ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ২১:০৭, ১৬ জুন ২০২০

ঢাকার দিনরাত

ঢাকা শহরের অনেক সড়কই এখন রীতিমতো হয়ে উঠেছে ফলবাজার। ফলবাগান বলতে পারলে এক ধরনের সুখ হয় বটে। এবার ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে মৌসুমী ফল আমের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতক্ষীরা অঞ্চলে। আর কে না জানে সুস্বাদু আমের জন্য ওই এলাকা কত বিখ্যাত। যদিও রাজশাহী আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের কথাও বলতে হবে। আমাদের এক বন্ধু এসএম কাফি ঢাকায় লকডাউন উঠে যাওয়ার সুবিধা নিয়ে সপরিবারে চলে গেছেন রাজশাহীর গ্রামের বাড়ি। পারিবারিক আমবাগানের সংখ্যার দিক থেকে তারা রীতিমতো জমিদার। দিনের বেলা কাঠফাটা গরমের ভেতর দুই সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে একেকটা আমবাগানে চলে যাচ্ছেন আর সেই বাগানের আমের স্বাদ গ্রহণ করছেন। বেশ লোভনীয় আর ঈর্ষণীয় যে ব্যাপারটা সেটি তার ফেসবুকের পোস্টের কমেন্টগুলোয় স্পষ্ট। সে যাক, বলছিলাম ঢাকা শহরের কথা। আম আর লিচু উঠেছে প্রচুর। দামও অত বেশি নয়। কাঁঠাল এখনও খুব বেশি নেই, জামও কম দেখলাম। মানুষ রসালো ফলের স্বাদ নিতে ভুলছেন না। আমার এলাকা উত্তরায় ফলের ছড়াছড়ি। বড় বড় রেস্টুরেন্ট বাদে সব দোকানপাটই খুলে গেছে বলা চলে। অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। মোড়ে মোড়ে জটলাও হচ্ছে তরুণদের। চায়ের স্টলে আড্ডা চলছে। এসব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি আধাআধি মানা হচ্ছে। তার মানে কেউ মাস্ক পরছেন, কেউ থুঁতনিতে ঝুলিয়ে রাখছেন। কেউ তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখছেন, কেউ রাখছেন না। আমার ধারণা ছিল রাত ৮টার পর বাইরে বেরুনোর ব্যাপারে প্রশাসনের কড়াকড়ি আছে। কিন্তু এই এলাকায় তেমনটি খুব একটা নজরে পড়ছে না। মানুষ যেন করোনাভাইরাসের সঙ্গে সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেছে। তা করুক। কিন্তু মাস্ক না পরলে ঝুঁকি থেকেই যাবে। আর বার বার হাত ধুতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। পার্টটাইম গৃহকর্মীরা (ছুটা বুয়া) কাজে যোগ দিয়েছেন। আমাদের ভবনে রীতিমতো মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ১১ জুন থেকে এসব গৃহকর্মীকে বাসায় ঢুকতে দেয়া হবে। আমাদের ফ্ল্যাটে আসতে শুরু করেছেন কণার মা। তার কাছ থেকে আশ্বস্ত হওয়ার মতোই সংবাদ পেলাম। তার ডেরার আশপাশের কেউই করোনায় আক্রান্ত হননি। এমনকি কারও জ্বরজারিও হয়নি গত তিন মাসে। সত্যি বলতে কি পারিবারিকভাবে যারা আমাদের স্বজন, এমন মানুষের সংখ্যা যদি কমপক্ষে ১৫০ জন ধরি, তবে তাদের মধ্যে মাত্র ২ জনের জ্বর হয়েছিল গত তিন মাসে। একজনের লক্ষণ বা উপসর্গ মিলে গিয়েছিল করোনার সঙ্গে। যদিও স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তার নেগেটিভ আসে এবং কয়েকদিনের মধ্যে সে সুস্থও হয়ে যায়। অপরজনও সুস্থ হয়, যদিও তার করোনার কোন উপসর্গ ছিল না। আমাদের বন্ধুস্থানীয় একজনের মা করোনায় মারা গেছেন। ওই মায়ের নিকটজনদের ভেতর অন্তত সাতজন অন্তিম সময় পর্যন্ত অসুস্থ মায়ের পাশে ছিলেন। তারা দুই সপ্তাহ পর জানিয়েছেন যে তাদের কারোরই জ্বর আসেনি বা কোন উপসর্গ দেখা যায়নি করোনার। তাই তাদের দৃঢ় ধারণা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা রোগীর কাছাকাছি এলে করোনায় আক্রান্ত হবেন, এমন কোন কথা নেই। পূর্ব রাজাবাজারে লকডাউন পরীক্ষামূলকভাবে কঠোর লকডাউন শুরু হয়েছে ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে ঠিক এক সপ্তাহ আগে। উদ্যোগটি ভাল বলেই মনে হচ্ছে, এর ব্যবস্থাপনাতেও এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোন ত্রুটি দেখা যায়নি। প্রথম রেড জোন হিসেবে অনেকটা সফলতার পরিচয় দিলে এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে ঢাকায় বেশি সংক্রমিত অন্য এলাকাতেও একইভাবে লকডাউন করা সম্ভব