ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এসেছে আষাঢ়

প্রকাশিত: ২০:০৭, ১৬ জুন ২০২০

এসেছে আষাঢ়

আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে। বাঙালীর জীবনে আষাঢ় মানেই বৃষ্টিমুখর দিন। সেইসঙ্গে ভেজা স্নিগ্ধ শীতল শিহরণ, মাতাল হাওয়া। মনপ্রাণ আনচান করে ওঠার দিন। আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে অথবা এমন দিনে তারে বলা যায় ...। আজকের দিনে না হয় নাই স্মরণ করলাম সেই কবেকার কালীদাসের কালের মেঘদূতকে। মহানগরীর হাইরাইজবহুল নগর জীবনে এখন এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নীল নবঘনে আষাঢ় গগনকেও দেখার অবকাশ মেলে না প্রায়। তদুপরি বায়ুদূষণ-ধুলিদূষণের দিক থেকে রাজধানী ঢাকা সেই কবেই অনিবার্য ঠাঁই করে নিয়েছে বিশ্বের বুকে। সেই অবস্থায় আকাশের নীল সেই কবেই চলে গেছে সুদূর নির্বাসনে। পরিবর্তে দেখা মেলে কালচে ছাই বর্ণের মেঘাবৃত আকাশ, কখনও সঘন আবার কখনওবা মেঘের টুকরো টুকরো ভেলা সমন্বিত বিবর্ণ ক্যানভাস, যা থেকে সময়-অসময় প্রায়ই ঝরে পড়ে অবিরল বর্ষণ। নগরজীবনে সেই পরিবেশ-পরিস্থিতিই প্রকৃতপক্ষে আষাঢ় অভিধায় ভূষিত হয়ে থাকে, যার জের চলে শ্রাবণ অতিক্রম করে ভাদ্র পর্যন্ত। এ সময় খাল-বিল-নদী-নালা-ডোবা-হাওড়-বাঁওড় হয়ে ওঠে টই-টম্বুর, সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা সবুজে সবুজ এবং অনতি পরেই শরতের শুরুতে নীলিমায় নীল। তবে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এখন আর শুধু বাংলাদেশেই নয়; বরং সারাবিশ্বেই লেগেছে ঋতু পরিবর্তনের অনিবার্য ছোঁয়া। যে কারণে আজকাল আর ঋতুকালীন পরিবর্তন সহজে অনুধাবন করা যায় না। বরং দিনক্ষণ ভূমন্ডল ইত্যাদি মিলিয়ে এর মোটামুটি সঠিক পূর্বাভাস দিয়ে থাকে আবহাওয়া বিভাগ। এবার অবশ্য ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে কিছুদিন আগে দশ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত নিয়ে উপস্থিত আমফানের সময় থেকেই। তবে আমফান ও পরবর্তীতে নিসর্গ অভিধায় চিহ্নিত ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তিস্থল ছিল সেই সুদূর আরব সাগরে। আর এর সমূহ বিপর্যয়ের ঝড়ঝাপটা ও ক্ষয়ক্ষতির বিপদটা বয়ে গেছে কলকাতা-মুম্বাইয়ের ওপর দিয়েই। সেদিক থেকে বাংলাদেশকে এ দুটো প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে প্রকৃতির দুর্ভেদ্য দেয়াল সুন্দরবনই। তাই বলে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভাঙ্গা, ফসলহানি ও কুঁড়েঘর-কাঁচাঘর যে ভাঙ্গেনি তা নয়। তবুও মোটের ওপর বলতেই হয় যে, সার্বিকভাবে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের চেয়ে এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় বিপদ করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯, যা শুধু আমাদের জন্যই নয়; বরং গোটা বিশ্বের জন্যই দেখা দিয়েছে রীতিমতো ভয়ঙ্কর অশনি সঙ্কেত হিসেবে। অদৃশ্য ঘাতক এই ভাইরাসটি শুধু মানুষকেই নয়; বরং আক্রমণ করেছে বাংলাদেশসহ বৈশ্বিক অর্থনীতিকেও, যা ইতোপূর্বে কোন রোগব্যাধি-মহামারী ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দেখা যায়নি। আরও যা সমূহ দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কের তা হলো করোনার কোন প্রতিষেধক অথবা ভ্যাকসিন তৈরি এবং এর বহুল ব্যবহার না হওয়া পর্যন্ত এই মারাত্মক ‘সিন্দবাদের ভূত’ নামবে না মানবজাতি তথা বিশ্বের ঘাড় থেকে। ততদিন পর্যন্ত আমাদের কায়ক্লেশে হলেও বেঁচে-বর্তে থাকতে হবে করোনা মহামারীকে নিয়েই। আর শুধু করোনাভাইরাসইবা বলি কেন? বর্ষার শুরুতেই ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া। গত বছরের ডেঙ্গু মহামারীর কথা রাজধানীবাসী নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি। তদুপরি ডেঙ্গু এখন আর কেবল শহর-নগরেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা গ্রাম-গঞ্জেও সম্প্রসারিত। সেই তুলনায় রক্তের প্লাটিলেটসহ চিকিৎসার সুবিধা অনেক কম। এর ওপর রয়েছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা করোনাভাইরাস। সাধে কি বাংলা ভাষার কবি আক্ষেপ করে বলেছেন, মন্বন্তরে মরি না আমরা, মারী গিয়ে ঘর করি ...। একই সঙ্গে রয়েছে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের ভয়াবহ জলাবদ্ধতা, যা নগরজীবনকে প্রতিবছরই দুর্বিষহ করে তোলে। মেট্রোরেল, উড়াল সড়ক, পাতাল রেলের কারণে যা বেড়েছে বহুলাংশে। একটাই সান্ত¡না- উন্নয়নের জন্য সাময়িক দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ-ভোগান্তি মেনে নিতেই হবে। তবে আর কতদিন? নাকি ডেঙ্গু-করোনা মহামারীর পাশাপাশি ভাঙ্গাচোরা সড়ক, খানা-খন্দে ভর্তি রাস্তাঘাট, জলাবদ্ধ মহানগরীকে অবলম্বন করেই কেটে যাবে আমাদের দুঃখ-কষ্ট পরিবাহী গ্লানিকর নগরজীবন!
×