ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা মোকাবেলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট পাস ৩০ জুন

প্রকাশিত: ২১:৩৯, ২২ জুন ২০২০

করোনা মোকাবেলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট পাস ৩০ জুন

এম শাহজাহান ॥ মানুষের জীবন বাঁচাতে করোনা মোকাবেলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রস্তাবিত বাজেট পাস করা হবে। কর ও ভ্যাট কাঠামোতে বড় কোন পরিবর্তন করা হচ্ছে না। বরং করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ বাড়ানো ও তা খরচ করার সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য এ খাতে বরাদ্দ কিছু বাড়তে পারে। আগামী ৩০ জুন জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পাস করার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। জানা গেছে, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও করোনা মোকাবেলায় এবারের বাজেটে সর্বোচ্চ কর ছাড় দেয়া হয়েছে। যদিও মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটভিত্তিক সেবার ক্ষেত্রে কিছুটা ভ্যাট ও ট্যাক্স বেড়েছে এবারের বাজেটে। বিভিন্ন মহল থেকে মোবাইল ব্যবহারের ওপর কর কমানোর পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। নিত্যপণ্য চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ এবং লবণের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো হয়েছে বাজেটে। কর ছাড়ের বাজেট হওয়ায় অর্থায়ন ও বাস্তবায়নে কিছুটা চ্যালেঞ্জ যোগ হয়েছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এই চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত রয়েছেন। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে মানবিক বাজেট আখ্যা দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এবারের বাজেটে মানুষকে প্রাধিকার দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, মানুষকেই গুরুত্ব দিয়ে বাজেট দেয়া হয়েছে। মানুষ না থাকলে বাজেট কার জন্য? করোনার সংক্রমণ থেকে মানুষকে বাঁচাতেই হবে। তিনি আরও বলেন, অন্যবার আমরা রাজস্ব আয়ে বেশি নজর দেই। কিন্তু এবারে আগে খরচ করব। মানুষকে বাঁচাব। পরে আয়ের চিন্তা। কারণ, আমরা এখন খরচ না করলে মানুষ বাঁচবে কী করে? আর মানুষ বাঁচাতে না পারলে দেশ কার জন্য? দেশের বাজেট কার জন্য?’ তিনি সবাইকে অনুরোধ করে বলেন, আসুন সবাই আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই বাজেট পরিচালনা করি। এ বছরটি একটি ভিন্ন বছর। করোনা দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হলে সবাইকে নিয়ে কাজটি করতে হবে। এটা একদিকে অর্থনৈতিক বাজেট পাশাপাশি মানবিক বাজেট। এদিকে, চলতি বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার পাওয়া খাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। উন্নত স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য মোট ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বাজেটের বড় একটি অংশই অবশ্য খরচ হবে পরিচালন ব্যয়ে। যার পরিমাণ ১৬ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। বাকিটা মূলত ব্যয় হবে স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে। স্বাস্থ্যখাতকে এবার সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে এবং করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ বছর যে ট্যাক্সগুলো দেয়া হবে, সেটা ইনকাম ট্যাক্সের ক্ষেত্রে আগামী বছর কম হবে। এর মূল কারণ, ব্যাংকগুলো প্রফিট করেনি। অন্যান্য কর্পোরেট খাতের প্রফিট করার কোন সম্ভাবনা নেই। তারা লোকসান করছে। এই প্রেক্ষাপটে আগামী বছর কোন বিবেচনায় ৩৬ শতাংশ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরছি সেটা আমার কাছে বোধগম্য নয়। এদিকে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সবেচেয়ে বেশি ভরসা করা হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর বা মূসক-এ। মূসক থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। আয়কর থেকে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা, শুল্ক থেকে ৯৫ হাজার ২০ কোটি টাকা ও অন্যান্য খাত থেকে ১ হাজার ৪শ’ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার ৬৮ শতাংশই আশা করা হচ্ছে পরোক্ষ কর থেকে। এই অর্থবছরে যা ছিল ৬৫ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, অপ্রত্যক্ষ করের চাপ সাধারণ মানুষের ওপরেই বেশি পড়ে। এটা আদায় করা সহজ। অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে বিভিন্ন ব্যয় করতে হয়। সেই ব্যয়ের ওপর ট্যাক্স রাখা হলে সেটা আদায়ও অনেক সহজ হয়ে যায়। তিনি বলেন, মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, কীভাবে কর ফাঁকি রোধ করা যায়। প্রত্যক্ষ কর যেটা দেয়ার কথা, সেটা ঠিক মতো আসছে কিনা সেটার কঠোর নজরদারি করা প্রয়োজন। করোনা মোকাবেলায় গুরুত্ব ॥ করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় প্রস্তাবিত বাজেটে চারটি কৌশল নেয়া হয়েছে। এর বাইরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ ও জীবন বাঁচাতে বাজেটে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। শুধু করোনা মোকাবেলায় ১ লাখ ২৫ হাজার বা সোয়া লাখ কোটি টাকা ব্যয় করবে সরকার। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের কাজ শুরু হলে করোনা চিকিৎসা আরও সহজ হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাজেটের বাইরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। প্যাকেজ বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া করোনা থেকে জীবন বাঁচাতে নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য বিভাগের অনুকূলে ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দসহ আরও ১২ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ করোনা মোকাবেলায় সবমিলে সোয়া লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। চলতি বাজেটের চেয়ে প্রস্তাবিত বাজেটের বরাদ্দ বেড়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার সিংহভাগ অর্থ করোনা মোকাবেলায় ব্যয় করা হবে। এদিকে, করোনা মোকাবেলায় চারটি কৌশল হচ্ছে-সরকারী ব্যয়ের ক্ষেত্রে কর্মসৃজনকে প্রাধান্য ও বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত, ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রবর্তন যাতে অর্থনৈতিক কর্মকা- পুনরুজ্জীবিত হয় এবং দেশে-বিদেশে উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তৃতীয় কৌশলটি হলো হতদরিদ্র ও কর্মহীন হয়ে পড়া জনগণকে সুরক্ষা দেয়া ও বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা। তবে এ কৌশলটি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে করা হচ্ছে যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। জানা গেছে, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় স্বাস্থ্যবিভাগ খাতে নতুন অর্থবছরে প্রায় ১২ হাজার জনবল নিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে ২ হাজার ডাক্তার, ৬ হাজার নার্স, ৩ হাজার মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট এবং ৭৩২ জন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন। এছাড়া করোনা ঝুঁকি মোকাবেলায় দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আরও দুটি প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। ভাইরাসজনিত রোগ নির্ণয় ও এ সংক্রান্ত গবেষণার লক্ষ্যে ৩০০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ করোনা সঙ্কট দূরীকরণে নতুন জনবল নিয়োগ, গবেষণা ও প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে আসন্ন অর্থবছরে ব্যয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এদিকে, জিডিপির তুলনায় স্বাস্থ্যখাতে সবচেয়ে কম খরচ করা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ। আবার জাতিসংঘের ইকোনমিক এ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া এ্যান্ড প্যাসিফিকের (এসকাপ) ২০১৮ সালের জরিপে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যখাতে জিডিপি অনুপাতে বরাদ্দ পাওয়া এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ৫২টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য খাতের আর্থিক সুরক্ষার বৈশ্বিক প্রতিবেদনে দেখা যায় স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বে সবচেয়ে কম খরচ হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এর মধ্যে আবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। দেশের চার শতাংশ মানুষ অতিদরিদ্র হয়ে যায় স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত খরচের জন্য। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য অনেকগুলো রিফর্ম করতে হবে। এজন্য স্বাস্থ্যের বাজেট বাড়াতে হবে। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ অনেক কম। চলতি বছরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ এবং মোট বাজেট ব্যয়ের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে, আর মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ১ হাজার ৫৩৭ টাকা। এত কম টাকা দিয়ে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার সক্ষমতা নেই। সুতরাং বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
×