হবে। তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আমরা আশা করতে পারি। ঢাকার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত পূর্ব-রাজাবাজার আয়তনে খুবই ছোট একটি এলাকা, ভেতরে মাত্র আটটি সড়ক রয়েছে। একদিকে ফার্মগেট, আরেকদিকে পান্থপথ ও কাওরানবাজার এবং আরেকপাশে ধানমন্ডি, ভৌগোলিকভাবে এমন একটি জায়গায় অবস্থান হওয়ায় এবং ঢাকার যে কোন অংশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবার কারণে এই ছোট্ট জায়গাটুকুর মধ্যেই ৪০-৪৫ হাজার মানুষ বাস করেন। বিবিসিতে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন লিখেছেন সাইয়েদা আক্তার। তিনি সরেজমিন প্রতিবেদনে লিখেছেন: ‘মঙ্গলবার সকালে পূর্ব-রাজাবাজারে গিয়ে দেখা যায়, এলাকায় ঢোকার সব কয়টি প্রবেশমুখে তালা দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। কোন কোন প্রবেশমুখে লোহার গেটে তালার বাইরে বাঁশ আর কাঠ দিয়ে ব্যারিকেড বানানো হয়েছে। গেটে প্লাস্টিক ব্যানার ঝুলিয়ে লিখে দেয়া হয়েছে, স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃক রেড জোন ঘোষণা করে এলাকায় লকডাউন করা হয়েছে। বড় বড় লাল হরফে লেখা হয়েছে প্রবেশ নিষেধ। ইন্দিরা রোড-পান্থপথ-তেজতুরি বাজার সংলগ্ন সব বন্ধ প্রবেশমুখে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল রয়েছে। তেজতুরি বাজার সংলগ্ন একটি মাত্র গেট খোলা, যেখান দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের জরুরি খাদ্য সরবরাহ এবং ওষুধবাহী দুয়েকটি পিকআপ ঢুকছে। যারাই ভেতরে ঢুকছেন, তাদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। থেকে থেকে হ্যান্ডমাইক নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকিং করে সচেতন করছেন বাসিন্দাদের। পূর্ব-রাজাবাজারের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান ইরান বলেছেন, লকডাউনে বাসিন্দাদের সেবা দেয়ার জন্য সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। খাবার ও ওষুধ পৌঁছে দেয়া এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আমরা পালন করব, এ জন্য এই মুহূর্তে ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন। অর্থাৎ একজন মানুষের যাতে কোন দরকারেই বের হতে না হয়, সেটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছি আমরা।’ উত্তরায় আমাদের এক পারিবারিক বন্ধু গতমাসেই বলেছিলেন যে তাদের পাশের ভবনেই আছেন একজন করোনারোগী। তিনি সতর্ক ও সচেতন বলেই কোন না কোন একটা সূত্র থেকে ঠিকই জেনে গিয়েছিলেন ওই রোগীর কথা। আমাদের পাশের ভবনে, হয়তো আমাদের ভবনেরই কোন একটা ফ্ল্যাটে এমন রোগী থাকলে আমার পক্ষে জানা সম্ভব নাও হতে পারে। কিন্তু প্রশাসন ঠিকই এলাকাভিত্তিক পরিসংখ্যান রাখছে রোগীর। তাই হুট করে কখন কোন এলাকা রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করে কড়াকড়িভাবে লকডাউন করা হবে, সেটি আগেভাগে এলাকাবাসী জানতেও পারবেন না। তবে চাকরিজীবীদের দুশ্চিন্তা নেই। লকডাউন এলাকায় সাধারণ ছুটি বলবৎ থাকবে, এমনটি জানানো হয়েছে। করোনাকাল : আইসিইউ, অক্সিজেন... অক্সিজেন কমে যাওয়া মানেই আইসিইউ লাগবে, এমনটি নয় কিন্তু। করোনাকালে অনেক মেডিক্যাল টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে মানুষ আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হচ্ছেন। বিশেষ করে আইসিইউ বেডের স্বল্পতার কারণে অনেকেই শঙ্কিত হয়ে পড়ছেন এই ভেবে যে করোনা জটিল আকার ধারণ করলে এই বিশেষ বেডের অভাবেই তার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। বারডেম হাসপাতালের একজন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের বক্তব্য থেকে এ সম্পর্কিত তথ্য পেয়ে আশ্বস্ত বোধ করলাম। সেটিই পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করছি। তিনি লিখেছেন: ‘অনেকে হাসপাতালে আই সি ইউ-র বেড সংখ্যা বাড়াতে বলছেন। আই সি ইউ-র বেড বাড়ানোর আগে প্রয়োজন দেশের সব হাসপাতালে (সম্ভব হলে থানা হেলথ কম্পেক্সেও) অক্সিজেন