ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওজন মাপার মেশিনে যাদের সংসার চলত ভাল নেই তারা

প্রকাশিত: ২৩:০০, ২৪ জুন ২০২০

ওজন মাপার মেশিনে যাদের সংসার চলত ভাল নেই তারা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ এই ওজন, ওজন। ওজন মাপেন দুই টাকা। ডিজিটাল মেশিনে উচ্চতাসহ ওজন মাপেন পাঁচ টাকা। আবার ডিজিটাল মেশিন থেকে মিউজিকের সঙ্গে ওয়েলকাম, ওয়েলকাম বলে ডাকতে শোনা যেত। সেই চেনা ডাক থেমে গেছে। ঢাকার রাস্তায় সকাল থেকে রাত অবধি পরিচিত এই ডাক এখন আর শোনা যায় না। করোনা পরিস্থিতির কারণে রাস্তায় কাউকেই আর ওজন মাপতেও দেখা যায় না। এতে করে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন সমাজের সবচেয়ে নি¤œ আয়ের এসব পেশার মানুষ। যারা ভোর থেকে রাত ৯টা/১০টা পর্যন্ত রাস্তায় ছোট একটি কাঁটাওয়ালা মেশিন ওজন মেপে সংসার চালাতেন। কারণ জানতে চেয়েছিলাম ঢাকার কল্যাণপুর নতুন বাজারের পাশে ফুটপাথে ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে বসে থাকা তিন জনের কাছে। সবার উত্তরই প্রায় একই। এর মধ্যে শমসের আলী নামের এক ব্যক্তি বসতেন কল্যাণপুর হাউজিং সোসাইটির গেটের কাছেই উঁচু ফুটপাথে। বলছিলেন, বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়। রিক্সা চালাতে পারি না। ভারি কাজ করতে পারি না। সামান্য কাজ করলেই হাঁপিয়ে যাই। ছেলে মেয়েরাও আর তেমন দেখে না। স্ত্রীরও বয়স হয়েছে। কি আর করব তাই ভোর থেকে নিয়ে রাত ৯টা/১০টা পর্যন্ত ফুটপাথে বসে থাকতাম ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে। যন্ত্রটি বারোশ’ টাকায় কেনা। শমসের আলী বলেন, আশপাশে কোন পার্ক না থাকায় এখানে রোজগার কম। যেখানে পার্ক আছে, সেখানে মানুষ হাঁটা বা দৌড়ানোর আগে বা পরে প্রায় সবাই একবার হলেও ওজন মাপেন। তারপরেও তার কোন দিন একশ’ আবার কোন দিন দেড়শ’ টাকাও রোজগার হতো। শুক্রবার আর শনিবার একটু বেশি আয় হতো। মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা রোজগার ছিল। কল্যাণপুর পোড়া বস্তিতে এক হাজার টাকায় একটি ছোট রুম ভাড়া নিয়ে থাকি। বাকি টাকা দিয়ে সারা মাসের খাবার খরচ কোনমতে হয়ে যেত। কিন্তু করোনা শুরুর পর দিন দিন রোজগার কম থাকে। এখন আর মেশিন নিয়ে রাস্তায় গেলেও কেউ ওজন মাপেন না। কারণ জানতে চাইতেই তিনি বলছিলেন, মানুষের পায়ের জুতা থেকে নাকি করোনাভাইরাস ছড়ায়। এজন্য কেউ আর ওজন মাপেন না। কারণ একই মেশিনের ওপর যারা ওজন মাপবেন, পর্যায়ক্রমে তাদের সবাইকেই দাঁড়াতে হয়। কার পায়ের জুতায় করোনাভাইরাস আছে, তা কেউ জানে না। এজন্য কেউ আর ভয়ে ওজন মাপেন না। অনেকেই ওজন মাপার জন্য রাজি হলেও, মেশিন ভালভাবে স্যাভলন, সাবান বা জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে