও তাকেও যে পরাজিত করা যায় তার প্রমাণ দিয়েছে স্পেন ও নিউজিল্যান্ড। দু’টি দেশই নিজেদের সম্পূর্ণ করোনামুক্ত বলে ঘোষণা করেছে। স্পেন তার সীমান্ত খুলে দিয়েছে। পর্যটকদের তাদের দেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। নিউজিল্যান্ডও তাই। জার্মানি ও অস্ট্রিয়া ঘোষণা করেছে তারাও করোনামুক্ত হতে চলেছে। স্পেনের এক সরকারী মুখপাত্র বলেছেন, অত্যন্ত শক্তভাবে লকডাউন ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বহাল রেখে তারা দেশকে করোনামুক্ত করেছেন। এটা বাংলাদেশেও করা সম্ভব। যদি সরকার কঠোর হয় এবং সেই কঠোরতার সহযোগী হন দেশের সাধারণ মানুষও। যারা নিত্য খেটে নিত্য খায়, তাদের কথা অবশ্যই ভাবতে হবে। সেজন্য সরকার তো নিজস্ব খাদ্য ভাÐার গড়বেই। বড় বড় শিল্পপতি-বিশেষ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিকদের উচিত মুনাফার পাহাড় কেটে তাদের ফ্যাক্টরির নারী-পুরুষ কর্মীদের জরুরী অবস্থায় সাহায্য দানের জন্য জরুরী ত্রাণ তহবিল গঠন করা। এটা মালয়েশিয়ার শিল্পপতিরা করেছেন। আমাদের শিল্পপতিরাও চারদিকে একটু চোখ তুলে তাকান। [লন্ডন, ২৩ জুন, মঙ্গলবার, ২০২০]
×