ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ

ভুট্টার বাম্পার ফলন ॥ কৃষকের মুখে স্বস্তির হাসি

প্রকাশিত: ২৩:০১, ২৪ জুন ২০২০

ভুট্টার বাম্পার ফলন ॥ কৃষকের মুখে স্বস্তির হাসি

ওয়াজেদ হীরা ॥ বগুড়ার কৃষক মোসলেম উদ্দিন (৫২)। ফসলি জমিতে নিয়মিত প্রতিবছর ভুট্টা চাষ করেন। এ বছর রোগবালাই তেমন ক্ষতি করতে পারেনি ফসলের। ফলনও গত বছরের তুলনায় ভাল হয়েছে। এতে করে হাসি ফুটেছে মোসলেম উদ্দিনের মুখে। সারাদেশে বেড়েই চলেছে ভুট্টার উৎপাদন। এতে ভুট্টায় ভাগ্য বদলের স্বপ্ন এখন ভুট্টা চাষিদের চোখে মুখে। সবুজ পাতার আড়ালে হাসছে হলুদ রঙের ভুট্টার মোচা (ফল)। ফলন হয়েছে বাম্পার। কোথাও কোথাও উৎপাদিত ফসল ভুট্টা বাজারজাতকণ নিয়ে ব্যস্ত কৃষকরা। ভুট্টা উৎপাদন ও বিক্রি করে কৃষক মুখে ফুটেছে স্বস্তির হাসি। দেশের উত্তরাঞ্চলে বেশি ভুট্টা আবাদ হয়। উত্তরের বিভিন্ন জেলায় ভুট্টা নিয়ে কৃষকরা ব্যস্ত। ইতোমধ্যেই অনেকেই উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে বেশ ভাল আয় করেছেন। জানা গেছে, উৎপাদনে ধানের চেয়ে ভুট্টার খরচ কম হওয়ায় অনেক কৃষক ভুট্টার চাষের দিকে ঝুঁকছেন। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রত্যেক বছরই ভাল দাম পাওয়ার কারণে কৃষকদের মধ্যে ভুট্টা চাষে আগ্রহ বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার ভুট্টা উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে তা ছাড়িয়ে যাবে। কারণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণের সরেজমিন উইংয়ের তথ্য মতে, চলতি বছরে ভুট্টা উৎপাদনের জন্য চার লাখ ৫২ হাজার ৩৪১ হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চার লাখ ৬২ হাজার ৮৮ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষাবাদ হয়েছে। ফলে, এবার ভুট্টা উৎপাদনের জন্য ৪৪ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা ছেড়ে যাবে। কারণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে। সরেজমিন উইংয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভুট্টা দিয়ে পোল্ট্রি এবং মাছের খাবার তৈরি হয়। আমাদের দেশে পোল্ট্রি এবং ফিশারিজের প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টার চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক ড. আলহাজ উদ্দিন জানিয়েছেন, ভুট্টা চাষিরা এই আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন। সে কারণে প্রতিনিয়ত ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। বগুড়ার শেরপুর ও ধুনট উপজেলার কতিপয় ভুট্টা চাষিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা জানান, এ বছর ভুট্টার ফলন ভাল। অন্য বছরের চেয়ে এবার রোগবালাইও কম হয়েছে আর দামও ভাল পাচ্ছেন। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আব্দুল হাকিম জনকণ্ঠকে বলেন, কৃষকের দিন যত যাচ্ছে এটির চাষাবাদে আগ্রহ বাড়ছে। ভুট্টা এখন উত্তরাঞ্চলে বেশি হচ্ছে। প্রতিবছরই দাম পায় এজন্য কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ হচ্ছে। ফসলটির উৎপাদন খরচের চেয়ে লাভ বেশি হওয়াও কৃষকদের আগ্রহ বড় কারণ বলেন তিনি। কৃষক হাফিজ জানান, তারা দীর্ঘদিন ভুট্টার চাষ করেন। এটিকে বাদ দিয়ে অন্য ফসলের চিন্তা করতে পারেন না। ইমরান হোসেন জানিয়েছেন, এ বছর মোট ১০ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন তিনি। বর্তমানে আবহাওয়া ভাল না থাকায় তড়িঘড়ি করে ফসল ঘরে তুলছেন তিনি। বেশিরভাগ জমির ফসল ঘরে তুলেছেন ও বাজারজাত করেছেন। জানা গেছে, কয়েক বছর আগে থেকে চরাঞ্চলের কৃষক অল্প অল্প করে ভুট্টার আবাদ শুরু করেন। সময়ের ব্যবধানে চাষের জমির পরিধি বাড়িয়েছেন। এ বছরও চরের অনেক জমিতে ভুট্টা চাষ করেছেন চরাঞ্চলের চাষিরা। সারিয়াকান্দি ও সোনাতলার কৃষকরা জানান, এ উপজেলার চরাঞ্চগুলোতেও ভুট্টা চাষ হয়ে থাকে। