ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এ পর্যন্ত দেশে ১৬ দফা কালো টাকা সাদা হয়েছে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নেবেন কি অবৈধ অর্থমালিকরা?

প্রকাশিত: ২১:৪২, ২২ জুন ২০২০

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নেবেন কি অবৈধ অর্থমালিকরা?

কাওসার রহমান ॥ প্রস্তাবিত বাজেটে এবার কালো টাকা সাদা করার সুবর্ণ সুযোগ দেয়া হয়েছে। কেউ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাকে কোন প্রশ্নই করবে না, সরকারের অন্য কোন কর্তৃপক্ষও টাকার উৎস জানতে চাইবে না। এমন সুযোগ খুব কমই পেয়েছেন অবৈধ পথে উপার্জিত অর্থের মালিকেরা। ফলে এবার সরকারের দেয়া সেই ‘সুবর্ণ সুযোগ’ কী গ্রহণ করবেন কালো টাকার মালিকেরা? সফল হবে কী সরকারের দেয়া এবারের সুবর্ণ সুযোগ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বহুবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোনবারই আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে শেয়ার বাজারে বা আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কিছু কালো টাকা সাদা হলেও কোনবারই কালো টাকার মালিকেরা তাদের অবৈধ উপার্জিত টাকা সাদা করার মাধ্যমে শিল্প খাতে কোন বিনিয়োগ করেননি। ফলে এতবার সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও দেশে কালো টাকা সাদা করার পরিমাণ খুবই নগণ্য এবং এ সুযোগ থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও খুবই কম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অর্থ বিভাগ সূত্রে দেখা যায়, এ পর্যন্ত দেশে ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। ওই দুই অর্থবছরে প্রায় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ওই সুযোগ নিয়ে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা বৈধ করেছিল। আর এ যাবতকাল মোট সাদা হয়েছে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং তার বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। বর্তমান সরকারের আমলেই ২০১২-১৩ সালে জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার একটা স্থায়ী নিয়ম তৈরি করা হয়। যা এখনও চালু আছে। পাশাপাশি আয়কর আইনে নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা ও কর দিয়ে পুঁজি বাজার ও আবাসন খাতে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ আছে। এমনকী পুরনো একাধিক বছরের কালো টাকা সাদা করারও সুযোগ আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কালো টাকা একটি বড় ইস্যু। ছোট চাকরি করলেও বিলাসী জীবনযাপন করেন অনেকে। ছেলেমেয়েদের অভিজাত স্কুলে পড়ান, বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন। দামি গাড়ি চালান। ঘুষ-দুর্নীতিসহ অবৈধভাবে উপার্জন করা অর্থসম্পদ নামে-বেনামে নানা পন্থায় লুকিয়ে রাখেন তাঁরা। সরকারও মাঝেমধ্যেই তাঁদের সেই টাকা মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে ‘সাদা’ করার সুযোগ দেয়। কখনো ঢালাও সুযোগ, কখনো শর্ত সাপেক্ষে সুযোগ। কিন্তু সরকারের দেয়া এ ধরনের সুযোগকে খুব বেশি কাজে লাগান না কালো টাকার মালিকেরা। তারপরও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আগামী এক বছরের (জুলাই, ২০২০-জুন, ২০২১) জন্য ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিলেন। এবার আর কোন শর্ত নয়। কারও কাছে নগদ টাকা থাকলেও তা সাদা করা যাবে। এতদিন যে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা নগদ টাকা ‘বালিশের নিচে’ পাওয়া যেত, সেই টাকাও সাদা হবে। ব্যাংকে থাকা টাকার পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোন সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা অবৈধ টাকাও ঘোষণায় আনা যাবে। শুধু বার্ষিক আয়কর বিবরণীতে ওই টাকা প্রদর্শন করে ১০ শতাংশ কর দিলেই চলবে। কেউ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোন শেয়ারে কালো টাকা বিনিয়োগ করতে চাইলে তা কমপক্ষে তিন বছরের জন্য করতে হবে। কারণ, তিন বছরের লক ইন বা বিক্রয় নিষেধাজ্ঞার শর্তে এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। এত দিন ফ্ল্যাট কেনায় এই সুযোগ ছিল। এখন নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে জমি কেনাতেও এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। এবার করোনা পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের স্বার্থে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন। অর্থমন্ত্রীর মতে, ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি টাইম রিকয়্যারস এক্সট্রা অর্ডিনারি মেজারস’ অর্থাৎ বিশেষ সময়ে বিশেষ উদ্যোগের দরকার। অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন, এতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং রাজস্ব বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে এমন সুযোগে কখনোই খুব বেশি সাড়া মেলেনি। প্রায় সব সরকারই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। এ পর্যন্ত দেশে ১৫ বারের মতো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি সাদা করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগ নিয়েছিল। এছাড়া ২০০৯-১০ অর্থবছরেও বড় অঙ্কের প্রদর্শিত অর্থ সাদা হয়েছে। তখন ১ হাজার ৯২৩ ব্যক্তি প্রায় এক হাজার ২১৩ কোটি টাকা সাদা করেছিল। