ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কাদের পলাশ

জনতার মঞ্চ ও অন্যান্য বাংলাদেশের রাজনীতির প্রামাণ্য দলিল

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ১২ জুন ২০২০

জনতার মঞ্চ ও অন্যান্য বাংলাদেশের রাজনীতির প্রামাণ্য দলিল

বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘জনতার মঞ্চ’ শব্দযুগল ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে ১৯৯৬ সালে। বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরির প্রতিবাদ আর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অভিনব প্ল্যাটফর্মের নাম ‘জনতার মঞ্চ’। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সরকারের অধীনে প্রহসনের নির্বাচন এবং ক্ষমতা গ্রহণের প্রতিবাদে ১৩ মার্চ থেকে শুরু হয় গণআন্দোলন। ৩০ মার্চ পর্যন্ত অবৈধ সরকার পতনে রাজধানী ঢাকায় যে আন্দোলন হয় তারই নাম ‘জনতার মঞ্চ’। সে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। ২০১৭ সালে ১৮টি নিবন্ধ সমৃদ্ধ ‘জনতার মঞ্চ ও অন্যান্য’ নামে বই প্রকাশ করেন তিনি। যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে। এছাড়াও দেশ বিদেশের চলমান বিবিধ প্রেক্ষাপটসহ বাংলাদেশের কৃষি পণ্যের মধ্যে কলা, ফুলকপি, মরিচ এবং কুমড়া বিষয়ক গবেষণাধর্মী নিবদ্ধ স্থান পেয়েছে বইটিতে। যে কারণে বইটি ভিন্ন স্বাদের গুরুত্ববহন করেছে পাঠক হৃদয়ে। এছাড়া আরো কিছু জাতীয় প্রসঙ্গ এবং নোট বাতিলের যতকথাসহ বৈশ্বিক কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোকপাত করেছেন ঝরঝরে ভাষায়। ১৯৯৬ সালের ১৩ মার্চ থেকে আন্দোলনে অবৈধ খালেদা সরকার যখন নড়বড়ে তখন খালেদা জিয়ার গোপন আঁতাতের প্রস্তাব পান ড. মহীউদ্দীন খান। যা তিনি নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করেন। বইটির ‘জনতার মঞ্চ : ফিরে দেখা’ নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করে লিখেন, ‘খালেদা জিয়া কয়েকবার আমার সাথে টেলিফোনে ও লোক পাঠিয়ে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। একবার যোগাযোগ স্থাপিত হলে জিজ্ঞেস করেন ‘আমি কী চাই?’। তিনি বলেন, যদি আন্দোলন হতে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সরিয়ে নেই আমি যা চাই তাই তিনি আমাকে দেবেন। আমি বিনয়ের সাথে সে প্রলোভন প্রত্যাখ্যান করি।’ খালেদা জিয়ার অন্যান্য লোকজন কয়েক দফায় প্রস্তাব দিয়েও সফল হতে পারেনি। আন্দোলনের কারণে খালেদা সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ৩০ মার্চ রাষ্ট্রপতি খালেদ জিয়ার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। ১৫ জুন নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। এমন খবর উল্লেখ করা হলে জনতার মঞ্চ এবং চারপাশে জড়ো হওয়া মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। আনন্দ উল্লাস করেন। এভাবেই একটি অবৈধ সরকারের পতন প্রেক্ষাপট উঠে আসে ‘জনতার মঞ্চ ফিরে দেখা’ নিবন্ধে। বইটিতে আরো একটি অর্থবহ নিবন্ধ ‘বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত রক্তের ঋণ পরিশোধ’। এ নিবন্ধে রূঢ় ভাষায় ক্ষোভ ঝেড়েছেন ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। বঙ্গবন্ধু খুন হতে পারেন কোনভাবেই বিশ্বাস বা মেনে নিতে পারেননি তিনি। জাতির জনকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসাবোধ প্রকাশ করেন এভাবে, ‘আমরা দুজন নির্বাক হয়ে বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের গীর্জার সামনে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত মুক্ত বিহঙ্গসত ধাতব ভার্স্কযের পাশে বসলাম। আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে বাংলাদেশের জাতির জনককে কোন বাঙালী হত্যা করতে পারে।’ লেখক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের কুলাঙ্গার বলে মনের ক্রোধ ঝেড়েছেন অবলীলায়। তিনি খুনীদের প্রতি ধিক্কার ও তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন এভাবে ‘বঙ্গবন্ধুকে কোন্দলের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে সক্ষম হইনি। না হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার স্পর্ধা এই সব দুর্বৃত্ত ও মীরজাফররা কোন দিনই তাদের নরাধমের মানসিকতায় স্থান দিতে পারত না’। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনের লক্ষ্য উত্তরসূরিদের মাধ্যমে সফল করতে পারলেই বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ অংশত পরিশোধ করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন লেখায়। গ্রন্থের ‘মেলের কাফে ওয়েল্যান্ড’ নিবন্ধটি খুবই চমৎকার আর শৈল্পিক শব্দগাঁথুনিতে উপস্থাপন করেছেন লেখক। ওয়েল্যান্ডের বর্ণ সরল শব্দমিলনে বর্ণনাধর্মী লেখাটিতে মেলের কাফে সম্পর্কে দারুণ প্রকাশ দিয়েছেন। নিবন্ধটি পড়ামাত্রই পাঠক মেলের কাফেতে সশরীর অবস্থান অনুভূব করতে পারবেন পাঠক। ওয়েলেন্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রকাশ করেছেন কাব্যিকতা। বলেছেন শহরটি যেন, ‘শান্ত সুনিবিড়-সুস্থ সুপ্রসন্ন জীবনের প্রতিচ্ছবি’। চমৎকার শব্দশৈলীতে ফুটিয়ে তুলেছেন ওয়েল্যান্ড গোড়াপত্তনের ইতিহাস। নিবন্ধটি মৌলিক চিন্তারও প্রকাশ ঘটিয়েছেন লেখায়। বইটির সর্বশেষ নিবন্ধ ‘নোট বাতিলের যত কথা’। একটি দেশের সরকার কোন প্রচলিত নোট বাতিল করে। নোট বাতিলের নীতিবাচক ও ইতিবাচক দিকগুলো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। নিবন্ধে প্রসঙ্গ টেনে লেখক উল্লেখ করেন, একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তান সরকার ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট বাতিল করে। এসব বড় অঙ্কের টাকা ভারতে পাচার হচ্ছে। ভারত সে টাকা ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধে সহযোগিতা করছে। যদিও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারও ১৯৭২ সালে ৫০ এবং ৭৫ সালে ১০০ টাকার নোট বাতিল করে। যেন পাকিস্তানপন্থীরা অর্থ পাচার করতে না পারে এবং দেশের অর্থব্যবস্থায় নৈরাজ্য সৃষ্টি না হয়। সবশেষ ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকার কর্তৃক ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের কারণ ও এর প্রভাব সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে সুনিপুণ আলোকপাত করেছেন। ১৯৭২ সালে লেখক চাকরি জীবনে অর্থমন্ত্রণালয়ের উপ-সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। নিবন্ধে বাংলাদেশের নোট বাতিলের কারণ ও উদ্দেশ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করতে অথবা সরকারী প্রভাব বিস্তারে নোট বাতিলের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে নিবন্ধটিতে। বইটি পড়ে যে কোন পাঠক সমসাময়িক বিষয় ও নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সম্যক ধারণা পাবেন। বইটি প্রকাশ করে সুবর্ণ প্রকাশনী। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ।
×