ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চায়না ছাতায় স্টাইলিশ হওয়ার ঝোঁক

কাঠের বাঁট আর কালো সুতি কাপড়ের সেই ছাতার দিন গেছে

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ২২ জুন ২০২০

কাঠের বাঁট আর কালো সুতি কাপড়ের সেই ছাতার দিন গেছে

মোরসালিন মিজান ॥ কত কিছু হারিয়ে গেল! হারিয়ে গেল ছাতাটাও। সেই যে কাঠের বাঁট, কালো সুতি কাপড়ের আচ্ছাদন। নেই কোথাও আজ। দেশীয় ছাতা ব্যবহারের শৈশবস্মৃতি- কখন যেন, কীভাবে যেন বিলীন হয়ে গেছে। স্টাইলিশ হতে চায়না ছাতার দিকে ঝুঁকেছে বাঙালী। অথচ কিছুকাল আগেও ছাতা মানেই ছিল দেশীয় ছাতা। ৩০ থেকে ৩২ ইঞ্চি লম্বা কাঠের বাঁট। কালো সুতি কাপড়ের ছাউনি। ২২, ২৪ কিংবা ২৬ ইঞ্চি ঘের। এর বাইরে হাতের লাঠির মতো বাঁকানো বাঁট ব্যবহারকারীর আভিজাত্যকে তুলে ধরত। আজ কিছুই তেমন দেখা যায় না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুর, বরিশালসহ দেশের হাতেগোনা কয়েকটি এলাকায় এখন দেশীয় ছাতা প্রস্তুত করা হয়। বিক্রিও হয় স্থানীয়ভাবেই। ঢাকায় ছাতা প্রস্তুত ও বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল ঠিকানা চকবাজার। পুরান ঢাকার চক, মোগলটুলি, ইমামগঞ্জ ও মিটফোর্ডের বিভিন্ন মার্কেটের ছাদ ও ভাড়া বাড়িতে চলছে ছাতা তৈরির কাজ। অল্পস্বল্প কাজ হচ্ছে কামরাঙ্গীরচরেও। সব মিলিয়ে শতাধিক ফ্যাক্টরি। অবশ্য ফ্যাক্টরি না বলে কুটির শিল্প বলাই যথার্থ। চকবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাধীনতার পর পর চকবাজারের আলাউদ্দিন ছাতার নাম ছিল সবার মুখে মুখে। কিন্তু এখন এর কোন অস্তিত্ব নেই। একই পরিণতি হয়েছে চাহিদার তুঙ্গে থাকা শফিউদ্দিন ছাতার। নওয়াব ছাতা, জাহাজ মার্কা সানোয়ার ছাতা, শরীফ ছাতা, এটলাস ছাতা, লাবনী ছাতাসহ কয়েকটি ব্র্যান্ড খুবই নাম করেছিল। ঢাকায় প্রস্তুত এসব ছাতার চাহিদা ছিল দেশব্যাপী। এগুলোর কোন কোনটি এখনও টিকে আছে। দু/একটি পুরনো কারখানায় কাজ হয়। বাকিরা কারিগরদের অর্ডার দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিদিন প্রায় ১০০ কারখানায় চলছে ছাতা তৈরির কাজ। শরীফ ছাতার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ঘুপচি ঘরের এইটুকুন কামরায় উদুম গায়ে কয়েক কারিগর ছাতা তৈরির কাজ করছেন। প্রথমে মোটা কালো কাপড় মাপ মতো কেটে নেয়া হচ্ছে। তারপর কাঠামোতে ঠিকমতো বসিয়ে সেলাই। ছোট হাতুড়ি বাটালেরও ব্যবহার হচ্ছে। সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছাতাগুলো আদি চেহারার। গঠনের দিক থেকে কোন ধরনের পার্থক্য বা পরিবর্তন আছে বলে মনে হয় না। এখানে ছাতা তৈরির কাজ তদারক করছিলেন আব্দুল মতিন। তিনি জানান, দেশীয় ছাতা অনেক মজবুত। প্রবল বাতাসেও উল্টে যায় না। পানি চুঁইয়ে