ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

করোনাকালে কেমন আছেন মঞ্চকর্মীরা

প্রকাশিত: ২৩:৫৩, ১৩ জুন ২০২০

করোনাকালে কেমন আছেন মঞ্চকর্মীরা

গৌতম পান্ডে ॥ মঞ্চের আলো নিভে গেছে। থিয়েটার যাদের ধ্যান-জ্ঞান, সেই মঞ্চের নাট্যকর্মীরাও এখন গৃহবন্দী। শিল্পকলা প্রাঙ্গণে যেন হাজার বছরের স্তব্ধতা। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ছোবল থেকে পরিত্রাণ পায়নি বিনোদনের এই শিল্প মাধ্যমটিও। করোনার কারণে থিয়েটার বন্ধ থাকায় অনেক থিয়েটারকর্মীও মানবেতর জীবন-যাপন করছে। বাংলাদেশের থিয়েটারে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে এই মহামারী এটা নিয়েই কয়েকজন মঞ্চকর্মীর সঙ্গে জনকণ্ঠের কথা হয় । নাট্যজন ড. ইনামুল হক বলেন, আমি যেটা বলব সেটা হচ্ছে থিয়েটার কর্মীদের সময়টাকে নষ্ট করা ঠিক হবে না। যাদের থিয়েটারের প্রতি ভালবাসা আছে তারা কিন্তু এখন একটু পড়াশেনা করতে পারে। নিজেরা লেখার চেষ্টা করতে পারে। এটা নিয়ে ভাবতে পারে। নিজেকে স্বপ্রশিক্ষিত করার চেষ্টাটা করতে পারে। থিয়েটার ইতিহাস, এর কিছু ইজম এগুলো জানতে পারে। যারা থিয়েটারে পারফর্ম করে তারা শুধু এটাতেই ইন্টারেস্টেড। কিন্তু এখন পারফর্মেন্স করতে পারছে না, তাদের উচিত থিয়েটার বিষয়ে নানা ঘটনা জানা উচিত। বিভিন্ন দেশের নাট্যকারদের নাটক পড়া উচিত। আমি এরইমধ্যে একটা অনুবাদ করে ফেলেছি। যেটার নাম দিয়েছি ‘রক্তে ঝরা বিয়ে’। মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের মির জাহিদ বলেন, খুব কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি আমাদের থিয়েটার। এটা শুধুমাত্র বাংলাদেশে হতো তাহলে অন্যদেশ থেকে সাহায্য সহযোগিতা পেতাম। যেটা অতীতেও হয়েছে বিভিন্ন দুর্যোগে। কিন্তু এই দুর্যোগটা সারা পৃথিবীর। এখন সারাবিশ্বে যে অবস্থা আমাদেরও সেই অবস্থা। আজ সত্তর দিন প্রায় সব কিছুই বন্ধু। যদিও অফিস আদালত সীমিত আকারে খোলা হয়েছে কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য সম মিলিয়ে কেউই ভাল নেই। মধ্যবিত্ত ও নি¤œœ মধ্যত্তি ঘরের ছেলে-মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থিয়েটার করে। এক্ষেত্রে ফ্যামিলিরও একটা সাপোর্ট থাকে যে পড়ালেখার পাশাপাশি কিংবা টিউশনি করার পাশাপাশি থিয়েটার করে। এই জায়গা থেকে আমাদের মঞ্চকর্মী যারা তারা হয়ত পিছিয়ে যাবে মনে হচ্ছে। কারণ, আমরা তো তাদের সেইভাবে সাপোর্ট দিতে পারছি না যেভাবে দেয়ার কথা ছিল। আমাদের সরকার থেকে একটা ঘোষণা দিয়েছে দেশব্যাপী পাঁচ হাজার শিল্পীদের প্রণোদনা দেবে। এটার কোন আলামত তেমন দেখি না। পাঁচ বা ছয় শ’ জনকে দিয়েছে শুনেছি বাকিদের আর কোন রিপোর্ট নেই। আজ আমাদের মঞ্চ শিল্পীরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। শুধু মঞ্চ বললে ভুল হবে বিভিন্ন ক্ষেত্রের পেশাভিত্তিক শিল্পীরা আজ খুবই অসহায়। অনেকে থিয়েটার করলেও এটা তাদের পেশা না, তাদেরও কিন্তু একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায়। থিয়েটার যদি টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে এদের তো টিকিয়ে রাখা দরকার। আমার মনে হয় আগামীতে ভীষণভাবে হুমকির সম্মুখীন হবে আমাদের থিয়েটার। তবে জীবন বাঁচলে থিয়েটার বাঁচবে। আমাদের সংগ্রাম নিরন্ত চালিয়ে যাব। স্বপ্নদলের জাহিদ রিপন বলেন, আমাদের অনেকেরই বিশ্বাস ছিল থিয়েটার ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না বা থিয়েটার ছাড়া একদিনও থাকতে পারি না। এখন বাধ্যতামূলক প্রায় তিন মাস মঞ্চ থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। এটার মানসিক যন্ত্রণার একটা নেতিবাচক প্রভাব আছে। ধরেন একটা প্রিয় কাজ থেকে দূরে রাখলে যে মানসিক ক্ষরণ হয় নাট্য কর্মীদের সে রকমই একটা অবস্থা বিরাজ করছে। সেটা করতে গিয়ে আমরা বিকল্প কিছু পদ্ধতি করছি। যেমন অনলাইনে আমাদের দল থেকে ২৪ দিনব্যাপী একটা কর্মশালা করেছিলাম। আবার কেউ কেউ চেষ্টা করছে অনলাইনে কিছু পারফর্মেন্স করার জন্যে। থিয়েটার তো আসলে জীবন্ত মানুষের সঙ্গে জীবন্ত মানুষের সংযোগ। এটা এভাবে হয় না কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে বিকল্প