ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আশরাফ সিজেল

করোনাকালে ফেসবুক ও হুজুগে বাঙালী

প্রকাশিত: ২১:০৬, ২১ জুন ২০২০

করোনাকালে ফেসবুক ও হুজুগে বাঙালী

টেলিভিশনে কাজ করার সময় নারী দিবসের একটি প্রতিবেদন করতে হবে। ময়মনসিংহ ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলে যাই সকালে। নৌকায় করে চরে গিয়ে ভাড়ায় মোটরসাইকেলে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে যাওয়ার পর কৃষিজীবী নারীদের খোঁজ পেলাম। কয়েক ব্যক্তি বললেন, চলে যান দ্রুত। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বললেন, সরকার বিভাগীয় শহরের অবকাঠামোর কাজ করতে এ অঞ্চলের জমি অধিগ্রহণ করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে স্থানীয়রা আন্দোলন করছেন চরাঞ্চলে বিভাগীয় শহরের অবকাঠামো হতে দেবেন না। এলাকাবাসীর ধারণা, আপনারা ক্যামেরা নিয়ে ম্যাপ করতে এসেছেন। তাই দ্রুত এলাকা না ছাড়লে বিপদে পড়বেন। আমি চেষ্টা করেও বুঝাতে পারিনি। তাই কাজ না করেই ফিরতে শুরু করলাম। আসার সময় দেখলাম সত্যিই লোকজন জড়ো হচ্ছে, কারও কারও হাতে রাম দা, বল্লম ও লাঠিসহ দেশীয় অস্ত্র। মোটরসাইকেল চালক বললেন, মনে হয় বিপদে পড়ে যাবেন। যাক সাহস করে বাইক ছাড়তে বললাম। রাস্তা যেন শেষ হয় না। যাক কোন রকম নদের পাড়ে পৌঁছলাম। নৌকার জন্য অপেক্ষা করার সময় একজন মোবাইলে বললেন, না গেলে সত্যি বিপদে পড়তেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছে এর আগেও। পরে অন্য উপজেলার চরাঞ্চলে গিয়ে নারীদের মজুরী বৈষম্য নিয়ে কাজ করতে হলো। পরে ওইদিনের ঘটনাটি শুনে স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি বললেন, এই অঞ্চলে হুজুগে অনেক সময় ঘটনা ঘটে। এসব হুজুগের মানুষ কিছু বুঝতেই চাইবে না। ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে। কিছু ঘটনার কথাও শুনালেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন নিয়ে পুরনো এ বিষয়টি লেখার কারণ, বাঙালীর ‘হুজুগ’ বিষয়ে নানা ঘটনা নিয়ে কয়েক শ’ পাতার কয়েকটা সংকলন বের করা যাবে নিশ্চয়। বাঙালীর হুজুগ নয়, গুজব নিয়ে প্রাচীনতম গল্পটা হয়ত অনেকেই জানেন। রানী মা মৃত যমজ সন্তান প্রসব করেছেন। গুজবের ডালপালায় ভর করে দূরতম প্রজার কাছে এই সংবাদ এইভাবে পৌঁছাল যে রানী মা এক জোড়া কালো কাক প্রসব করেছেন! প্রসবের পরপরই ওড়ার চেষ্টা করায় কাক দুটির মৃত্যু হয়েছে। কালো সেই কাক দেখার জন্য প্রজারা দলে দলে ভিড় জমাতে লাগল রাজমহলের আশপাশে। ২০১৯ সালের নবেম্বরে গুজব ছড়িয়ে পরে যে লবণের দাম বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। দেশবাসী হুজুগের বশবর্তী হয়ে লবণ কিনতে থাকে কিন্তু একদিন পরেই জানা যায় লবণের দাম আদৌ বাড়েনি এবং মজুদ আছে প্রচুর। শুধুমাত্র হুজুগ বাঙালীকে টেনে নিল বাজারের দিকে। কিন্তু চলমান বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাসের সময় ফেসবুকে গেলে দেখা যাচ্ছে হুজুগের বাঙালী এখানেও কম না! অনেক সময় দেখা যায়, ইতিবাচক অনেক সংবাদ কোন গণমাধ্যমের পেজে প্রকাশিত হলে মন্তব্য হচ্ছে খুবই নেতিবাচক। আমি দেখলাম, নেতিবাচক মন্তব্য করা ফেসবুক আইডিগুলো ফেক। খুবই রহস্যময় এসব আইডি থেকে একটা ইতিবাচক সংবাদ বা তথ্যকে ফেক আইডি থেকে নেতিবাচক মন্তব্য করার যে স্রোত তাতে মনে হয়, ভাল অর্জনের বিষয়টি সাধারণ মানুষের মাঝে পরিকল্পিত নীতিবাচক বুঝানোর অপচেষ্টা। তা নাহলে ফেক আইডি থেকে কেন সফল অর্জন বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়। ফেসবুক ব্যবহারকারী অনেককেই পাগলের মতো কপি পেস্ট করতে দেখা গেছে। অনেকেই শেয়ার দেন গুজব বা হুজুগ বিষয়ক লেখা । চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে টাইপ গুজব আর মানুষের চাঁদ দেখার হুজুগ মাঝেমাঝেই যেন ফিরে আসে। যে চাঁদ সাধারণ মানুষ কিনতে পারে না বা যেখানে তারা যেতে