ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সেলুলয়েডে মহাত্মার আত্মজীবনী

প্রকাশিত: ১৯:৩৪, ১৮ জুন ২০২০

সেলুলয়েডে মহাত্মার আত্মজীবনী

বিগত এবং নতুন শতাব্দীতে হলিউড-বলিউড কিংবা অন্যত্র মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে অনেক সিনেমা বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছে। তাঁকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘ভাষা’ কখনও বিষয় হয়ে দাঁড়ায়নি। কারণ, মোহন দাশ করোম চাঁদ গান্ধীর জীবন এবং দর্শন অন্তরাত্মার উপলব্ধির বিষয়। তাঁর জীবন একটি খোলা ক্যানভাস। সেখানে চাইলে যে কেউ রং তুলির আচড় দিতে পারে। ১৯৬৩ সাল, ব্রিটিশ নির্মাতা মার্ক রবসন তাঁর হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ‘নাইন আওয়ার ইন রোম’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যতদূর জানা যায় ওটাই তাঁকে নিয়ে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র! এরপর ১৯৬৯ সালে ভিতালভাই জফরী তাঁর জীবনী নিয়ে নির্মাণ করেন, ৫ ঘণ্টার তথ্য চিত্র। সাদা-কালো ওই তথ্য চিত্রে তুলে ধরা হয় মহাত্মা গান্ধীর পুরো জীবনকে। এরপর ১৯৮২ সালে তাঁর ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক জীবন নিয়ে রিচার্ড এ্যাডেনবরা নির্মাণ করেন ‘গান্ধী’ সিনেমা। বলা হয়ে থাকে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে এযাত যত সিনেমা নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে এটাই সেরা! ৩ ঘণ্টা ১১ মিনিটের এই চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখা যায় এক তরুণ আততায়ী তাঁকে প্রণাম করার ছলে খুব কাছ থেকে তিনটি গুলি করে। শরীরে গুলি বিদ্ধ হলে- তিনি মৃদু স্বরে উচ্চারণ করেন ‘ও আমার ঈশ্বর, ও আমার ঈশ্বর’ এভাবে মহাত্মার প্রস্থান দিয়ে শুরু হয় তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অধ্যায়। এরপর দেখা যায় তরুণ গান্ধী ব্রিটেন থেকে আইন পাস করে ১৮৯৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ যাচ্ছেন, এক কোম্পানির আইন পরামর্শক হিসেবে। পথে তাঁকে বর্ণবাদের স্বীকার হতে দেখা যায়। সাদা চামড়ার সাহেবদের আসনে বসায় তাঁকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয়া হয়। মহাত্মা আফ্রিকায় গিয়ে সেখানকার মানুষের দুঃখ-কষ্ট এবং শোষণ দেখে প্রতিবাদ করেন এবং জেল খাটেন। তার অহিংস প্রতিবাদে শাসক শ্রেণী নরম হয় এবং তাকে মুক্ত করে দেশে পাঠিয়ে দেয়। তিনি যখন দেশে ফেরেন- ভারত তখন ইংরেজ শাসনে পদপৃষ্ঠ। বিদেশের মাটিতে গান্ধীর মহত্ত্বের কথা ভারতবর্ষের অনেক মানুষ জানতেন। বিশেষ করে, কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতারা। কংগ্রেস দীর্ঘদিন রাজনৈতিকভাবে লড়াই করে আসছে ভারত স্বাধীনের আশায়। কিন্তু ক্যারিসমেটিক কোন ক্ষমতা তারা দেখাতে পারছিলেন না। গান্ধী ভারত আসার পর প্রথমে পুরো দেশ ঘুরে দেখেন, তারপর এক রাজনৈতিক সভায় যথাযথ তথ্য উপত্ত দিয়ে ভারতবাসীর সঠিক অবস্থা ব্যাখ্যা করেন। একই সঙ্গে খুলে দেন নতুন মুক্তির দুয়ার। তার নিদ্রাভঙ্গের ভাষণে জোগে ওঠে ভারতবর্ষ। শুরু হয় নব তরঙ্গের স্বাধিকারের আন্দোলন। এই আন্দোলনে ছিল না কোন হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা রক্তপাত। তার হৃদয় উজাড় করা প্রেম এবং অহিংস মতবাদে ভারতবাসী মুগ্ধ হয়। ভালবেসে লোকে তাঁকে ‘বাপু’ বলে ডাকেন। অব্যাহত আন্দোলনে ইংরেজ দেশ ত্যাগ করলে- ভাতর রাষ্ট্রের জন্ম হয়। একই সঙ্গে জন্ম হয় কিছু অমীমাংসিত তিক্ততার। স্বাধীনতা আন্দোলনের সায়াহ্নে দ্বি-জাতি তত্ত্ব, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মতো ঘটনা মহাত্মাকে বিক্ষত করে। এই সিনেমায় গান্ধীর পরিণত বয়স থেকে একেবারে মৃত্যু পর্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গুরুত্বের খাতিরে কোথাও চুল পরিমাণ ছাড় দেয়া হয়নি। আর গান্ধীর চরিত্রে একজন ব্রিটিশ অভিনেতা ‘বেন কিংসলে’ সত্যিই অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। পরিচালক হিসেবে রিচার্ড এ্যাডেনবরা অসাধারণ মেধা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। এখন পর্যন্ত গান্ধীকে নিয়ে যত সিনেমা নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে এটাই সর্বাধিক নন্দিত চলচ্চিত্র। এ ছাড়া বলিউডে ১৯৯৩ সালে কেতন মেহেতা নির্মাণ করেন ‘সারদার আয়রন ম্যান অব ইন্ডিয়া’, ১৯৯৬ সালে শ্যাম বেনেগাল করেন ‘দ্য মেকিং অব মহাত্মা’, কমল হাসান ২০০০ নির্মাণ করেন ‘হায় রাম’। মহাত্মাকে নিয়ে হিন্দী ভাষার এই চলচ্চিত্রটি বেশ প্রসংশিত। ২০০৬ সালে ‘লাগে রাহ মুন্না ভাই’ নির্মাণ করেন রাজ কুমার হিরাণী, নতুন শতাব্দীতে এই সিনেমা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ২০০৭ সালে ফিরোজ আব্বাসের ‘গান্ধী মাই ফাদার’, এবং ‘গান্ধী টু হিটলার’ ছাড়াও আরও চলচ্চিত্র এই মহাত্মাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে। তাঁকে কেন্দ্র করে নির্মিত সব সিনেমায় একটি বিষয় পরিষ্কার- আর তা হলো ‘অহিংসা পরম ধর্ম।’
×