ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রমাণ পেয়েছে সে দেশের সিআইডি

কুয়েতী কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে ফায়দা লুটে নেন পাপুল

প্রকাশিত: ২২:৩০, ১৬ জুন ২০২০

কুয়েতী কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে ফায়দা লুটে নেন পাপুল

শংকর কুমার দে ॥ কুয়েতে অর্থপাচার ও মানবপাচারের জন্য কুয়েত সরকারের বর্তমান ও সাবেক ৭ কর্মকর্তাকে ঘুষ ও উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশের সংসদ সদস্য-এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। এছাড়া সরকারের টেন্ডার কমিটি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দুই মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ ছিল কুয়েতে গ্রেফতার হওয়া এই এমপি’র। তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের তদন্তে প্রমাণ পেয়েছে কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। টানা ৮ দিনের রিমান্ড শেষে পাপুলকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক রাখার নির্দেশ দিয়েছে কুয়েতের প্রসিকিউশন বিভাগ। বাংলাদেশের সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল ও তার সহযোগীর জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে দিয়েছেন কুয়েতের আদালত। কূটনৈতিক সূত্রে এ খবর জানা গেছে। বাংলাদেশের এমপি পাপুল কুয়েতের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তা এবং সরকারের টেন্ডার কমিটি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ দুই মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের ঘুষ এবং উপহার দিয়ে বিশেষ সুবিধা আদায় করে নেয়ার বিষয়ে তদন্তে তথ্য প্রমাণ পেয়েছে বলে তদন্ত সংস্থা সিআইডির উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে কুয়েতের গণমাধ্যম আরব টাইমস। কুয়েতে গ্রেফতার হওয়া এমপি পাপুলকে তার কর্মকা- চালিয়ে যাওয়ার জন্য কারা সুযোগ দিয়েছেন এবং তার কী গিফট বা কত পরিমাণ অর্থ নিয়েছেন সে বিষয়ে জানতে তাকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছে কুয়েত তদন্ত কর্তৃপক্ষ। কাজী পাপুলের বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন ১১ প্রবাসী বাংলাদেশী। তাদের অভিযোগ, ভিসা ও আকামা নবায়নের নামে তাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছিলেন কাজী পাপুল। কুয়েতে অর্থ ও মানবপাচারের অভিযোগের তদন্তে এমন তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর আটক বাংলাদেশের সাংসদ কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল ও তার সহযোগীর জামিন আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন কুয়েতের আদালত। এমপি পাপুলকে জিজ্ঞাসাবাদ, অনুসন্ধান, তার কুয়েত অফিসে তল্লাশি অভিযানের পর এমন তথ্য-প্রমাণ পায় কুয়েত সিআইডি। কুয়েতের আরব টাইমস জানিয়েছে, এমপি পাপুল সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের কয়েকটি ব্যাংকে কয়েক লাখ কুয়েতী দিনার হস্তান্তর করেছেন। অর্থ ও মানবপাচারের মামলায় নাম উঠে আসার পর কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের ঘুষও দেন তিনি। অর্থপাচার ও মানবপাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশী সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে তার বেশ কয়েকজন কুয়েতী সহযোগীর সন্ধান পেয়েছে কুয়েতের তদন্তকারী সংস্থার গোয়েন্দারা। তদন্তে এখন পর্যন্ত কুয়েতের ৭ জন সাবেক-বর্তমান সরকারী কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করার বিষয়টি কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশনকে অবহিত করা হয়েছে। রবিবার কুয়েতের ইংরেজী সংবাদপত্র আরব টাইমস জানিয়েছে, কুয়েতে গ্রেফতার হওয়া এমপি পাপুলকে টানা ৮ দিনের রিমান্ড শেষে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক রাখার নির্দেশ দিয়েছে প্রসিকিউশন বিভাগ। তার সঙ্গে আটক থাকতে হচ্ছে মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপের আরেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মুর্তজা মামুনকেও। এমপি পাপুলের বিরুদ্ধে তদন্ত চলার মধ্যে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে মুর্তজা মামুনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে কুয়েতের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। আরব টাইমস লিখেছে, পাপুলের অপরাধের সহযোগী হিসেবে এই পর্যন্ত কুয়েতের ৭ জন বিশিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করেছে সরকারী কৌঁসুলিরা। তাদের মধ্যে চারজন অবসরপ্রাপ্ত এবং বাকিরা তিনটি সরকারী সংস্থার প্রধান। কুয়েতের চিহ্নিত করা ৭ কর্মকর্তারা ঘুষ ও উপঢৌকন নিয়ে পাপুলের কর্মকা-ে সহযোগিতা করেছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে কুয়েত থেকে প্রকাশিত আরব টাইমস। প্রতিবেদনে বলা হয়, পাপুল কর্তৃক ইউরোপীয় ও উপসাগরীয় অঞ্চলের ব্যাংকগুলোতে মিলিয়ন মিলিয়ন দিনারের সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে বলে জেনেছেন তদন্তকারীরা। মানবপাচার, অর্থপাচার