ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কঠোর লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বাড়বে

বিশ দিনেই আক্রান্ত ৬১ হাজার ৭০২, মৃত্যু ৭৭৫ জনের

প্রকাশিত: ২২:২৫, ২১ জুন ২০২০

বিশ দিনেই আক্রান্ত ৬১ হাজার ৭০২, মৃত্যু ৭৭৫ জনের

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশে প্রায় সাড়ে তিন মাসে শনাক্ত হয়েছেন এক লাখ আট হাজার ৭৭৫ জন করোনা রোগী। এর মধ্যে চলতি মাসে অর্থাৎ গত ২০ দিনেই কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই সময়ে মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬১ হাজার ৭০২ জন। অর্থাৎ মোট আক্রান্তের মধ্যে গত ২০ দিনেই হয়েছে অর্ধেকের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা এক হাজার ৪২৪ জন। এর মধ্যে গত ২০ দিনেই মারা গেছেন ৭৭৫ জন। অর্থাৎ এক জুন থেকে ২০ জুন পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকের বেশি। গত টানা প্রায় ১২ দিন রোগীর সংখ্যা হয়েছে তিন হাজারের বেশি। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন প্রায় ৪৪ হাজার মানুষ। ১৭ কোটি মানুষের মানুষের মধ্যে মোট পরীক্ষা হয়েছে পাঁচ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭৯ জনের। মৃত্যুর হার এক দশমিক তিন ভাগ। সুস্থতার হার ৪০ ভাগের বেশি। আইসোলেশনে রয়েছেন ৫৮ ভাগের বেশি মানুষ। আক্রান্ত ও মৃত্যু হার বিশ্লেষণে বৈশ্বিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশ ১৭তম। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোর লকডাউন ও স্বস্থ্যবিধি মেনে চললে চলতি মাসের শেষের দিকে সংক্রমণ কমতে পারে। অন্যাথায় আরও বাড়বে। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহান প্রদেশ থেকে করোনাভাইরাসের উৎপত্তি। পর্যায়ক্রমে এই ভাইরাস গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে মহামারীতে রূপ নেয়। গোটা পৃথিবী কাবু প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের ছোবলে। দিন দিন ফণা বাড়াচ্ছে কোভিড-১৯। আক্রান্ত দুনিয়ার ২১৫টি দেশ ও অঞ্চল। প্রতিষেধক আবিষ্কারে মরিয়া বিজ্ঞানীরা। কিন্তু এখন পর্যন্ত আশার তেমন বার্তা নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একমাত্র টিকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই প্রাণঘাতী এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও আক্রান্ত করোনায়। গত আট মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার যা সাত বারের মতো বাড়িয়ে ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়। এর মধ্যে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকে গণপরিবহন। অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার কথা বলে ৩১ মে থেকে সাধারণ ছুটি তুলে নিয়ে চালু হয় গণপরিবহন। তখন থেকেই মূলত করোনার সংক্রমণ ছিল বাড়তি। যদিও সাধারণ ছুটি তুলে নেয়া ও গণপরিবহন চালুর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা এও আশঙ্কা করেছিলেন, এর ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যু হার বেড়ে যেতে পারে। তাই হয়েছে। প্রতিরোধে এখন সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়ানো ঢাকা মহানগরীতে এলাকাভিত্তিক রেড জোন ঘোষণা করে লকডাউন করার চিন্তা করছে সরকার। পাইলট প্রকল্প হিসেবে রাজাবাজারে লকডাউন চলছে ১৪ দিনের জন্য। এর বাইরে আরও ৪৫টি এলাকা রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যু হার বিবেচনায় সারাদেশকে লাল, হলুদ ও সবুজ এই তিন জোনে ভাগ করা হয়েছে। রেড জোন হিসেবে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদী ঘোষণা হলেও সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। সব মিলিয়ে রাজধানীর ৪৫টি, ঢাকার বাইরের তিন জেলার ২০টি মিলিয়ে ৬৫টি এলাকা রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এসব এলাকায় সাধারণ ছুটি কার্যকর করা হবে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, সংক্রমণ রোধে জোন ভিত্তিক কার্যক্রম খুব একটা ফল দেবে না। এজন্য প্রয়োজন সারাদেশে একযোগে লকডাউন ঘোষণা। যা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে সংক্রমণের মাত্রা কমতে পারে। বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা ॥ দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ হাজার ২৪০ জন কোভিড রোগী শনাক্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে আরও ৩৭ জনের। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা শনিবার করোনাভাইরাস পরিস্থিতির এই সর্বশেষ তথ্য অধিদফতরের বুলেটিনে তুলে ধরেন। তিনি জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ৬১টি পরীক্ষাগারে ১৪ হাজার ৩১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৫৭৯টি। নতুন ৩ হাজার ২৪০ জনকে নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৭৭৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের শুরুর দিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ৩৮১ জন, মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। দুই জুন ৩৭ মৃত্যু ও আক্রান্ত দুই হাজার ৯১১ জন, তিন জুন ৩৭ মৃত্যু ও আক্রান্ত দুই হাজার ৬৯৫ জন। চার জুন ৩৫ জনের মৃত্যু ও দুই হাজার ৪২৩ জন আক্রান্ত হন। পাঁচ জুন ৩০ জনের মৃত্যু ও দুই হাজার ৮২৮জন আক্রান্ত হয়েছেন। ছয় জুন ৩৫ জনের মৃত্যু দুই হাজার ৬৩৫ জন নতুন করে আক্রান্ত হন। সাত জুন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ ও আক্রান্ত দুই হাজার ৭৪৩ জন। পরদিন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল একই, আক্রান্ত কিছুটা কমে হয় দুই হাজার ৭৩৫জন। নয় জুন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয় ৪৫ ও আক্রান্ত তিন হাজার ছাড়িয়ে দাঁড়ায় তিন হাজার ১৭১ জন। ১০ জুন ৩৭ মৃত্যু ও আক্রান্ত বেড়ে হয় তিন হাজার ১৯০ জন। ১১জুন ৩৭ মৃত্যু ও আক্রান্ত তিন হাজার ১৮৭ জন, ১২জুন মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ জনে, আক্রান্ত হয় তিন হাজার ৪৭১জন। ১৩ জুন মৃত্যু ৪৪ ও আক্রান্ত দুই হাজার ৮৫৬ জন। ১৪জুন ৩২ মৃত্যু ও আক্রান্ত তিন হাজার ১৪১ জন, ১৫ জুন ৩৮ মৃত্যু ও আক্রান্ত তিন হাজার ৯৯জন। ১৬ জুন সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ৫৩ জনের ও আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় তিন হাজার ৮৬২ জনে। ১৭ জুন ৪৩ মৃত্যু ও আক্রান্ত চার হাজার ৮৮, ১৮ জুন আক্রান্ত ৩৮ ও মৃত্যু তিন হাজার ৮০৩, ১৯ জুন মৃত্যু ৪৫ ও আক্রান্ত তিন হাজার ২৪৩ জন। কোভিড-১৯ নিয়ে আয়োজিত নিয়মিত বুলেটিনে (১৮ জুন) স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, বাংলাদেশ একটি জনবহুল এবং অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, অপর পক্ষে করোনাভাইরাসও অত্যন্ত ছোঁয়াচে ভাইরাস। এ কারণে অসতর্ক চলাফেরা এবং স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে না চললে এ দেশে সংক্রমণের হার মোকাবেলা করা কঠিন। তিনি আরও বলেন, দেশের করোনাভাইরাস আগামী এক-দুই বা তিন মাসে যাবে না। জনস্বাস্থ্যবিদদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারের করোনা বিষয়ক কমিটির প্রধান ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শাহ মুনির হোসেন বলেন, সংক্রমণ উপরের দিকে যাচ্ছে, তবে পিকে আছি কিনা সেটা কেউ বলতে পারবে না। তবে গত কয়েক দিনের রোগী শনাক্তের হার বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে আগামী আট থেকে ১৫ দিন এরকম চলতে পারে। এ মাসের শেষ দিক নাগাদ রোগী দেড় লাখ ছাড়িয়ে যাবে এবং এ মাসের শেষের দিকে সংক্রমণ কমতে পারে বলে ডাটা বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেয়া না হলে রোগী বাড়তেই থাকবে বলেও মন্তব্য করেন শাহ মুনির। তিনি বলেন, জুন মাসের প্রথম দিকে সংক্রমণ কমতে থাকে বলে মনে হলেও আজকের অবস্থা হয়েছে ঈদের ছুটির কারণে। আর এখন যদি কঠোর লকডাউন না করা হয়, স্বাস্থ্যবিধি না মানা হয় তাহলে সংক্রমণ আবার বাড়বে।
×