ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্গম পাহাড়ী এলাকার খাসিয়া পল্লীতে নয়া পর্যটন স্পট

শ্রীমঙ্গলের লাসুবনে সন্ধান মিলল তিন গিরিখাতের

প্রকাশিত: ২৩:২০, ২৩ জুন ২০২০

শ্রীমঙ্গলের লাসুবনে সন্ধান মিলল তিন গিরিখাতের

সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন ॥ কয়েক হাজার বছরের পুরনো কয়েকটি গিরিখাত বা গিরিসঙ্কটের সন্ধান পাওয়া গেছে! এরমধ্যে বড় তিনটি গিরিখাত বা গিরিসঙ্কট নজরে এসেছে সবার যা বিশ্বের অন্যান্য গিরিখাতের চেয়েও আকর্ষণীয়, সুন্দর ও রোমাঞ্চকর। একইসঙ্গে এসব গিরিখাতে খুঁজে পাওয়া গেছে কয়েকটি ছোট ছোট জলপ্রপাত ও ঝর্ণা। এসব গিরিখাতের সন্ধান মিলেছে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখার ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ী এলাকায়। সম্প্রতি সীমান্ত এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখতে গিয়ে শ্রীমঙ্গলের এক গণমাধ্যমকর্মী এবং কয়েকজন প্রকৃতিপ্রেমী ঘন জঙ্গলের ভিতরে খুঁজে পান এসব গিরিখাত। বিষয়টি তারা মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবগত করেন। গিরিখাতের এই বিশেষ জায়গাটির অবস্থান রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ২১৫ কিলোমিটার এবং মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের ঘন জঙ্গলবেষ্টিত পাহাড়ী এলাকা এটি। প্রথমে জীপ বা মোটরসাইকেল নিয়ে এগোতে হয়। এরপর হেঁটে যেতে হয় কয়েক কিলোমিটার। এগুলো আসলে হাঁটারই পথ। এলাকাটি আদতে গাছগাছালিতে ভরা। এর আশপাশে অধিকাংশ পাহাড়ী ছড়া আর খাড়া পাহাড়। সম্প্রতি আলোচ্য নৈসর্গিক জায়গাটি ঘুরে দেখে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসলে পুরো অঞ্চলটি পড়েছে সেখানকার খাসিয়া পল্লীর ভেতর। আদিবাসী খাসিয়া জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা এটি। খাসিয়া ভাষায় এলাকাটিকে ‘লাসুবন বা পাহাড়ী ফুল’ নামে ডাকা হয়। জনশ্রুতি আছে যে, কয়েক হাজার বছর ধরে অব্যাহতভাবে জলধারা প্রবাহিত হতে হতে গিরিখাতগুলোর দু’পাশ খাড়া পাথরে পরিণত হয়েছে। এই পানির ক্রমাগত ধারায় পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয় মনমাতানো কারুকাজ যা দেখতে হুবহু বিশ্বের বিভিন্নস্থানে আবিষ্কৃত অন্যান্য গিরিখাতের মতো। তবে আমাদের দেশের সদ্য আবিষ্কৃত এই গিরিখাতগুলো দেখতে বেশ রোমাঞ্চকর। তবে এসব গিরিখাতে যাতায়াতের পথ বন্ধুর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। একটি পাহাড়ী ছড়া ধরেই পুরো এলাকাটি ঘুরে আসা যায়। এখানে রয়েছে লাংলিয়াছড়া। এটি ভারতের ত্রিপুরা থেকে নেমে এসেছে। প্রায় ২৫ কিলোমিটার পথ বেয়ে মিশেছে শ্রীমঙ্গলের বিলাস ছড়ায়। সাপের মতো আঁকাবাঁকা ছড়ায় মিশে রয়েছে শ’ খানেক ছোটবড় পাথরের ছড়া। এরমধ্যে কয়েকটি গিরিখাত বা গিরিসঙ্কট এবং কয়েকটি ছোট ছোট জলপ্রপাত ও ঝর্ণা রয়েছে। দিন রাত ঝিরিঝিরি শব্দে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় খাসিয়া ভাষায় ‘ক্রেম ক্লু, ক্রেম কেরি ও ক্রেম উল্কা’ নামে বড় তিনটি গিরিখাত পর্যটকদের মূল আকর্ষণ। পাহাড় থেকে শ’ পাঁচেক নিচে এসব গিরিখাত কোথাও বড় আবার কোথাও সরু। স্থানীয়রা জানালেন, পুরো এলাকায় আছে ছোট-বড় অর্ধশত ছোট ঝিরিধারা। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা এসব ঝিরির সবচেয়ে বড়টিকে স্থানীয়রা ‘ডিবারমিন’ ঝর্ণা বলে থাকেন। নাহার খাসিপুঞ্জীর প্রধান ডিবারমিন পতাম বলেন, জায়গাটি আমরা যতেœ রেখেছি প্রাকৃতিক পরিবেশের কোন ক্ষতি হতে দেইনি। এখানে পর্যটন উন্নয়ন হোক তাতে আমাদের সমস্যা হবে না, তবে পরিবেশের বিয়ষটি সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। নয়তো আমাদের জীবন-জীবিকা ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কারণ আমরা বনজীবী, আমাদের কাছে প্রকৃতিই সব। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার মৌলভীবাজারের সমন্বয়ক আসম সালেহ সোহেল বলেন, মৌলভীবাজারে সম্প্রতি নতুন নতুন অনেক প্রাকৃতিক পর্যটনস্পটের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সেটার দুটো দিক রয়েছে। পর্যটনের জন্য সুখবর হলেও প্রাণ-প্রকৃতির জন্য সুখবর নয়। আমাদের পর্যটকের বড় একটা অংশ প্রকৃতিকে যতœ করতে জানেন না অথবা বড়ই খামখেয়ালিপনা স্বভাব তাদের। পর্যটনের নামে প্রকৃতি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এ বিষয়টি প্রথমেই মাথায় রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, নাহারে সন্ধান পাওয়া স্পটটিকে গিরিখাত বলা যাবে কি-না সেটা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বিষেশজ্ঞ পরিদর্শনের মাধ্যমে ক্যাটাগরি নিশ্চিত করা প্রয়োজন এবং স্থানীয় আদিবাসীদের জীবন-জীবিকায় যাতে কোন ব্যঘাত না ঘটে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য সেখানে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার সীমিত রাখা প্রয়োজন। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন বলেন, সীমান্তবর্তী এই স্থানে এখনও স্বাভাবিক চলাচলের মতো রাস্তাঘাট তেমন গড়ে ওঠেনি। সে কারণে কেউ যাতে ঝুঁকি নিয়ে আপাতত সেখানে না যান আমরা সেই পরামর্শ দিয়েছি। রাস্তাঘাট নির্মাণসহ উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পর সীমিত আকারে অচিরেই পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
×