সরবরাহ সুনিশ্চিত করা। একজন রোগী যার অক্সিজেন স্যাচুরেশন রুম এয়ারে ৮৫%, তাকে অন্যান্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেন দিলে তার স্যাচুরেশন বেড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। সেক্ষেত্রে তাকে আইসিইউতে পাঠানো নাও লাগতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশে কিন্তু সার্টিফায়েড ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন স্পেশালিস্ট এর সংখ্যা অত্যন্ত কম (এখন পর্যন্ত মাত্র ৩০ জন). ট্রেইন্ড আইসিইউ ডাক্তার এবং নার্সের সংখ্যাও বেশি নয়। প্রপার ট্রেনিং ছাড়া আইসিইউতে বেড, ভেন্টিলেটর এবং অন্যান্য জিনিসের ব্যবস্থা করে লাভ নেই। এত অল্প সময়ে আইসিইউতে ট্রেনিং দেয়া/নেয়া সম্ভব নয়। সুতরাং আমাদের চিন্তা করতে হবে এই লিমিটেড রিসোর্স নিয়েই আমরা কিভাবে কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি। এই ব্যাপারে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে: ১. মৃদু অবস্থার রোগীদের বাসাতেই চিকিৎসা নেবার জন্য উদ্বুদ্ধ করা। ২. মাঝামাঝি থেকে গুরুতর রোগীদের হাসপাতালের ওয়ার্ডে মেডিসিন স্পেশালিস্টরা চিকিৎসা দিবেন। এর জন্য ওয়ার্ডগুলোকে লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে ভাগ করে ফেলা প্রয়োজন। ৩. জুনিয়র ডাক্তারদের (মেডিসিন, সার্জারি, গাইনী সব ফ্যাকাল্টির সব ডাক্তারদের) অক্সিজেনের ব্যবহার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে। স্যাচুরেশন কত হলে কতটুকু অক্সিজেন দেয়া উচিত এবং নাসাল ক্যানুলা, ফেস মাস্ক আর রিব্রিদার মাস্ক- কোনটা দিয়ে কতটুকু অক্সিজেন দেওয়া যায়; এই ব্যাপারে সিনিয়র ডাক্তার জুনিয়র ডাক্তার সবারই জানা থাকা জরুরী। এই ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি বিত্তবান ব্যক্তি রা এগিয়ে আসতে পারেন। বি এম এ-নর্থ আমেরিকা চেষ্টা করছে সাহায্য করার। অন্যান্য যারা দেশের বাইরে আছেন, সম্ভব হলে আপনারাও এগিয়ে আসুন। ’ আছে দুঃখ আছে মৃত্যু করোনা একে একে আমাদের কাছের মানুষকে টেনে নিচ্ছে। মনের ওপর চাপ বাড়ছে। সঙ্গীত শিল্পী নিলুফার লিলি ভুগছিলেন ব্রেস্ট ক্যান্সারে। পরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। তরুণ বয়স থেকেই তাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে দেখে আসছিলাম। যদিও কয়েক বছর আগে পরিচয় হয়। লাল-সবুজ রঙের প্রাধান্য দেখেছি তার পোশাক নির্বাচনে, বড় রঙিন টিপ পরতেন। মিশুক ছিলেন খুব। ইনবক্সে তার সৌজন্য প্রকাশ ও মিষ্টভাষিতার পরিচয় পেয়েছি অনেক। বহু শুভানুধ্যায়ী ছিলেন তার। এদেরই একজন শোক প্রকাশ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘লিলির সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ১৯৮৩-৮৪ সালে। মাঝে বহু বছর দেখাসাক্ষাত বা কোনরকম যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু টিভিতে তার গানের অনুষ্ঠান শুনতাম। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রগীতি, দেশাত্মবোধক, লোকগীতি মোটকথা সবরকম গানই তিনি সমান দক্ষতায় গাইতে পারতেন। আমি তার গানের বিশেষ ভক্ত ছিলাম। আমার স্ত্রীও তার গাওয়া পছন্দ করতেন। দেশে ও প্রবাসে তার গানের ভক্ত-অনুরাগীর সংখ্যা ছিল অজস্র। প্রায়ই প্রবাসী বাঙালীদের আমন্ত্রণে নানা দেশে সঙ্গীত পরিবেশন করতে যেতেন। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি বাংলার গান গাই’ গানটি তিনি এত সুন্দর করে গাইতে পারতেন। অত্যন্ত দরদ দিয়ে, দরাজ গলায় ও স্পষ্ট উচ্চারণে গান গাইতেন তিনি। তার সঙ্গে আলাপেও গানের ব্যাপারে লিলির নিষ্ঠা বা নিবেদিত চিত্ততার পরিচয় পাওয়া যেত। আজ বিশেষ করে মনে পড়ছে ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসের এক সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় বন্ধুদের আড্ডায় হঠাৎ লোডশেডিং হতে খালি গলায় গেয়ে ওঠা তার ‘দীপ নিভে গেছে মম’ গানটির স্মৃতি। সত্যিই দীপ নিভে গেল।’ ১৩ জুন ২০২০ [email protected]
×