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে তাদের টিকে থাকতে হয়। কেননা চরের পলি বা বেলে যুক্ত মাটি সাধারণত পানি ধরে রাখতে পারে না। পানির স্তরও তেমন একটা ভাল না। তাই স্বল্প সেচের ফসল চরের মাটিতে চাষের চিন্তা করতে হয় তাদের। স্বল্প সেচের ফসলের কথা চিন্তা করে ও নিজেদের ভাগ্য বদলে ভুট্টাই বেছে নেন তারা। কৃষকদের তথ্য মতে অন্য ফসলের চেয়ে এ ফসল ধানের তুলনায় লাভজনক ও জমিতে সেচ কম দিতে হয়। ফলনও বেশ ভাল হয়। প্রায় সময়ই বাজারে দাম ভাল থাকে এ ফসলের। চাষিরা জানান, বীজ, সার, পানি, জমি প্রস্তুত, লাগানো, শ্রমিক মজুরি, কাটা-মাড়াইসহ প্রতি বিঘায় তাদের খরচ হয় সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা। এরমধ্যে প্রতি বিঘায় উৎপাদন হয় গড়ে ৩৫-৪৫ মণ হারে। তারা প্রতিমণ শুকনো ভুট্টা বাজারে বিক্রি করছেন ৬০০-৬৫০ টাকা এবং একটু ভেজা ভুট্টা বিক্রি করছেন ৪৫০-৫০০ টাকা। বগুড়ার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, এ জেলার কয়েকটি উপজেলায় রবি ও খরিফ দুই মৌসুমে ভুট্টা চাষ হয়ে থাকে। এ বছর রবি মৌসুমে জেলায় প্রায় ৮ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ করে চাষিরা। যার মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৪ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন ভুট্টা। খরিফে জেলায় ৪০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ করা হয়েছে। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার ভুট্টা চাষে অনেক কৃষককে প্রণোদনা দিচ্ছে। এছাড়া মাঠ প্রদর্শনী বাবদও অনেক কৃষক প্রণোদনা পাচ্ছেন। দেশের অধিকাংশ উপজেলায় ৭০০ থেকে ৮০০ জন ভুট্টা চাষিকে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। প্রণোদনার আওতায় প্রত্যেক চাষিকে দুই কেজি করে ভুট্টার বীজ, ২০ কেজি ডিএপি সার ও ১০ কেজি এমওপি (পটাশ) সার বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। রাজস্ব খাত থেকেও এনএটিপি (ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রজেক্ট) প্রকল্পের আওতায় অনেকে ভুট্টার ওপর প্রদর্শনী প্লট পেয়েছেন। এসব কৃষকের প্রত্যককে নগদ দেড় হাজার টাকাসহ সার, কীটনাশক, সাইনবোর্ড বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ আব্দুল হাকিম আরও বলেন, সবচেয়ে দিনাজপুর ঠাকুরগাঁওয়ে বেশি ভুট্টা হচ্ছে। এদিকে, নাটোরের সিংড়ার কৃষি প্রধান চলনবিল অঞ্চলে কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি আর নদী পথে উজানের পানি এসে আকস্মিক বন্যার কবলে ভুট্টা নিয়ে মহাবিপাকে পড়ে কৃষকরা। নৌকা নিয়ে পানির নিচ থেকে ভুট্টা কেটে ঘরে তুলে আনেন। চলনবিল অধ্যুষিত ডাহিয়া, বেড়াবাড়ি ও হিজলী গ্রামের কতিপয় ভুট্টা চাষিরা বলেন, ভুট্টা ফলন ভাল হঠাৎ বন্যায় কিছুটা কষ্ট হয়েছে। এই হঠাৎ বন্যার কারণে এই অঞ্চলে গতবারের চেয়ে প্রতিবিঘা ৫-১০ মণ ভুট্টা কম হতে পারে বলেও জানান। ডাহিয়া গ্রামের এক কৃষক বলেন, আমার ২৩ বিঘা জমির ভুট্টা কাটা মাড়াই করে ঘরে তুলেছি। গতবারের চেয়ে অর্ধেক ফলন পেয়েছি। সিংড়া উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে সিংড়া উপজেলায় ১৭ শত হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়েছে এর মধ্যে চলনবিলের ডাহিয়া ও ইটালী ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হেক্টর জমির ভুট্টা আগাম বন্যার পানিতে ডুবে যায় পরে নৌকা দিয়ে কৃষকরা এসব জমির ভুট্টা কাটছেন। দেশের দ্বিতীয় ভুট্টা উৎপাদনকারি জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে গত বছরের তুলনায় প্রায় নয় হাজার হেক্টর জমিতে বেড়েছে ভুট্টার আবাদ। এছাড়াও তৃতীয় উৎপাদনকারি সীমান্ত জেলা চুয়াডাঙ্গার কৃষকরাও ভাল ফলন পেয়েছেন।
×