ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়

বিদেশে খেলা ফিরলেও দেশে অনিশ্চিত

প্রকাশিত: ২১:২৪, ১৭ জুন ২০২০

বিদেশে খেলা ফিরলেও দেশে অনিশ্চিত

আচমকাই সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। মহামারী করোনাভাইরাসের করুণ থাবায় সবকিছুর মতো স্তব্ধ হয়ে যায় নির্মল বিনোদনের মাধ্যম ক্রীড়াঙ্গনও। এখনও অচলাবস্থা পুরোপুরি কাটেনি। তবে আলোর ঝলকানি ঠিকই দেখা দিয়েছে। গত ১৬ মে জার্মান বুন্দেসলীগা মাঠে গড়ানোর মধ্য দিয়ে আবারও প্রাণ ফিরে এসেছে প্রিয় ফুটবলাঙ্গনে। এই ধারাবাহিকতায় সদ্যই মাঠে গড়িয়েছে স্প্যানিশ লা লীগা। আজ থেকে শুরু হচ্ছে জনপ্রিয় ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ। ইতোমধ্যে কোপা ইতালিয়া দিয়ে ফিরেছে ইতালির ফুটবল। ২০ জুন দেশটিতে শুরু হচ্ছে সিরি এ লীগও। বাংলাদেশ খেলাপাগল জাতি। যে কোন ধরনের খেলাতেই স্টেডিয়ামে দর্শকের ঢল নামে। কিন্তু গত তিন মাসে সবকিছু পাল্টে গেছে। বহিঃবিশ্বের মতো বাংলাদেশও মরণঘাতী করোনাভাইরাসে কাবু। যে কারণে থমকে আছে নির্মল বিনোদনের মাধ্যম ক্রীড়াঙ্গনও। যে স্টেডিয়াম পাড়ায় সবসময় জনমানুষের কোলাহল থাকতো; সেইসব জায়গায় এখন সুনসান নীরবতা। স্টেডিয়ামগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় কত দীর্ঘসময় কোনো কিছুর পরশ পড়েনি। যেন মরুভূমির মতো খা খা করছে চারদিক! বাংলাদেশের খেলাধুলার সূতিগাকার খ্যাত গুলিস্তান এলাকার স্টেডিয়ামগুলোতে এ চিত্রই দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম প্রায় পুরো বছরই ফুটবলসহ আরও কিছু ইভেন্টে ব্যস্ত থাকে। করোনার থাবার আগে স্টেডিয়ামটি ব্যস্ত ছিল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ ফুটবল আয়োজন নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে অনির্দিষ্টকাল খেলাধুলা বন্ধ হওয়ায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম এখন জনমানব শূন্য। মিরপুরে অবস্থিত দেশের প্রধান ক্রিকেট স্টেডিয়াম ‘শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম’। কিন্তু এলাকাটি করোনাভাইরাসের রেড জোনের শীর্ষে অবস্থান করছে। শুধু ক্রিকেট নয়, অন্যান্য খেলাধুলাতেও একই অবস্থা। যে কারণে সহসাই দেশে ক্রিকেট বা অন্যান্য খেলাধুলা ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাইতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফুটবল ফিরলেও দেশে কবে নাগাদ খেলাধুলা ফিরবে সেটা নিয়ে সন্দিহান কর্তাব্যক্তিরা। ফুটবলের এই ফেরাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকে বলছেন, এর ফলে ক্রীড়াবিশ্বের অন্যান্য ইভেন্টও মাঠে ফিরতে উৎসাহিত হবে। এর মধ্য দিয়ে কেটে গেছে শঙ্কার কালো মেঘ। দেখা দিয়েছে সোনালি সূর্য। দুই মাসেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর আবারও মাঠে ফিরেছে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আকাক্সিক্ষত খেলা ফুটবল। একগাদা নিয়মের মধ্য দিয়ে নতুন করে মাঠে ফিরেছে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লীগের একটি বুন্দেসলীগ ও লা লীগা। ফিরে আসাটা দারুণ স্মরণীয় করেছে বেয়ার্ন। ক্লাবটি বুন্দেসলীগায় টানা অস্টম ও রেকর্ড ৩০তম শিরোপা জিতে নিয়েছে মঙ্গলবার রাতে। তাও আবার চার ম্যাচ হাতে রেখেই। লা লীগায় বার্সিলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদও স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন করেছে। ফুটবল মাঠে ফিরলেও মানতে হয়েছে রাশি রাশি নিয়ম। যে কারণে ছিল দর্শকহীন ফাঁকা গ্যালারি। লোক সমাগম বলতে কেবল দুই দলের খেলোয়াড়, কোচ, ক্লাব কর্মকর্তা, রেফারি, নিরাপত্তাকর্মী, মেডিক্যাল দল, ফটোগ্রাফার ও সাংবাদিক। জার্মান ফুটবল লীগ (ডিএফএল) কর্তৃপক্ষ আগেই নিয়ম করে দিয়েছে, ৩০০ জনের বেশি লোক মাঠের ভেতর থাকতে পারবে না। কিভাবে ম্যাচ চালাতে হবে তা নিয়ে ৫১ পৃষ্ঠার এক নির্দেশিকাও দেওয়া হয় ক্লাবগুলোকে। ‘ক্লোজড ডোর’ ম্যাচ হলেও অবশ্য উত্তেজনার কমতি হচ্ছে না কোন ম্যাচেই। গোল উদযাপনে খেলোয়াড়দের সতর্ক থাকতে দেখা যাচ্ছে। পরস্পরকে জড়িয়ে না ধরে বা ‘হাই ফাইভ’ না করে অনেককে দেখা যাচ্ছে কনুইয়ে কনুই ঠেকাতে। যেমন ডর্টমুন্ডের হয়ে প্রথম গোল করার পর উঠতি তারকা আরলিং হালান্ডকে উদযাপন করতে দেখা গেছে একপ্রান্তে একা একা। ওই সময় তাঁর সতীর্থরা ছিলেন অনেকটাই দূরে। জীবাণুনাশক স্প্রে দিয়ে বল মাঝেমধ্যেই পরিষ্কার করা হয়েছে। ডাগ আউটে দূরত্ব মেনে বসেন কোচ ও স্টাফরা। নিয়মের বেড়াজালের কারণে সমর্থকরা মাঠে আসতে না পারলেও প্রিয় দলের জন্য তাদের ভালবাসার ঘাটতি নেই। এই নমুনা দেখে গেছে কোলন ও মেইঞ্জের ম্যাচে। কোলনের সমর্থকরা অভিনব পদ্ধতিতে প্রিয় দলকে সমর্থন জুগিয়েছেন। খেলা শুরুর ঘণ্টাচারেক আগে ভূতুড়ে দর্শকদের মাঠে আনে ক্লাবটি। যেখানে সমর্থকদের শরীরটাই শুধু ছিল না। কোলনের স্টেডিয়ামের গ্যালারির আসনে বিছিয়ে রাখা হয় ক্লাবের হোম, অ্যাওয়ে ও তৃতীয় আরেকটি জার্সি। কোথাও বসিয়ে রাখা হয়েছে প্লাস্টিকের ‘পুতুল দর্শক।’ তার মাথায় ক্লাবের টুপি, গায়ে জার্সি। কোথাও বসানো হয়েছে সমর্থকদের শার্ট ও স্কার্ফ। এত সব আয়োজনের মাধ্যমে তারা জানান দিচ্ছে যেন মাঠে বসেই প্রিয় ক্লাব কোলন এফসিকে সমর্থন দিতে ব্যস্ত দর্শকরা। দেশে দীর্ঘদিন খেলাধুলা না থাকায় অনুমিতভাবেই মাঠের ঘাসগুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখে মনে হতে পারে এ যেন ঘাসক্ষেত! তবে সাম্প্রতিক সময়ে কিছু দোকানপাট খোলার অনুমিত দেয়ায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকায় মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। ফুটপাথে কিছু কিছু দোকান দেখা যাচ্ছে। এক দোকানির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘খেলাধূলা বন্ধ থাকায় আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। খেলা থাকলে মানুষ বেশি আসে, আমাদের বেচাকেনাও ভাল হয়। এখন কেউ আসে না’। মওলানা ভাসানী জাতীয় হকি স্টেডিয়ামেও এখন কোলাহল নেই। অথচ স্বাভাবিক সময়ে স্টিকের আওয়াজে গুমগুম করতে থাকে স্টেডিয়ামটি। স্টেডিয়াম ঘিরে রয়েছে অগণিত দোকানপাট। তবে কিছু কিছু দোকান ইদানীং খোলা হচ্ছে। আইভি রহমান সুইমিংপুলের দৃশ্য দেখলে যে কেউ আঁতকে উঠতে পারেন। দুই মাস ব্যবহার না হওয়ায় সুইমিংপুলের পানিতে শ্যাওলা জমে গেছে। এছাড়া মনসুর আলী হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামসহ অন্যান্য খেলাধুলার স্পটগুলোতেও এখন নেই কোন প্রাণ। রাজধানীর হাতিরঝিল সংলগ্ন গুলশান-১ এ অবস্থিত বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশন। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত কমপ্লেক্সটি সারা বছরই ব্যস্ত থাকে শূটারদের পদচারণায়। কিন্তু ঘাতক করোনায় কারণে বাধ্য হয়েই বন্ধ রয়েছে ফেডারেশনটি। এতে করে অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন শূটাররা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সাফল্যের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে শূটিং। ধারাবাহিভাবে শূটাররা বহিঃবিশ্বে লাল-সবুজের পতাকা পত পত করে উড়িয়েছেন। কিন্তু অনুশীলন ও খেলা বন্ধ থাকায় এর বাজে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন শূটাররা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন তারকা শূটার বলেন, ‘আমরা নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত। কারণ ঘরে বসে আর কতটা নিজেকে ফিট রাখা যায়। এই সময়ে ফেডারেশন থেকে আমাদেও তেমন সাপোর্টও করা হচ্ছে না। অন্তত ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুশীলনের জন্য সহযোগিতা করা দরকার ছিল।’ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের এক নম্বর খেলায় পরিণত হয়েছে ক্রিকেট। ধারাবাহিক তাক লাগানো সাফল্য দিয়েই দেশের মানুষের মন জয় করেছেন ক্রিকেটাররা। যে কারণে মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহীমদের গুণমুগ্ধ গোটা দেশের মানুষ। কিন্তু বেরসিক করোনার কারণে এইসব তারকাদের পারফরমেন্স দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের মানুষ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এই সময়ে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে জনতার ঢল নামতো। কিন্তু খেলা না থাকায় এই স্টেডিয়ামটিও এখন খা খা করছে। অনভিপ্রেত এই দৃশ্যে ব্যথিত ক্রিকেটপ্রেমীরা। সাইফুল ইসলাম নামের একজন ক্রিকেটপ্রেমী বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের কোন খেলা মিস করি না। যেভাবেই হোক টিকেট জোগাড় করে স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখি। কিন্তু এখন মাঠে যেতে পারছি না। এটা অনেক কষ্টের। আমি বুঝতে পারছি ক্রিকেটাররা কতটা কষ্টে আছেন। আশা করছি দ্রুতই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
×