একটা চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু প্রভাব যেটা পড়বে সেটা হলো, মনে করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মানুষ যখন শূন্যতা অনুভব করল, সভ্যতা প্রায় ভেঙ্গে পড়ল, তখন থিয়েটারে দেখা গেল উদ্ভট একটা নাট্যরীতি চলে আসে। এখন এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে যেটা হবে সেটা হচ্ছে থিয়েটার যখন চালু হবে খুব ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। ধরা যাক তিন শ’ আসন সেখানে আমরা এক শ’ টিকেট বিক্রি করব। এর ফলে দলগুলোকে এই অর্থনৈতিক ক্ষতিটা পুষিয়ে ওঠার সামর্থ থাকতে হবে। আমার মনে হয়, যারা টেলিভিশনে নাটক করতে চায় কিংবা ফিল্মে অভিনয় করতে চায় এরা কিন্তু তখন আর থিয়েটারে থাকতে পারবে না। খুব ডেডিকেটেড ছাড়া থিয়েটারে টিকে থাকাটা খুব কঠিন হবে। আমি মনেকরি শিল্পকলা একাডেমি যদি উদ্যোগ নেয় করোনা সংক্রম আরও একটু কমে আসার পরে, সেটা হচ্ছে একক নাট্যোৎসব। যেটা পাঁচদিন অথবা ৭ দিনের উৎসব। সেক্ষেত্রে ঘোষণাই থাকল যে তিন শ’ আসনে এক শ’ টিকেট বিক্রি করা হবে। মঞ্চে যখন শিল্পী পারফর্মেন্স করছে একক অভিনয়, তখন তো আর সংক্রমণের ভয় থাকছে না। এভাবে সরকারী পর্যায় এবং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের উদ্যোগ নিয়ে শুরুটা করা উচিত। অফিস যেমন চালু হয়েছে অনেকে প্রটেকশন নিয়ে যাচ্ছে। শুরুটা যদি একবার হয়ে যায় তাহলে থিয়েটারটাও আবারও একটা গতি পেতে পারে। তরুণ নাট্যকার ও নির্দেশক প্রবীর দত্ত বলেন, মহামারী পৃথিবীতে নতুন নয়। বহুবার এটা পৃথিবীতে এসেছে আবার মানুষ এটাকে জয়ও করেছে। ঠিক একই অবস্থা এই করোনার ক্ষেত্রে। করোনা আছে, একসময়ে এটাকে মানুষ জয় করবে। করোনা মহামারীর জন্য আমাদের থিয়েটার আপাতত স্থগিত এটাকে একেবারে বন্ধ বলা যাবে না। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই একটা খারাপের দিক। আমরা মঞ্চে ফিরতে পারছি না। অনেকে বলছেন অনেক কিছুই তো খুলে দেয়া হলো মঞ্চও খুলে দেয়া হোক। কিন্তু সেটা সোলুশন না, কারণ এতে ঝুঁকি আরও বাড়বে। স্বাভাবিক অবস্থায় মঞ্চের দর্শক পাওয়া কঠিন সেখানে রিস্ক নিয়ে দর্শক পাওয়া কঠিন। ধরে নিলাম দর্শক ছাড়া নাটক হলো। কিন্তু যারা পারফর্ম করবে তারা কি মুখে মাস্ক পরে পারফর্ম করবে? স্বাস্থ্যবিধি মেনে তিন অথবা চার ফুট দূরত্ব বজায় রেখে পারফর্ম করবে? পারফর্মার তাদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকির দায়ভার কে নিবে? অনেকে বলছেন থিয়েটার অনলাইনে হোক। আমার কাছে এটা হাস্যকর মনে হয়। যেখানে জীবন্ত মানুষ জীবন্ত মানুষের সামনে অভিনয় করে, তাৎক্ষণিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয় সেটা কখনও ভার্চুয়াল মিডিয়াতে সম্ভব না। অনেকে বলছেন থিয়েটার ধারণ করে প্রচার করা হউক। সেটা তো থিয়েটার হলো না। করোনা একদিন কেটে যাবেই, মানুষ এটাকে জয় করবেই। থিয়েটারটা তখনই আসলে করতে হবে। পৃথিবীতে যতদিন পর্যন্ত মানব সভ্যতা থাকবে ততদিন পর্যন্ত থিয়েটার থাকবে। এটা একটা প্রচ- শক্তিশালী মাধ্যম। এটা তার আপন শক্তিতে জ্বলে উঠবে। কিন্তু আমাদের অপেক্ষা করতে হবে এর কোন বিকল্প নেই। বটতলা থিয়েটারের পরিচালক মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন, থিয়েটারের জন্য সরকারী প্রণোদনা নেই। তবে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি প্রক্রিয়া চলছিল। একটি তালিকা চাওয়া হয়েছিল। আমরা আমাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে তালিকা দিয়েছি। কিন্তু সেটা বর্তমানে কী অবস্থায় আছে, সে বিষয়ে আমাদের জানা নেই। করোনা পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারছে না। ফলে কবে আবার থিয়েটার কার্যক্রম শুরু হতে পারে তা অনিশ্চিত। এখন যে খারাপ সময়টা চলছে, তা আরও দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে ব্যক্তিগত পর্যায়ের সাহায্য-সহায়তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন এসব সাংস্কৃতিক কর্মী। তাদের দাবি, সহায়তা পাওয়া সংস্কৃতি কর্মীদের অধিকার এবং এ সময় সংস্কৃতিকর্মীদের পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব।
×