ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সাবিহা রহমান

স্প্যানিশ ফ্লু ॥ গত শতাব্দীর মহামারী

প্রকাশিত: ১৯:২১, ২২ জুন ২০২০

স্প্যানিশ ফ্লু ॥ গত শতাব্দীর মহামারী

গত শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মহামারী ছিল ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু। কোভিড-১৯ এর মহামারীতে আমরা অন্তত এতটুক জানি যে, এটা হচ্ছে সার্স সিওভি-২ নামে একটি নতুন ভাইরাস সংক্রমণের কারণে। কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লু কীসের কারণে হচ্ছে সেটাই চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কেউ ধরতে পারছিলেন না। স্প্যানিশ ফ্লুয়ের সময় চলছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই ফ্লুয়ের জন্য দায়ী ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস আবিষ্কার করতে করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলে আসে। এর নাম স্প্যানিশ ফ্লু দেখে ধারণা হতে পারে, স্পেনই হয়ত ছিল এই রোগের উৎপত্তিস্থল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। সংবাদ মাধ্যম অনেকটা অন্যায়ভাবেই এই নাম প্রচার করেছে। স্প্যানিশ ফ্লুয়ের কারণে প্রায় ৫-১০ কোটি মানুষ মারা যায়। আমেরিকায় মারা যায় ৬ কোটি ৭৫ হাজার মানুষ, যা ছিল তাদের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হওয়া সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি। ব্রিটেনে মারা যায় ২ কোটি ২৫ হাজার মানুষ। বাদ যায়নি তখনকার ইংরেজ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশও। এখানেও প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা যায়। তবে তখন মৃত্যুহার ছিল আরও ২৫ গুণ বেশি। এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, আমেরিকানদের গড় আয়ু তখন ৫১ বছর থেকে মাত্র ৩৯ বছরে নেমে আসে! সকল ভাইরাস সম্পর্কে আমরা একটা কথা জানি যে, এদের নিজেদের স্বাধীনভাবে বংশবৃদ্ধি করার উপায় নেই। এরা মানুষ বা অন্য কোন জীবদেহের অভ্যন্তরে গিয়ে তাদের কোষে প্রবেশ করে অনুলিপি তৈরি করতে থাকে। এতে সেই জীবদেহের কোষ ধ্বংস হয়ে যায়। ইনফ্লুয়েঞ্জাও তার ব্যতিক্রম নয়। স্প্যানিশ ফ্লুয়ের জন্য দায়ী ইন ফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ক্ষেত্রে মনে করা হয়, তার পৃষ্ঠে এক প্রকার প্রোটিন ছিল যা ইন্টারফেরন তৈরি করতে বাধা দেয়। ইন্টারফেরন হচ্ছে আরেক ধরনের প্রোটিন, যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়া বা ইমিউন সিস্টেমকে নির্দেশ দেয় আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা দেয়ালে বহির্শক্তির (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া) আক্রমণ ঘটেছে। ফলে ফুসফুসের যেসব কোষ রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ করে, তারা ভাইরাসের আক্রমণের শিকার হয়। ভাইরাস সেই কোষগুলোতে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। এতে কোষগুলো মরে যায়। ফলে কোষগুলো তখন আর অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে না। এই কোষগুলো তখন শরীরে কেটে যাওয়া চামড়ার ক্ষতের মতো হয়ে যায়, যা আশপাশের সুস্থ চামড়া থেকে একেবারেই আলাদা দেখায়। ১৯১৮ সালে সাউথ ক্যারোলিনায় আমেরিকান সেনাবাহিনীর প্রাইভেট রসকো ভনের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ময়নাতদন্ত করা হয়। তার ফুসফুসে নিউমোনিয়ার কারণে এ ধরনের ক্ষত দেখা যায়। এতে ধারণা করা হয়, ইন্টারফেরনের নিষ্ক্রিয়তাই মারণঘাতী ভাইরাল নিউমোনিয়ার সূচনা করেছে। অনেক গবেষক ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস সরাসরি মানুষকে খুন করেনি। মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল আসলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। তাহলে কি ভাইরাস কিছুই করেনি? না তা নয়। ভাইরাসের সংক্রমণ ও প্রতিলিপি তৈরির কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে তখন স্টেফাইলোকক্কাস, স্ট্রেপটোকক্কাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ খুবই মারাত্মক হয়ে যায়। একে বলা হয় সেকেন্ডারি ইনফেকশন। ১৯১৮ সালে ফ্লুয়ের মহামারীর সময়ও এমন সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয়েছিল মনে করা হয়। কারণ ফ্লুয়ে আক্রান্তদের ফুসফুস ভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যে অনেকখানি অকেজো হয়ে পড়েছিল। তখন ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ আরও সহজ হয়ে গিয়েছিল। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯১৮ সালে বর্তমান সময়ের মতো এ্যান্টিবায়োটিক ছিল না। ধারণা করা হয়, ফ্লুয়ে মানুষের মৃত্যু সরাসরি ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণে হয়নি। ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দুর্বল হয়ে যাওয়া শরীরে ব্যাকটেরিয়ার সেকেন্ডারি ইনফেকশনের কারণেই এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল মনে করা হয়। সাউথ ক্যারোলিনার সেই সেনিকের ফুসফুসেও সেকেন্ডারি ইনফেকশনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। আবার অনেকে দায়ি করে তখনকার পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে। এটি ছিল নতুন ভাইরাস, যার উৎস ছিল পাখি। ভাইরাস পাখি থেকে শুকর কিংবা ঘোড়ায় সংক্রমণ ছড়ায়। তারপর মানুষের শরীরে প্রবেশ করে হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এটি এমন সময়ে ছড়িয়েছিল, যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে মানুষ বস্তি বা ব্যারাকের মতো ঘিঞ্জি এলাকায় থাকত। তারা তখন ঘরের বাইরে খুব একটা চলাচলও করতে পারত না। শ্রমিক শ্রেণীর লোকরাও একই বিছানা ভাগ করে ঘুমাতে হতো। সৈনিকরা পাশাপাশি বিছানায় খুবই বদ্ধ পরিবেশে ঘুমাত এবং বিভিন্ন দেশের রণক্ষেত্রে গিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে আসত ভাইরাস। তখনকার এই পরিস্থিতিও এত মানুষ মারা যাওয়ার জন্য দায়ী। এত দ্রুত এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে না ছড়ালে ভাইরাস যতই মারাত্মক হোক, এত প্রাণ কেড়ে নিতে পারত না। ১৯১৮ এর মহামারী সম্পর্কে এখনো অনেক কিছুই আমাদের অজানা। আমরা এখনও জানি না ভাইরাসের স্ট্রেইনগুলো কেন কিছু স্তন্যপায়ীকে আক্রান্ত করে, আবার অন্যদের করে না। আমরা জানি না ভাইরাসটা নতুন ভাইরাস ছিল, নাকি পুরনো ভাইরাসেরই নতুন সংস্করণ মারণঘাতী রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছিল। আমরা এখনও জানি না, কেন ১৯১৮ এর ভাইরাস যুবকদের মধ্যে মারণঘাতী হয়ে উঠেছিল। ১৯১৮ সালের পর এই ফ্লু ভাইরাসের কী হয়েছিল, কোথায় গিয়েছিল, কেনই বা পরে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল এসব কিছুই জানি না আমরা। এই তথ্যগুলো জানতে পারলে হয়ত আমরা এত বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণ হারানোর সঠিক কারণ জানতে পারব। একই সঙ্গে এই ভাইরাস পরবর্তীতে আবার দেখা দেবে কিনা বা তার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারব কিনা সেসবও জানতে পারব।
×