ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ১৯ জুন ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

(গত শুক্রবারের পর) প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন : তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার আছে, তোমাদের ওপরও তাদের তেমনি অধিকার আছে (তিরমিযী)। তিনি আরও বললেন, তোমরা যা খাবে, তোমরা যা পরবে তোমাদের স্ত্রীদেরও তা খেতে-পরতে দেবে। (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজা)। সকল প্রকার জিনা অর্থাৎ নারী-পুরুষের অবৈধ মিলন তথা ব্যভিচারকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার মাধ্যমে উপপত্নী ও রক্ষিতা রাখার কুপ্রথাকে উৎখাত করা হয় এবং কাদের সঙ্গে বিবাহ হতে পারবে ও কয়টা পর্যন্ত বিয়ে কোন শর্ত সাপেক্ষে হতে পারে তা স্থির করে দিয়ে প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারী সমাজের মর্যাদা ও সম্মানকে যেমন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন তেমনি পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শক্ত বুনিয়াদ নির্মাণ করে দেন। ফলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সুশৃঙ্খল জীবনবোধের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে যায়। স্ত্রী ও স্বামী দৈহিকভাবে আলাদা দুটি সত্তা হলেও তারা দুইয়ে মিলে এক আত্মা- এই চেতনা দান করেছেন প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : এবং তাঁর (আল্লাহর) নির্দেশনাবলীর মধ্যে রয়েছে : তিনি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনীদের যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং (আল্লাহ) তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন, (সূরা রুম : আয়াত ২১)। তিনিই (আল্লাহ্) তোমাদের এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন ও তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন যাতে সে তার নিকট শান্তি পায় (সূরা আরাফ : আয়াত ১৮৯)। এই দুইখানি আয়াতে কারিমাতে বলা হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন যাতে করে সুখী দাম্পত্য জীবন গড়ে ওঠে এবং পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় হয়। এতে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক এবং পরস্পরের প্রীতি বন্ধন যত মজবুত হবে দাম্পত্য জীবন তত সুখী-সুন্দর হবে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীকে মনে করা হতো পাপের মূল উৎস এবং কোন কোন ধর্মে তো বলাই হয়েছে নারী হচ্ছে শয়তানের ফাঁদ। আর প্রিয়নবী (সা) এসে ঘোষণা করলেন যে, তারা পরস্পর পরস্পর থেকে। সংসার জীবনে নারী-পুরুষের মর্যাদা একই রকম। গৃহে স্ত্রীর অবস্থান একজন সম্রাজ্ঞীর মতো। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমাদের সবাই এক একজন শাসক (রা’ঈ) এবং প্রত্যেকেই তার নিয়ন্ত্রণাধীনদের (রায়ত) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। আমীর (রাজা) হচ্ছে দেশের শাসক আর পুরুষ হচ্ছে পরিবারের শাসক। নারী হচ্ছে তার স্বামী ও সন্তানদের শাসক, সুতরাং তোমরা প্রত্যেককেই শাসনকর্তা এবং প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে (বিচার দিনে) তোমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনদের সম্পর্কে (বুখারী শরীফ)। স্ত্রী-পুরুষের শাদি বন্ধনের বেলায় স্ত্রীর অধিকার নিশ্চিত করা, সম্মতি গ্রহণ করা এবং মহৎ প্রভৃতি বিষয় যেমন স্থির করে দেয়া হয়েছে, তেমনি কোন কারণবশত বিবাহ বিচ্ছেদের বা তালাকের অবস্থা সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে উভয়ের অধিকার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তালাককে বিশেষ জটিল অবস্থার প্রেক্ষিতে বৈধ করা হলেও এই অবস্থার সৃষ্টি যাতে না হয় সে জন্য প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : একটি জিনিস আইনসম্মত হলেও আল্লাহ পছন্দ করেন না তা হচ্ছে তালাক। (আবু দাউদ)। কুরআন মজিদে তালাককে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : তোমরা যদি তাদের (স্ত্রীদের) অপছন্দ কর তবে এমনটা হতে পারে যে, আল্লাহ্্ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ। (সূরা নিসা : আয়াত ১৯)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে নারীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করার কোন ন্যায়সঙ্গত নীতিমালা ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে বঞ্চিত হতো। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামই সর্বপ্রথম নারীকে পুরুষের সহশরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং মৃতের সম্পত্তির হিস্যাদার হিসেবে তার অধিকার নিশ্চিত করলেন। তিনি উত্তরাধিকারী বিষয়ক যে বিধিবিধান প্রদান করলেন তাতে অগ্রগণ্য যে বারোজন উত্তরাধিকারী স্থির করা আছে তার মধ্যে আট জনই হলো নারী। কুরআন মজিদে মৃতের সম্পত্তিতে নারীর অধিকার সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : পিতা-মাতা এবং আত্মীয়স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীরও অংশ আছে, তা অল্পই হোক অথবা বেশিই হোক, এক নির্ধারিত অংশ (সূরা নিসা : আয়াত ৭)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম যে ব্যবস্থা দিলেন তাতে নারী পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলো। শুধু তাই নয়, সে সন্তানের সম্পত্তিরও উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করেছে। সে উত্তরাধিকারী সূত্রে সে সম্পত্তি পায় তার ওপর তার স্বত্বাধিকারিত্ব অটুট থাকে। তার মৃত্যুর পর সে সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করে তার ওয়ারিশগণ। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারীর যে অধিকার নিশ্চিত করলেন তাতে তার উপার্জন করার অধিকারও দেয়া হয়েছে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারীদের সঙ্গে অত্যন্ত নরম ব্যবহার করতে নির্দেশ দিলেন। একবার সস্ত্রীক তিনি সফরে ছিলেন। তিনি যে উটের কাফেলায় এই সফর করছিলেন সেই কাফেলার অগ্রভাগে আন্্জশা নামে এক কাফ্রী গোলাম উটগুলোর চলার গতি বাড়াবার জন্য দরাজ কণ্ঠে উট চালানো গীত গাইছিল। উটগুলো অতি দ্রুতগতিতে অগ্রসর হওয়ায় ঝাঁকুনিতে কাফেলার মহিলাদের ভীষণ অসুবিধা হচ্ছিল। তখন তিনি আন্্জশাকে ডেকে বললেন : কাঁচ যাতে ভেঙ্গে না যায়, আন্্জশা তুমি সেদিকে খেয়াল রেখ। এই কাঁচ বলতে প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারীগণকে বুঝিয়েছেন। কুরআন মজিদে নারী-পুরুষ উভয়কেই পরিশ্রমী ও কর্মনিষ্ঠ হওয়ার তাকিদ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি তোমাদের মধ্যে কোন কর্মনিষ্ঠ নর অথবা নারীর কর্ম বিফল করি না। তোমরা একে অপরের অংশ (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৯৫)। এই আয়াতে কারিমায় আরও লক্ষ্য করা যায় যে, এখানে নারী ও পুরুষকে বলা হয়েছে বা’দুকুম্ মিম্ বা’দি- অর্থাৎ তোমরা একে অপরের অংশ। এর দ্বারা নারীর অধিকার ও মর্যাদা পুরুষের সমান অবস্থানে অধিক্ষিত করা হয়েছে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারীর যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ফলে মানবিক মূল্যবোধের সামগ্রিক সৌকর্য জোরদার বুনিয়াদ লাভ করেছে। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আদর্শই সর্বকালের মানুষের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। তাঁর আদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল বিশ্বশান্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। (সমাপ্ত) লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×