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, কালো টাকার মালিকদের কাছে টাকা সাদা করার চেয়ে বিদেশে পাচার করলে বেশি লাভ। এ ছাড়া যদি কখনও তালিকা প্রকাশ করা হয়, তাহলে সামাজিকভাবে তাদের হেয় হওয়ার শঙ্কাও থাকে। এসব কারণেই দেশ থেকে প্রতিবছর বড় আকারে অর্থ বিদেশে পাচার হলেও বড় আকারে কখনও সাদা হয় না। আর শিল্প খাতে বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে কর্মসংস্থান হয় না। বড়জোর কিছু কালো টাকা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ হয়, আর কিছু বিনিয়োগ হয় ফ্ল্যাট কেনায়। ফলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ প্রদান সৎ করদাতাদের প্রতি এক ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ। কারণ, একজন করদাতা বৈধভাবে ২০ লাখ টাকার করযোগ্য আয় করলে তাকে সব মিলিয়ে প্রায় ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা কর দিতে হবে। আর একজন ব্যক্তি যদি দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত ২০ লাখ টাকা এখন সরকারের দেয়া সুযোগে সাদা করেন, তাহলে তাকে মাত্র ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। অর্থাৎ ২ লাখ টাকা কর দিয়েই ২০ লাখ টাকা সাদা করে ফেলতে পারবেন তিনি। তার মানে, সৎ করদাতাদের চেয়ে ৯৫ হাজার টাকা কম কর দিয়ে অবৈধ অর্থ বৈধ করে ফেলতে পারবেন ওই টাকার মালিক। তাই অর্থনীতিবিদরা সব সময় এ ধরনের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন সব সময়। বাংলাদেশের কালো টাকার পরিমাণ ঠিক কত তার কোন আনুষ্ঠানিক হিসাব নেই। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে একবার একটি সমীক্ষা করা হলেও তা বাস্তবসম্মত না হওয়া প্রকাশ করা হয়নি। বিশ্বব্যাংকের ২০০৫ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০০২-০৩ সালে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল মোট জিডিপির ৩৭.৭ শতাংশ। আর দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির করা অদৃশ্য অর্থনীতি শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, এটি প্রতিবছর জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে এটি ওঠানামা করে। তবে কী কী উপায়ে কালো টাকা তৈরি হয় তা নিয়ে বেসরকারী পর্যায়ে কিছু গবেষণা আছে। দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবি এই কালো টাকা নিয়ে সর্বশেষ ২০১১ সালে আনুষ্ঠানিক এক গবেষণা করেছিল। তাদের গবেষণায় দেখা যায়, প্রধানত ৭ উপায়ে বাংলাদেশে কালো টাকা তৈরি হয়। ১. পেশাজীবীদের অপ্রদর্শিত আয় ॥ চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, এনজিও খাত কিংবা এমন অনেক পেশায় চাকরির বাইরেও পেশাগত চর্চার মাধ্যমে অর্থ আয়ের সুযোগ আছে। যেমন চিকিৎসকরা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। এখন কোন চিকিৎসক যদি এ থেকে পাওয়া অর্থ আয়কর রিটার্নে না দেখান তা হলে সেটি কালো টাকায় পরিণত হয়। ২. ঘুষ দুর্নীতি ॥ সেবা খাত, ক্রয় খাতে কেউ যদি ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেন তাহলে সেটি তার বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এভাবে অনেকে নগদ অর্থ উপার্জন করেন যেগুলো বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে বা অর্থনীতিতে আসে না। এ অর্থই কালো টাকা, যদিও বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে এ ধরনের অর্থ সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন অনেকে। ৩. অর্থ পাচার ॥ পাচার করা অর্থই বাংলাদেশের কালো টাকার একটি বড় অংশ বলে মনে করা হয়। দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে আবার সেই অর্থ দেশে আনার খবরও শোনা যায়। বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় দুই শ’ কোটি ডলারের মতো পাচার হয় বলে ধারণা করেন গবেষকরা। ৪. নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসা ॥ কালোবাজারি, চোরাকারবারি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার বাজারও বেশ বড় বাংলাদেশে। এসব কাজে জড়িত অর্থের পুরোটাই কালো টাকা মনে করা হয়। কারণ এগুলো বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে নিষিদ্ধ। অর্থাৎ কেউ যদি মাদক বিক্রি করে অর্থ আয় করেন তবে সেটি কালো টাকা, কারণ এগুলো আয়কর বিবরণীতে উল্লেখের সুযোগই নেই। ৫. আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং ॥ ব্যবসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা তৈরি হয় এই প্রক্রিয়ায়। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি বা রফতানির ক্ষেত্রে কাগজপত্রে অনিয়ম করে দাম বেশি বা কম দেখিয়ে করের পরিমাণ কমিয়ে আনা হয়। এর মাধ্যমে যে অর্থ সরানো হয় সেটিই কালো টাকা। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি ২০১৯ সালের মার্চে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। বর্তমান বাজার দরে (৮৫ টাকায় প্রতি ডলার) যার পরিমাণ প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। ৬. জমি ক্রয়-বিক্রয় ॥ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে জমির মূল্য সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে এসব জমি ক্রয় বা বিক্রয়ের সময় সরকার বাজারমূল্য অনুযায়ী বা সত্যিকার অর্থে যে দামে ক্রয়-বিক্রয় হয় সে দাম অনুযায়ী রাজস্ব পায় না। এভাবেই এ প্রক্রিয়াটি প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকাকে কালো তালিকায় নিয়ে যায়। ৭. বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশী পেশাজীবীরা ॥ বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীদের ত্রিশ ভাগও এখানে যা আয় করে কাগজপত্রে তা দেখায় না। তারা যে ঘোষণা দেয় সেটি তাদের আয়ের চেয়ে অনেক কম। ফলে এখানেও কালো টাকা তৈরি হচ্ছে। যা কর্মরত প্রবাসীদের দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
×