ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৬৮ এলাকাই রেড জোন হতে পারে

প্রকাশিত: ২২:১৭, ২২ জুন ২০২০

৬৮ এলাকাই রেড জোন হতে পারে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সংক্রমণ বিবেচনায় রাজধানীর ৪৫টি এলাকাকে সরকারের পক্ষ থেকে রেড জোন হিসেবে ঘোষণার প্রস্তাব করা হলেও অন্তত ৬৮ এলাকা রয়েছে যেখানে ৫০ জনের বেশি করোনার রোগী। ইতোমধ্যে সোয়া দুই শতাধিক এলাকায় করোনায় আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রোগী এখন মিরপুরে। সেখানে নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ১৭১। এরপর উত্তরা ৬৭৬ ও মোহাম্মদপুরে ৫২২ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১৬ জুনের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব এলাকার ৫০ জনের বেশি রোগী রয়েছেন সেগুলোকে অবশ্যই রেড জোনের আওতায় আনা উচিত। তাছাড়া রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি রোগী থাকায় এখানে মহল্লাভিত্তিক রেড জোন করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা কঠিন হবে। সংক্রমণ রোধে সবচেয়ে উপযোগী হবে অন্তত ১৫ দিনের জন্য লকডাউন নিশ্চিত করা। তাহলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে বলেও মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন প্রায় ৪৪ হাজারের বেশি মানুষ। ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে মোট পরীক্ষা হয়েছে ছয় লাখের কিছু বেশি। মৃত্যুর হার এক দশমিক তিনভাগ। সুস্থতার হার ৪০ ভাগের বেশি। আইসোলেশনে রয়েছেন ৫৮ ভাগের বেশি মানুষ। আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বিশ্লেষণে বৈশ্বিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশ ১৭তম। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোর লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে চলতি মাসের শেষের দিকে সংক্রমণ কমতে পারে। অন্যথায় আরও বাড়বে। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহান প্রদেশ থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি। পর্যায়ক্রমে এই ভাইরাস গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে মহামারীতে রূপ নেয়। গোটা পৃথিবী কাবু প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ছোবলে। দিন দিন বেশি মাত্রায় চোখ রাঙ্গাচ্ছে কোভিড-১৯। আক্রান্ত দুনিয়ার ২১৫টি দেশ ও অঞ্চল। প্রতিষেধক আবিষ্কারে মরিয়া বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত আশার তেমন বার্তা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একমাত্র টিকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই প্রাণঘাতী এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আক্রান্ত করোনায়। গত আট মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার যা সাত বারের মতো বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়। এরমধ্যে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকে গণপরিবহন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার কথা বলে ৩১ মে থেকে সাধারণ ছুটি তুলে নিয়ে চালু হয় গণপরিবহন। তখন থেকেই মূলত করোনার সংক্রমণ ছিল বাড়তি। যদিও সাধারণ ছুটি তুলে নেয়া ও গণপরিবহন চালুর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা এও আশঙ্কা করেছিলেন, এর ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যু হার বেড়ে যেতে পারে। তাই হয়েছে। প্রতিরোধে এখন সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়ানো ঢাকা মহানগরীতে এলাকাভিত্তিক রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করার