ছাতার ভেতরে ঢুকতে পারে না। এর পরও চাহিদা খুব কম। এক সময় দিনে ৫০০ থেকে ১০০০ ছাতা তৈরি হতো। তাও চাহিদা মেটানো যেত না। আর এখন- দিনে ২০০ থেকে আড়াইশ ছাতা হয়। চায়না ছাতা বাজারে আসার পর এমন বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে জানান তিনি। আব্দুল মতিন বলেন, হাজারো পণ্যের মতো ছাতাও এখন চীন থেকে আমদানি করা হয়। অনেক ব্যবসায়ী আবার প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানি করে নিজেরাই তৈরি করেন। চায়না ছাতা নামেই বিক্রি হয় এগুলো। সীমিত আকারে চালু থাকা চকবাজারের পাইকারি মার্কেট ঘুরে এ কথার সত্যতা পাওয়া যায়। প্রায় সব দোকানে চায়না ছাতা। ছাতাগুলো দেখতে সত্যি সুন্দর। নানা রঙের ছাতা। সহজেই দৃষ্টি কাড়ে। গুটিয়ে নিলে বোঝাই যায় না, এটি ছাতা নাকি পানির বোতল! ছেলেরা পকেটে পুরে নিতে পারে। কর্মজীবী নারী ফেলে রাখতে পারে ভ্যানিটি ব্যাগের এক কোণে। আর দাম? একেবারে সস্তা। ১০০টাকায়ও পাওয়া যায় চায়না ছাতা। সব দেখে বুঝতে বাকি থাকে না, কেন বাইরের ছাতায় বাজার সয়লাভ হয়ে গেছে। একই অবস্থা চকবাজারের এমকে ছাতা নামের একটি পাইকারি দোকানের। হরেক রকম চায়না ছাতা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দেশী ছাতা নেই? জানতে চাইলে স্বত্বাধিকারী মজিদ আহম্মেদ অনেক খুঁজে দুটি ছাতা বের করেন। বলেন, আমরা তো এখনও দেশী ছাতাই ভাল মনে করি। কী মজবুত মাল। একসময় আমরা বানাইছি। কাস্টমাররে দিয়া শেষ করতে পারি নাই। এখন কাস্টমার চায় চায়না ছাতা। আমরা এই কারণেই বেশি বেশি রাখি। তবে ঢাকার বাইরে এখনও কিছু দেশীয় ছাতা চলে বলে জানান তিনি। খুব পুরনো ‘জাহাজ মার্কা সানোয়ার ছাতা।’ এই ছাতার শোরুমে কথা হয় হাজী মোঃ সানোয়ার মিয়ার ছেলে সিরাজ উদ্দিন দীপুর সঙ্গে। তিনি বলেন, বহু কষ্টে ব্যবসা টিকিয়ে রাখছি। দেশীয় ছাতা এখনও বানাই আমরা। তবে চায়না ছাতা বিক্রি না করলে টিকতে পারব না। নওয়াব ছাতা বলতেও কিছু এখন নেই। দোকান ভর্তি চায়না ছাতা। দোকানি সালাউদ্দিনেরও অভিন্ন বক্তব্য: সবাই চায়না ছাতা বিক্রি করে। এই জন্য আমরাও করি। ছাতা প্রস্তুত ও বিক্রয়কারী সমিতির নেতা হাজী তোফায়েল আহমেদও নিজের দোকানে চায়না ছাতা বিক্রি করেন। তবে দেশীয় ছাতা নিয়ে আলাদা এক ধরনের গর্ব আছে তার। বলেন, দেশী ছাতা একটা কিনলে কয়েক বছর ব্যবহার করা যাইত। আমরা নিজেরাও তো ব্যবহার করছি। বর্তমান বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়ে তিনি বলেন, এখন ধরেন সময় বদলাইছে। সময়ের হিসাব ধইরা কাজ করতে না পারলে টিকা যাইবো না। দেশীয় ছাতার বেলায়ও তা-ই হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। ছবির ক্যাপশন : রাজধানীর ফুটপাথে রং-বেরঙের চায়না ছাতার পসরা - জীবন ঘোষ
×