বলে। আবার মাপার পর জুতার নিতে স্প্রে করে দিতে বলে। এ এক বাড়তি ঝামেলা। আর এজন্য খরচও আছে। যদিও বিøচিং পাউডারের তৈরির পানি দিয়ে পরিষ্কার করা তুলনামূলক সস্তা হয়। কিন্তু তাতে বিপত্তি বেশি। বিøচিং পাউডারের এক ধরনের গন্ধ আছে। আবার স্প্রে করার সময় সব সময়ই পায়ের নিচে লাগবে তাও ঠিক নয়। অনেক সময় জুতার উপরে বা পায়ের চামড়ায় লেগে যায়। এটি নাকি ক্ষতিকর। মূলত বিøচিং পাউডারের গন্ধ বের হওয়ার কারণেই এখন আর কেউ ওজন মাপেন না। তিনি বলছিলেন, দিন আর কাটে না। দু’একবার ত্রাণ পেলেও এখন আর পাই না। আবার করোনা না যাওয়ার কারণে সবকিছু অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেলেও মানুষ ওজন মাপেন না। তাই ওজন মাপার যন্ত্র ঘরেই রেখে দিয়েছে। নষ্ট হওয়ার ভয়ে নিজেরাই মাঝে মাঝে মেপে যন্ত্র ঠিক রাখি। আর কোন উপায় নেই। শুধু আমি নই, ঢাকায় ওজন মেপে পেট চালানো লাখ লাখ মানুষের একই অবস্থা। সাধারণত কোন কাজকর্ম করতে পারে না এমন বৃদ্ধ, নানা অসুখ বিসুখে মারাত্মকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি ও ছোট ছোট ছেলেরা ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে রাস্তায় বসে থাকে। আবার অনেকেই ছোট চাকরি করেন। বিকেলে বা ভোরে ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে যেসব জায়গায় মানুষজন হাঁটাহাঁটি করেন সেখানে বসে থাকেন। এতে করে চাকরির পাশাপাশি বাড়তি কিছু টাকা রোজগারও হয়। শেরেবাংলা নগর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সামনে এমন একজন সরকারী চাকরীজীবী বসতেন। তিনি মিরপুর সরকারী বাঙলা কলেজ লাগোয়া ওয়াসা অফিসের ছোট কর্মচারী। ভোরে প্রতিদিন ওজন, প্রেসার ও ডায়ারেটিস মাপার যন্ত্র নিয়ে বসতেন। যারা ওই এলাকায় জগিং করতেন, তাদের প্রায় তাকে চিনতেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলছিলেন, কি করব ভাই, ছোট চাকরি করি। বেতন কম। সংসার ঠিকমতো চালাতে পারি না। তাই সকালে এখানে বসি। ২৫/৩০ জনের ওজন, প্রেসার ও ডায়েবেটিস মাপতে পারলে একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকার মতো আয় হয়। আবার কোন কোন দিন একটু বেশি বা কম হয়। বিকেলে রাস্তাটিতে প্রচুর ধুলা থাকায় বসা যায় না। এখানে মহিলা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হোস্টেল আছে। হোস্টেলের কোন কোন ছাত্রী বাড়তি রোজগার করতে ভোরে ওজন, প্রেসার ও ডায়াবেটিস মাপার মেশিন নিয়ে বসেন। আবার কেউ কেউ পাশাপাশি স্বাস্থ্য সংস্থা নানা বইপুস্তক নিয়ে বসতেন। তবে ওইসব ছাত্রী বোরখা পরিধান করে বসতেন। এখন আর এসবের কোন বালাই নেই। রাস্তায় ওজন মাপার মেশিন চোখে পড়ে না বললেই চলে। বিভিন্ন ফার্মেসিতে থাকা ওজন মাপার মেশিনে ধুয়ে মুছে নিরাপদ জায়গায় রেখে দিয়েছে।
×