ও ভিসা বাণিজ্যের অভিযোগ আসার পর কুয়েত থেকে ব্যবসায় গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টায় ছিলেন কুয়েতে গ্রেফতার হওয়া বাংলাদেশের এমপি পাপুল। গত ৬ জুন রাতে কুয়েতের মুশরিফ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য-এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলকে। কুয়েতের পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট এই ব্যবসায়ী মারাফি কুয়েতিয়া কোম্পানির মালিকদের একজন তিনি। তাকে গ্রেফতারের পর কুয়েতী গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, পাঁচ বাংলাদেশীর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পাপুলের বিরুদ্ধে মানবপাচার, অর্থপাচার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগ এনেছে কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশন। পাঁচ বাংলাদেশী কুয়েত প্রবাসীরা কুয়েতের প্রসিকিউশনকে জানিয়েছেন, তিন হাজার কুয়েতী দিনার খরচ করে পাপুলের মাধ্যমে সেদেশে গিয়েছে তারা। শুধু তাই নয়, ভিসা নবায়নের জন্য ফি বছর টাকা দিতে হয় তাদের। এমপি পাপুলকে আটকের পরদিন থেকে জামিন না দিয়ে রিমান্ডে দেয় কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশন বিভাগ। এমপি পাপুল আটক থাকার সময়ে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে ১১ জন বাংলাদেশী কুয়েত প্রবাসী ব্যক্তির সাক্ষ্য নিয়েছেন তদন্তকারীরা। তদন্ত চলার মধ্যে পাপুলের কুয়েতের বাসায় অভিযান চালিয়ে চেক জব্দ করার পাশাপাশি অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়ার খবর দিয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। পাপুলের প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মামুনের পাশাপাশি একজন মিসরীয় অভিবাসীকে গ্রেফতার করা হয়। এমপি পাপুলকে কুয়েতে গ্রেফতারের পর তদন্ত চলার মধ্যে এটাকে সবচেয়ে বড় মানবপাচারের ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন কুয়েতের উপ-প্রধানমন্ত্রী আনাস আল-সালেহ। পাপুলের অর্থপাচার ও মানবপাচারের সঙ্গে কুয়েত সরকারের কারও বিরুদ্ধেও যদি জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কুয়েতের উপ-প্রধানমন্ত্রী। কুয়েতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা আল-সালেহ এক টুইটে বলেছেন, বিগত কয়েক সপ্তাহে অভিবাদন পাওয়ার মতো কাজ করেছে কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মীরা, যেটা একজন এশীয় অভিবাসীর মাধ্যমে সবচেয়ে বড় মানবপাচারের ঘটনা প্রকাশ করেছে। মানবপাচার ও অর্থপাচারের তদন্তে সন্দেহভাজন আর্থিক লেনদেনের তথ্য বেরিয়ে এসেছে যা কর্মকর্তা ও কোম্পানিগুলোর একটি নেটওয়ার্ক এ কাজে সহযোগিতা করেছে। কুয়েতের রাজনীতিতেও বাংলাদেশের এমপি পাপুলের গ্রেফতারের বিষয়টি বড় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে কুয়েতে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। পাপুলের অর্থপাচার ও মানবপাচারের সঙ্গে মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারী কর্মকর্তাদের নাম প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন আবদুল করিম আল-কানদারিসহ বেশ কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য। কুয়েতী পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্যও পাপুলের অর্থপাচার ও মানবপাচারের ঘটনায় ফেঁসে যেতে পারেন বলে আভাস দেয়া হয় কুয়েতী গণমাধ্যমে। বিষয়টি নিয়ে দেশটির দুর্নীতি দমন কমিশন যেন তদন্ত করে সেই দাবিও উঠেছে কুয়েতে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য-এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কুয়েতে গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। পাপুল ২০১৮ সালে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। শুধু তাই নয়, নিজের স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করে আনেন তিনি। প্রবাসী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান পাপুল, যেখানে তার বিপুল অঙ্কের শেয়ার রয়েছে। পাপুলের মালিকানাধীন মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী কাজ করেন বলে কুয়েতে বাংলাদেশ কমিউনিটির ধারণা। কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, সেবাখাত, নিরাপত্তা, নির্মাণ, আবাসন, পরিবহন, তেল শোধন প্রভৃতি খাতে কার্যক্রম রয়েছে মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপের। কুয়েতের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ব্যবসায় রয়েছে তাদের। দেশ-বিদেশে অপরাধের মাধ্যমে বিশাল অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার বিষয়টি তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক। এমপি পাপুলকে গত ৬ জুন কুয়েতে আটকের পরদিন বিষয়টি নিয়ে কুয়েত সরকারের কাছে কনস্যুলার একসেস চেয়ে চিঠি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চেয়েছিল কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এসএম আবুল কালাম। গ্রেফতারের ৮ দিন পরও কুয়েত সরকার সেই চিঠির উত্তর দেয়নি।
×