চিন্তা করছে সরকার। পাইলট প্রকল্প হিসেবে রাজাবাজার লকডাউন চলছে ১৪ দিনের জন্য। এর বাইরে আরও ৪৫টি এলাকা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুহার বিবেচনায় সারাদেশকে লাল, হলুদ ও সবুজ এই তিন জোনে ভাগ করা হয়েছে। রেড জোন হিসেবে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী ঘোষণা হলেও সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। সব মিলিয়ে রাজধানীর ৪৫টি, ঢাকার বাইরের তিন জেলার ২০টি মিলিয়ে ৬৫টি এলাকা রোড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব এলাকায় সাধারণ ছুটি কার্যকর করা হবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, সংক্রমণ রোধে জোনভিত্তিক কার্যক্রম খুব একটা ফল দেবে না। এজন্য প্রয়োজন সারাদেশে একযোগে লকডাউন ঘোষণা। যা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সংক্রমণের মাত্রা কমতে পারে। জনস্বাস্থ্যবিদদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের করোনাবিষয়ক কমিটির প্রধান ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শাহ মুনির হোসেন বলেন, সংক্রমণ ওপরের দিকে যাচ্ছে, তবে পিকে আছি কিনা সেটা কেউ বলতে পারবে না। তবে গত কয়েক দিনের রোগী শনাক্তের হার বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে আগামী আট থেকে ১৫ দিন এরকম চলতে পারে। এ মাসের শেষ দিক নাগাদ রোগী দেড় লাখ ছাড়িয়ে যাবে এবং এ মাসের শেষের দিকে সংক্রমণ কমতে পারে বলে ডাটা বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া না হলে রোগী বাড়তেই থাকবে বলেও মন্তব্য করেন শাহ মুনির। তিনি বলেন, জুন মাসের প্রথম দিকে সংক্রমণ কমতে থাকে বলে মনে হলেও আজকের অবস্থা হয়েছে ঈদের ছুটির কারণে। আর এখন যদি কঠোর লকডাউন না করা হয়, স্বাস্থ্যবিধি না মানা হয় তাহলে সংক্রমণ আবার বাড়বে। এদিকে আরও ৩৯ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশে নতুন করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৬৪ জন। রবিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ৫৩১ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তাতে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৩০৬ জনে। আইইডিসিআরের অনুমিত হিসাবে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের মধ্যে আরও ১ হাজার ৮৪ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন। এ নিয়ে সুস্থ রোগীর সংখ্যা ৪৫ হাজার ৭৭ জনে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত বুলেটিনে যুক্ত হয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির এই সবশেষ তথ্য তুলে ধরেন। গত সপ্তাহে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৪৫টি এলাকা ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রস্তাব করে। সে অনুযায়ী লাল, হলুদ, সবুজ এই তিন ধরনের এলাকায় কীভাবে কাজ চলবে, তা নিয়ে গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্দেশনা দিয়েছে। সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পুরো দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের হাতেই দেয়া হয়েছে। লকডাউনের জন্য এলাকা চিহ্নিত হলেও সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে সময় লাগছে। ঢাকার দুই নগর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এক ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেও কোন কোন এলাকার কতটুকু অবরুদ্ধ করতে হবে, সে বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সুনির্দিষ্ট রূপরেখার জন্য অপেক্ষা করছেন তারা। রেড জোন অবরুদ্ধ করার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ ইমদাদুল হক বলেন, রেড জোনগুলোর তালিকা তারা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পেয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ‘লকডাউন’ বাস্তবায়নের নির্দেশনা পেয়েছেন। তিনি বলেন, গাইডলাইনে এ ব্যাপারে ক্ষমতা দেয়া আছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে। সেখানে কার কি দায়িত্ব বলা আছে। সে অনুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে বলতে হবে লকডাউনের নির্দেশনা দেয়ার জন্য। কিন্তু তারা এখনও কিছুই বলছে না। সবাই সহযোগিতা না করলে আমরা এ বিষয়টা কিভাবে বাস্তবায়ন করব? এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে একটি নির্দেশনা আসা উচিত। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির দুই মেয়র জানিয়েছেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পেলে তারা এলাকা লকডাউন করবেন। এজন্য প্রস্তুতি নিতে যতটুকু সময় লাগে। ঢাকা দক্ষিণের যেসব এলাকা ॥ যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, মুগদা, গেন্ডারিয়া, ধানমন্ডি, জিগাতলা, লালবাগ, আজিমপুর, বাসাবো, শান্তিনগর, পল্টন, কলাবাগান, রমনা, সূত্রাপুর, মালিবাগ, কোতোয়ালি, টিকাটুলি, মিটফোর্ড, শাহজাহানপুর, মতিঝিল, ওয়ারী, খিলগাঁও, পরীবাগ, কদমতলী, সিদ্ধেশ্বরী, লক্ষ্মীবাজার, এলিফ্যান্ট রোড, সেগুনবাগিচা। ঢাকা উত্তরের যেসব এলাকা ॥ বসুন্ধরা, গুলশান, বাড্ডা, ঢাকা সেনানিবাস, মহাখালী, তেজগাঁও, রামপুরা, আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, মগবাজার, এয়ারপোর্ট, বনশ্রী, রায়েরবাজার, রাজাবাজার, উত্তরা, মিরপুর। ৬৮ এলাকায় ৫০-এর বেশি রোগী ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর সোয়া দুই শ’র বেশি এলাকায় পাওয়া গেছে করোনার রোগী। এরমধ্যে ৬৮ এলাকায় ৫০ থেকে এক হাজার ১০০ বেশি রোগী রয়েছে। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে, মিরপুর এক হাজার ১৭১, উত্তরা ৬৭৬, মোহাম্মদপুর ৫২২, মুগদা ৫০১, যাত্রাবাড়ী ৪৮৪, ধানমন্ডি ৪৬৯, মগবাজার ৩৩৩, তেজগাঁও ৩১৫, কাকরাইল ৩০৪, কামারপাড়া ২৯৬, খিলগাঁও ২৯৩, লালবাগ ২৭০, বাড্ডা ২৬৪, গুলশান ২৩৮, রাজারবাগ ২৩০, মালিবাগ ২০৮, বাসাবো ১৮৬, গেন্ডারিয়া ১৭৩, বাবুবাজার ১৬২, ওয়ারী ১৫৪, আগারগাঁও ১৪০, বংশাল ১৩৭, শ্যামলী ১৩৫, বসুন্ধরা ১২৯, শাহবাগ ১২৯, ডেমরা ১১৮, আজিমপুর ১১৬, আদাবর ১১৫, বনশ্রী ১১৩, রমনা ও শান্তিনগর ১০৫, পল্টন ৯৯, কলাবাগান ৯৭, মিরপুর-১- ৯৬, কল্যাণপুর ও শের-ই বাংলা নগর ৯৩, চকবাজার ৯১, ইস্কাটন ৮৯, গ্রীন রোড ৮৯, মিরপুর-১২-৮৭, লালমাটিয়া-৮৪, জুড়াইন ৭৫, ফার্মগেট ৭৪, কাফরুল ৬৮, কামরাঙ্গীরচর ৬৫, মানিকনগর ও সূত্রাপুর ৬৪, বাড়িধারা ও সেগুনবাগিচা ৬৩, নয়াবাজার-স্বামীবাগ ৬১, ক্যান্টনমেন্ট, শাজাহানপুর ও মান্ডা ৬০, মিরপুর-১১ ও মিটফোর্ড ৫৯, মতিঝিল ৫৭, এ্যালিফ্যান্ড রোড ৫৬, ভাটারা ৫৪, ঝিগাতলা ৫৩, কাঁঠালবাগান ৫৩, মিরপুর-১৪, নাখালপাড়া ৫৩, হাতিরপুল ৫২, চাঁনখারপুল ও কমলাপুর ৫০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, কোন এলাকায় যদি ১০ জনের বেশি রোগী থাকে তবে সে এলাকাটিই ঝুঁকিপূর্ণ বলা চলে। এরমধ্যে যেখানে ৫০ জন রোগী রয়েছেন সেসব এলাকা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা স্বাভাবিক। কারণ ৫০ জন অনেক জনকে সংক্রমিত করতে পারেন। তিনি বলেন, পুরো শহর জুড়েই যখন করোনার রোগী তখন এলাকা ভাগ করে কি লাভ হবে। গোটা শহর লকডাউন করা ছাড়া বিকল্প নেই। কিছু কিছু এরিয়া রেড জোন করে লকডাউন করলে খুব একটা ফল দেবে বলে মনে হয় না। তবে সবকিছুই কঠোরভাবে করার সময় চলে যাচ্ছে। অন্যথায় সামনের দিনগুলোতে বিপদ আরও বাড়তে পারে।
×