ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানুষ দাঁড়াও মানুষের পাশে...

প্রকাশিত: ২০:১৫, ১২ জুন ২০২০

মানুষ দাঁড়াও মানুষের পাশে...

দুঃখের করাল গ্রাসে লাখো প্রাণ ভাসে... মানুষ দাঁড়াও আজ মানুষের পাশে...। ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুকো বলেছিলেন; ‘ক্ষমতা ও বাচন চিরন্তন নয়।’ নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর বলতে কিছু নেই। তবু আমরা করোনার এই মহা দুর্যোগেও ভ‍ন্ডামি, ইতরামী, লুণ্ঠণ, লোভ লালসা, প্রতারণা, দুর্নীতি, হিংসা, হানাহানি এসব নিয়ে জীবনযপান করছি। শঠতা ও মিথ্যাই যেন জীবনের প্রাপ্তি। বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদী সমাজের লালসা ও ভোগ-বিলাস মানুষকে যেন দানবে পরিণত করেছে। তথাকথিত পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলো মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও যথাযথ চিকিৎসা দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। উলঙ্গ উন্নত বিশ্বের গায়ে জামা পরানোর অযুহাতে আমার দেশের লাখ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিককেও জীবন্মৃত্যুর মুখোমুখি কারা দাঁড় করিয়ে দেয়। দর্জি বেপারীদের অর্থ বিত্তের এতই প্রয়োজন! এই দুঃসময়েও জীবন আগে নাকি জীবিকা? এখন পণ্য তৈরি করে কোথায় পাঠাবে তারা? সারা পৃথিবীই তো কার্যত অচল-অবরুদ্ধ। রাষ্ট্র সমাজ আইনকানুন সবই যেন ওই দুর্বৃত্ত অমানুষদের দখলে আজ। শুভচিন্তা শুভবুদ্ধি সবই আজ নির্বাসনে। সুমন চাকমা, খোকন, আসলাম, মঈন, গৌতমের মতো আর কতজন হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে? আমি নিজেই ক্যান্সার পেশেন্ট। ভারতের মুম্বাই টাটা মেমোরিয়ালে চিকিৎসা শেষে সম্প্রতি দেশে এসেছি। এখন ভাল আছি। ভয় ও আতঙ্ক মনের মাঝে। অসুস্থ হলে কোথায় যাবো। কাকে বললে কাজ হবে। কোথায় কোথায় আমার পরিচিত লোক আছে ইত্যাদি নোট করে রাখছি। প্রতিদিন পত্রিকা পড়ি, আর দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ভয়াবহ ও চরম দুর্গতি দেখে শিহরিত হই। সঙ্গে চিকিৎসা বিভাগের সম্মিলিত দুর্নীতির চিত্র... হায় বাংলাদেশ। বৃথা যেন ত্রিশ লাখ বলিদান মুক্তিযুদ্ধে। দুর্বৃত্ত নষ্ট ইতর আমলা ও ক্ষমতাবানরা মিলেমিশে দুর্নীতির মহোৎসবের মেলা বসিয়েছে যেন। করোনা নয় এমন সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা সেবা পাওয়া তার মৌলিক মানবাধিকার। এদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। করোনা আক্রান্ত রোগীগণ যথাযথ চিকিৎসা ও সব ধরনের চিকিৎসাসেবা ও সামাজিক অধিকার ভোগ করবেন এটাই স্বাভাবিক। এই রোগে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ডাক্তার যদি রোগ ও রোগীকে ভয় পান তবে তার চিকিৎসা সেবা ছেড়ে দেয়া উচিত। প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো করোনা পরিস্থিতির আগে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। এখন তারা হাত গুটিয়ে বসে আছে। যারা ব্যাংকের হাজার হাজার কেটি টাকা নিয়ে বসে আছে, সেই টাকা এখন উদ্ধার করা হোক। আইএমএফের হিসাবে বাংলাদেশে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে ৭টা পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। আসন্ন বাজেটে ব্যাংক ডাকাত-লুটেরাদের বিরুদ্ধে যথাযথ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ঋণ পুনঃ তফসিল সংস্কৃতি একেবারে নিষিদ্ধ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার পক্ষেই এমন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব। ২০০৭ সালে মঈন ফখরুদ্দিনের সামরিক মদদপুষ্ট অবরুদ্ধ শাসনামলে গঠিত ট্রুথ কমিশনে আত্মস্বীকৃত ৪৩ জন দুর্নীতিবাজের মধ্যে ৩৯ জনই ছিল নষ্ট ভ্রষ্ট ইতর আমলা। এই তালিকায় কবি, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী একজনও ছিলেন না। নির্বাচিত এবং গণতান্ত্রিক শাসনামলে করোনা মোকাবেলায় জেলায় জেলায় এই আমলাদেরই সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গণতন্ত্র অভিমুখী বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে এটা মেনে নিতে পারছি না। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী যত বড় পদেই থাকুক, নির্বাচিত প্রতিনিধির অধস্তন থাকবে, এটাই নিয়ম। বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রনায়ক দেশরত্ন শেখ হাসিনা। আপনি দুঃখিনী বাংলার ফিনিক্স মানবী। অনির্বাণ আশা-ভালবাসা ও মানবিকতার উদার হাত প্রসারিত করে রেখেছেন ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে। দেশের সীমানা পেরিয়ে আপনার দয়া ও মমতার হাত দিগন্তে প্রসারিত। ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মাতৃমমতায় আশ্রয় দিয়েছেন। করোনাকালের এই ঘোর অন্ধকার সময়ে আপনিই যেন নূহের নৌকার হাল ধরেছেন শক্ত হাতে। অচিরেই আমরা তীরে পৌঁছে যাব। করোনার রাত শেষে ভোর আসবেই। আমরা সেই সুবর্ণ ভোরের প্রত্যাশায় আছি। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল মুক্তিকামী বাঙালীরা। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আজও সেটি বহাল আছে। যেখানে বলা হয়েছে- ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও স্বার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি। আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ আমাদের সম্মিলিত দুর্ভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শোষণমুক্ত বাংলাদেশ আমরা আজও প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আজকের যে বাংলাদেশ ও বিশ্ব বাস্তবতা মানবজাতিকে আবারও বৈশ্বিক সাম্যবাদের দিকে মুখ ফেরাতে হবে। বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত উন্নত আধুনিক সমাজরাষ্ট্র বিনির্মাণে সাম্যবাদী দর্শনের দিকেই মানবজাতিকে ফিরে ফিরে আসতে হবে। বৈষম্য ভারানত পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের বিপক্ষে উদার মানবিক শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজরাষ্ট্র নির্মাণের পদ নির্দেশ রয়েছে একমাত্র সাম্যবাদী দর্শনের মধ্যেই। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়- ‘গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয় নহে কিছু মহীয়ান।’ মহাত্মা লালন বলেছেন,- ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’ লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ রাইটার্স ফাউন্ডেশন [email protected]
×