ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রণেশ মৈত্র

কষ্ট হচ্ছে, শান্তিতে ঘুমাও লোহানী

প্রকাশিত: ২১:৫৫, ২৩ জুন ২০২০

কষ্ট হচ্ছে, শান্তিতে ঘুমাও লোহানী

শরীরটা খারাপ ছিল। শুয়েছিলাম। ঘুমিয়েও পড়েছিলাম। তাই কামাল লোহানী তার ভালবাসার পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার এক ঘণ্টা পরে নানা চ্যানেলে (টেলিভিশনের) ও ফেসবুকে মর্মান্তিক খবর। গভীর মর্মবেদনা আমার বাকি জীবনটুকু তাড়িয়ে বেড়াবে। লোহানী বলে ডাকতাম, সেই ছোটবেলা থেকে। ১৯৫০ সালের কথা পাবনার জনা কয়েক তরুণ মিলে ‘শিখাসংঘ’ নামক বাম প্রগতিশীল চেতনা সমৃদ্ধ একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। তখন পাকিস্তান সবে জন্ম নিয়েছে। প্রয়াত বন্ধু আবদুল মতিন, কামাল লোহানী এবং আরও বেশ কিছু সমমনা তরুণ মিলে যেন শ্বাসরোধ করা পাকিস্তানী পরিবেশ পাল্টাতে চেতন-অবচেতনভাবে মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক-সাম্যবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সমাজ পাল্টানোর নানামুখী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। পেছন ফিরে দেখি সেই অসাধারণ দিনগুলোকে। বাহান্নর মিছিলে পাবনার রাস্তায় সবাই মিলে শহরে নেমেছিলাম। লোহানী ছিলেন জেলার স্কুলের ছাত্র। শিখাসংঘের নেতা-কর্মীরা মিলে মুসলিম ছাত্র লীগের নেতারাসহ সেদিন আমরা পাবনার সকল স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীকে ক্লাস বর্জন করিয়ে মিছিলে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে সমবেত করতে সফল হয়েছিলাম। গভীর উত্তেজনায় ভরা সে মিছিল। স্লোগানে স্লোগানে উচ্চকিত পাবনার পিচঢালা কালো রাজপথ-পাবনার সমগ্র জনগণকে উদ্বুদ্ধ সে মিছিল। ইতিহাসের বাঁক ঘোরানো এই মিছিলকে বাধাগ্রস্ত করেছিল সেদিনের পুলিশ। সে বাধা মানিনি কেউ। বরং আরও দৃপ্ত পদক্ষেপে অধিকতর উচ্চকিত স্লোগানে পাবনাকে কাঁপিয়েছিলাম। স্লোগান লিড করতে হতো মতি, লোহানী ও আমাকে। প্রচারেও থাকতে হতো আমাদেরই টিনের চোঙা হাতে। ১৯৫২ সালের নবেম্বরে আমরা মতিনের বাসায় তার বাবা মুসলিম লীগ নেতা বেলায়েত হোসেন মোক্তারের চেম্বারে বসে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পাবনা জেলা সংগঠনিক কমিটি গঠন করি। আমাকে সভাপতি এবং মতিনকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কী প্রবল উদ্দীপনা। আজ অনেকটাই অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। এলো ১৯৫৩ সাল। আমি গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশনের ছাত্র হিসেবে ১৯৫০ সালে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের প্রথম ব্যাচে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে পারিবাররিক অর্থ সঙ্কটের কারণে কলেজে ভর্তি না হয়ে এডরুক ল্যাবরেটরি নামক ওষুধ প্রস্তুত কারখানায় অফিস সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে চাকরি নেই। কামাল লোহানী জেলা স্কুল থেকে, আবদুল মতিন পাবনা গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশন থেকে ( আমিও জি.সি. ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ছিলাম) ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করে এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হয়। আমিও ভর্তি হলাম চাকরিতে ইতি দিয়ে। এবারে ছাত্র ইউনিয়নের শাখা-প্রশাখা জেলাব্যাপী (তখন সিরাজগঞ্জ ছিল পাবনা জেলার অন্তর্গত একমাত্র মহকুমা) ছড়াল ও সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার পালা। মাস কয়েকের মধ্যেই ছাত্র ইউনিয়নকে আমরা সকলে মিলে পাবনা জেলার বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হই। এলো এডওয়ার্ড কলেজ ছাত্র সংসদের ৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষের নির্বাচন। ছাত্র ইউনিয়নের মনোনয়নে আমরা ভি.পি. জে. এস.সহ গোটা ক্যাবিনেট (মাত্র একজন বাদে) বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করি। তখন পর্যন্ত এডওয়ার্ড কলেজে মুসলিম ছাত্র লীগ ছিল শক্তিশালী অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র সংগঠন। ১৯৫৩ সালের জুলাইতে পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম জেলা সম্মেলন। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে এলেন ভাষা-মতিন নামে খ্যাত আবদুল মতিন। গাজীউল হক, সহ-সম্পাদক আবদুস সাত্তার ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াস। পাবনা টাউন হলে অনুষ্ঠিত দু’দিনব্যাপী সম্মেলন, কাউন্সিল অধিবেশন, গণসঙ্গীতের আবর। নবনির্বাচিত কমিটির পরিচিতি এবং গণসঙ্গীতের আসর প্রচ- আলোড়ন তুলেছিল পাবনায়। ১৯৫৪ তে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্র লীগ মিলে যৌথভাবে ছাত্র কর্মী শিবির পড়ে সবাই নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়ি। ৪ ফেব্রুয়ারি আমার বাবা মারা যান। নির্বাচনী এলাকা থেকে ফিরে এসে ১১ দিনে অশৌচ পালন করে আবার নির্বাচনী এলাকা সুজানগর ফিরে যেতে চাইলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাধা দেন। লোহানী আগে থেকেই পাবনাতে ছিলেন। নেতাদের অভিমত অনুযায়ী সেবার অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ রেখে পাবনায় একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের দিনব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচী নেয়া হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টা থেকে অজ¯্র পুলিশ এসে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। সকালে গ্রেফতার। থানায় যাওয়ার পরপরই গ্রেফতার হয়ে এলেন কামাল লোহানী এবং আরও অনেকে। জেল খানায় বাস করতে হয় এক মাস। নির্বাচনী ফলাফল বেরোচ্ছিল প্রতি সন্ধ্যায়। খবর পাওয়া যাচ্ছিল মুসলিম লীগ প্রার্থীদের পরাজয়ের। কারাবাসের ঠিক ৩০ দিনের দিন নূরুল আমিনের পরাজয়ের খবর বেতারে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই পাবনা শহরে আনন্দের জোয়ার বইতে শুরু করে। সন্ধ্যায়ই বেরোয় বিজয় মিছিল। পর দিনই আমরা মুক্তিলাভ করি। জেল গেটে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজার হাজার লোকের সমাগম। মেইন গেট দিয়ে বেরোতেই মানুষের কাঁধে কাঁধে হলো আমাদের (ছাত্র নেতাদের স্থান), পরে এলো বিপুলসংখ্যক মালা। কারামুক্তদের মাল্যভূষিত করে পুনরায় মিছিল করে যুক্তফ্রন্ট অফিসে চায়ের আয়োজন। অতঃপর বাসায় প্রত্যাবর্তন। গঠিত হলো শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকার। ৫৮ দিনের মাথায় ওই সরকারকে করাচীর কেন্দ্রীয় সরকার বাতিল ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় সবাই গ্রেফতার হই। রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পাবনায় আটকের ১৭ মাস পরে লোহানীসহ আমরা মুক্তি পেয়ে চলে যাই রাজশাহী জেলা ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে। দ্রুতই ছাত্র ইউনিয়ন ভুবন মোহন পার্কে আয়োজিত বিশাল গণ-সংবর্ধনা শেষে ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে সংক্ষিপ্ত নৈশভোজ শেষে রাতের ট্রেনে ইশ্বরদী এসে বাসে পাবনা। সেটা ১৯৫৫ সাল। লোহানী ভালবাসতেন এডওয়ার্ড কলেজে আমাদের সহপাঠী দীপ্তিকে। পরিবারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তারা বিবাহ পর্ব অনাড়ম্বরভাবে শেষ করে উভয়ে ঢাকা চলে যান। কামাল লোহানী যোগ দেন দৈনিক মিল্লাতে। অতঃপর সংবাদে। তারপর রাজশাহীর দৈনিক বার্তা প্রভৃতি। বাল্যকাল থেকে বামপন্থী মতবাদের দীক্ষিত কামাল লোহানী ঢাকায় একটি সংগঠনে নাচের শিক্ষা নেন। হন সাময়িকভাবে অভিনয় শিল্পীও। অতঃপর তার হাতে গড়া সংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’ বেশ কিছুকাল ধরে পরিচালনা করেন। ক্রান্তি ছিল অনেকটা মাওবাদ সমর্থক। এলো একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ। লোহানী চলে গেলেন কলকাতায়। সেখানে বাংলাদেশ বেতারে বার্তা সম্পাদক নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসে ১০ জানুয়ারি-৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে অন্যতম ধারা বিবরণী পাঠ করেন, যা বেতারে সরাসরি প্রচারিত হয়। অতঃপর গড়ে তোলেন বাম ধারার সাংস্কৃতিক সংগঠন গণশিল্পী সংস্থা। অল্প কয়েক বছর আগে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতির আসন অলঙ্কৃৃত করেন। দুই দফায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদের দায়িত্ব পালন করেন। বছর কয়েক আগে দীপ্তি লোহানী মারা যান। মার্কসীয় মতবাদে বিশ্বাসী হলেও তিনি কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দেননি। নিখাদ অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক বাহাত্তরের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী দেখে ক্ষুব্ধ হন। সেদিন আমরা যারা বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন ধারায় বন্ধুত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলামÑলোহানী আর আমি বেঁচেছিলাম। বাকিরা হারিয়ে গেছেন অনেক আগেই। সেদিন গেলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামন। আর আজ ২০ জুন কামাল লোহানীও সকলকে ছেড়ে পরপারে স্থান করে নিলেন। হয়ে পড়েছি নিঃসঙ্গÑঅতীতের সকল বিপ্লবী বন্ধুকে হারিয়ে। বিদায় লোহানী। স্যালিউট। মনে রাখব তোমাকে আমৃত্যু। লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত
×