পারে না, সেই জায়গাটার দখল নেয় অন্ধ বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের কারণে বাজার থেকে চাল, লবন, পেঁয়াজ কেনার মতো মাজার থেকে পড়া পানি কিংবা তাবিজ কেনে মানুষ! করোনাকালে ঘরবন্দী মানুষের এই হুজুগ চলে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। করোনা শুরু হওয়ার সময় দেখেছি, তাবিজ কবজের প্রশংসাও পাওয়া গেছে ফেসবুকে! কোন পীরের কোন তাবিজে বা আংটিতে কার কী উপকার হয়েছে সেই বর্ণনা কিংবা বিজ্ঞাপনও । হুজুগ ছাড়া আমাদের চলে না। বজ্রপাতে কেউ মারা যায় তখন সেসব লাশ নাকি কবর থেকে চুরি হয়ে যায়, চড়া দামে বিক্রি হয়। সীমান্ত পিলার নিয়েও এমন গুজব ছিল। সীমান্ত পিলারের নিচে নাকি ইউরেনিয়াম থাকে তাই সেসব নাকি চোরাচালাানদের মাধ্যমে বিক্রি হয়। এই হুজুগ নিয়ে কত মানুষ যে ঘুরে বেরিয়েছে, কতজন যে গ্রেফতার হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অনেকে জমি জমা হারিয়ে ফতুরও হয়েছেন। করোনাকালে গেল কয়েকদিন ধরে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছে অক্সিজেন সিলিন্ডার। কোভিড-১৯ সংক্রমিতদের মধ্যে মাঝারি উপসর্গ বহনকারী রোগীদের অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। সংক্রমিত অনেকে বাসায় বসেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাই অনেকেই কিনছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার। কিন্তু অভিযোগ আছে ৫ থেকে ৮ বা ১০ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডার। নিম্ন ও মধ্য নিম্ন বিত্তরাও ৩০ বা ৪০ হাজার টাকা দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু করোনা আক্রান্ত রোগীদের কিভাবে এই অক্সিজেন ব্যবহার করা হবে, তার কোন নিয়ম কি চিকিৎসকরা দিচ্ছেন। তাহলে করোনা দেশে প্রথম শুরু হওয়ার পর দ্রব্যমূল্য ক্রয় করার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, এখন চলছে ওষুধপত্র এবং সর্বশেষ অক্সিজেন সিলিন্ডার। ফেসবুকে মারা যাওয়ার সংবাদ কে কার আগে পোস্ট করবেন, তার প্রতিযোগিতা চলছে। এক সময় হুজুগে পাখায় ভর করে বাড়তে থাকে কয়েনের দাম, এক টাকার কয়েনের দাম বাড়তে বাড়তে তিনশত টাকায় গিয়ে ঠেকে! পরে সরকারী ঘোষণার মাধ্যমে এই গুজব থামানো হয় এবং বাঙালীর এক টাকার কয়েন কেনার হুজুগ থামে। কিছুদিন আগে সুরাইয়া গুজব তো ফেসবুকময় ছিল। চাঁদে সুরাইয়ার মুখ দেখতে পাওয়ার কিংবা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা লাগবে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। সোশ্যাল মিডিয়া বা ফেসবুকে একজন যে বিষয়টি পোস্ট করলেন, তার কপি করার যে প্রবণতা তাতে হুজুগের বাঙালী না বলার অপেক্ষা রাখে কি? দ্রব্যমূল্য, ওষুধ বা অক্সিজেন সিলিন্ডার কম দামে কিনে রাখছেন লাভবান হয়ে ওঠার জন্য, নতুবা নিজে বাঁচার জন্য। কিন্তু একজন জরুরী রোগীর জরুরী ওষুধ বা অক্সিজেন পাবার দরকার, কিন্তু আপনার হুজুগে তা সম্ভব হচ্ছে না নিশ্চয় । বাংলাদেশের গুজব আর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের কারণে প্রায়শই ধ্বংসস্তূপের ভেতরে থাকে! পথে বসে যায় সাধারণরা! হুজুগ নিয়ে বাঙালীর পথচলা। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে হুজুগের পেছনে দৌড়ানোর অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে আমাদের। মানুষ মাত্রই কমদামে তাদের প্রিয় পণ্য কিনতে চায়। কেউ লাভ আর কেউ কেউ নিজ প্রয়োজনে জমিয়ে রাখতে চায় পণ্য। কেউ কেউ অন্যদের দেখে হুজুগে মাতে। বহু বছর ধরে এমন চলে আসছে। চাইলে বা চেষ্টা করলেও কী এর থেকে পরিত্রাণ সম্ভব? আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, ২০ জুলাই ২০১৯ তারিখে চার বছরের সন্তান তুবাকে ভর্তির জন্য রাজধানীর বাড্ডার একটি স্কুলে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন তাসলিমা বেগম রেণু। কিন্তু ফিরলেন লাশ হয়ে। তুবা’কে আর স্কুলে ভর্তি করাতে পারলেন না রেণু। ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে মুহূর্তেই ঝরে গেল একজন মায়ের প্রাণ। ‘পদ্মা সেতু নির্মাণে মাথা লাগবে’- এমন গুজবে সারাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এ গুজবে অনেকেই গণপিটুনির শিকার হয়েছেন। মারা গেছেন প্রায় ৯ জন। একই বছর ১৮ জুলাই নেত্রকোনায় ব্যাগে করে এক শিশুর ছিন্ন মাথা নিয়ে পালানোর সময় মাদকাসক্ত এক যুবককে (২৮) ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনিতে হত্যা করে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ ঘটনার পর থেকেই ছেলেধরা’ গুজবে গণপিটুনির খবর আসতে থাকে সারাদেশ থেকে। অনাকাক্সিক্ষত গণপিটুনিতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নারী যারা রাস্তা-ঘাটে, শপিংমলে বাচ্চা দেখলে আদর করে তারাও আতঙ্কগ্রস্ত বলে নিজেদের মতপ্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কেউ কেউ লিখছেন, ‘আমাকে মারতে চাইলে ছেলেধরা বলে চিৎকার দাও’। বাস্তবে মানুষ এই ‘ছেলেধরা’ গুজবকে কাজে লাগিয়ে পূর্ব শত্রুকে হত্যাসহ মারধর করার অনেক সংবাদ গণমাধ্যমে দেখা গেছে। কি ভয়ঙ্কর সংবাদ! প্রবাদে আছে, হুজুগের বাঙালীর কাছে গুজব বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশ কিংবা উপমহাদেশে ‘গুজব’ বা ‘গণপিটুনি’ নতুন ধারণা নয়। যুগ যুগ ধরে কুসংস্কারাছন্ন জাতির মস্তিষ্কে এ ধারণা বিরাজ করছে। গুজবে বিশ্বাসী হুজুগে বাঙালীর কর্মকান্ড নিয়ে বহু আগে থেকেই এদেশে সাহিত্য রচিত হয়েছে। করোনাকালীন সময়ে ফেসবুকে গেলে দেখা যায়, সবাই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। একটি ছবি অনেক কথায় বলে। যেমন, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বাবা করোনাতে আক্রান্ত হয়ে খুব শ্বাসকষ্টে। সন্তান নিজের বুকে বালিশ রেখে সারাটা রাত এভাবেই বাবাকে একটু শান্তিতে শ্বাস নিয়ে ঘুমাতে সহায়তা করতে করতে কখন যে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে গেছে! কিন্তু ফেসবুকে এ রকম মানবিক অনেক বিষয় আমরা পোস্ট করি না। যখন গণমাধ্যমে দেখালাম বিশ্ব করোনা মহামারীর সময় ক্রান্তিকালে চট্টগ্রামে এক মিনিটের বাজার বসিয়ে কর্মহীন দরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে সবজিসহ নিত্যপণ্য দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্যরা। ময়মনসিংহের ভালুকায় প্রত্যন্ত গ্রামে সেনাবাহিনীর চিকিৎসা সহায়তা কেন্দ্র প্রত্যক্ষ করলাম। দেখেছি, নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলে কাঁধে করে অসহায়দের কাছে ত্রাণ পৌঁছিয়ে দিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় গর্ভবতী নারীদের জন্য সেনাবাহিনীর জরুরী চিকিৎসাসেবা সহায়তা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখে আনন্দিত হই। বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরা অসহায়ের পাশে কত কষ্ট করে ত্রাণ কার্যক্রাম পরিচালনা করছেন, তখন দেখতে ভালই লাগে। করোনা আক্রান্তদের লাশ দাফনে পুলিশের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়। ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্য কর্তব্য পালন অবস্থায় একজন অসহায় নারীকে নিজের মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেয়ার মাত্র এক মিনিটের মানবিক ভিডিওটি অনেক কথাই বলে নিশ্চয়! বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর ফেসবুকে নানা হুজুগের বাঙালীর গুজব দেখা গেছে। এখনও চলমান। গৃহবন্দী থেকে অনেকে নানা রকম তথ্যনির্ভর ছাড়া লেখা কপি পেস্ট করছেন। একটু তথ্য যাচাই করে ফেসবুকে শেয়ার বা কপি করেন। এমনিতেই আমরা যে পরিমাণ হুজুগের মানুষ, সেখানে গুজব বা ভুল তথ্য অনেক ক্ষতি করে। আসুন সবাই ফেসবুকে এই বৈশ্বিক দুর্যোগে হুজুগে যেন গুজব না ছড়াই! লেখক : গণমাধ্যমকর্মী [email protected]
×