ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কালান্তরের অগ্নিবীণা

প্রকাশিত: ১৯:৫৪, ১২ জুন ২০২০

কালান্তরের অগ্নিবীণা

কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। বাংলাদেশের জনগণ, সরকার জাতীয় কবির মর্যাদা প্রদান করে তাকে সম্মানিত ও মহিমান্বিত করেছেন। কবি হিসেবে এটি তার অনিবার্য অর্জন। তবে কবি হিসেবে তার মূল্যায়নের ক্ষেত্রটি আরও ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে প্রসারিত। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে তিনি যখন আত্মপ্রকাশ করেন তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অতুলনীয় সৃষ্টি সম্ভারের শিখরে। সাহিত্যের সব শাখাতে তিনি নিজেকে তুলে ধরেছেন সার্বভৌম সম্রাটের মতো। সৃষ্টির এত ঔজ্জ্বল্য, এত বিশালত্ব শুধু বাংলা সাহিত্য কেন বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল। কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্র বলয়ের এ যুগে কবিতার ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। তবে রবীন্দ্র বলয়ের একজন হিসেবে নয়। বাংলা কবিতায় তার আত্মপ্রকাশ ঘটে নিজস্ব অবয়ব ও এক নতুন মাত্রা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। বাংলা কবিতার এই দুই সারথীর মধ্যে একটা গভীর আত্মিক সম্পর্ক সব সময় বহমান ছিল। নজরুল ইসলাম গুরুজী বলে রবীন্দ্রনাথকে প্রবল সম্মান, শ্রদ্ধায় বিগলিত হতেন। আর রবীন্দ্রনাথ এ দুরন্ত নজরুলকে পরম স্নেহে বুকে টেনে নিতেন। নজরুল প্রতিভায় তার মুগ্ধতা তিনি প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করতেন। নজরুলের কবিতা, সাহিত্য কর্মকে তিনি সব সময় তাৎপর্যময় বলে উৎসাহিত করতেন। তবে নজরুল রবীন্দ্র বলয়ে সমর্পিত হননি কখনও। নিজেই সৃষ্টি করেছেন এক নতুন যুগের। তাই আমরা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে সচরাচর চারটি যুগের কথা বলে থাকি। আর নজরুল ইসলাম অনিবার্যভাবে রবীন্দ্ররোত্তর নতুন ও তৃতীয় যুগের প্রবর্তক হিসেবে দেদীপ্যমান। নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাই তাকে আলাদা আদলে সবাইকে বিস্মিত করে তোলে। এ কবিতার শব্দ সংযোজন, ছন্দের ভাংচুর, প্রয়োগ, মাত্রাগত দোলা ও বাণীর মর্মার্থ তার আগমনকে সহজেই ভিন্ন মাত্রার কবি হিসেবে চিহ্নিত করে তোলে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এক নতুন ও অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। এ কবিতায় প্রচলিত ঘুণে ধরা সমাজ, মূল্যবোধ, তথাকথিত সমাজপতি ও শোষণের বিরুদ্ধে মানব হৃদয়ের মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি ও প্রত্যায় ঘোষিত হয়েছে। নজরুল উদ্বোধিত এ পথে পরবর্তীকালে আরও অনেকেই কবিতা লিখেছেন। তবে বাংলা কবিতায় গণমানুষের হৃদয় মথিত বাণী ও মর্মার্থকে নজরুলই প্রথম ব্যাপক ও গভীরভাবে উপস্থাপন করেন। তাই তাকে বিদ্রোহী কবি বলেও অভিহিত করা হয়। তবে এ কথাও ঠিক তার কবিতায় শুধু বিদ্রোহের সুরই ধ্বনিত হয়নি। দেশপ্রেম, মানবিক কষ্ট, বেদনার পাশাপাশি বিভিন্ন মিথ ও ঐতিহ্যও স্থান পেয়েছে সমান্তরালভাবে। অর্থাৎ তার কবিতা বিচিত্র অনুষঙ্গে সমৃদ্ধ ও শাণিত। এক্ষেত্রে নজরুল ইসলামের নিজস্ব পথ তৈরির কাজটা খুব সহজ ছিল না। উপমহাদেশের বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের টানাপোড়েন, আর্থিক দৈন্য তাকে সব সময় বিচলিত করে রাখত। আর সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে একটি যুগের মধ্যে থেকে আরেকটি যুগের আগমনী মুহূর্তে নিজে আরেকটি যুগের সৃষ্টি তাকে এক বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। ত্রিশের চিহ্নিত কবিদের কেউ কেউ তার কাব্য ধারা সম্পর্কে সংশয়ও প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে চিনেছিলেন সহজে। তিনি নজরুলকে বরণ করেন আন্তরিকতার সঙ্গে। তিনি নজরুল ইসলামকে আশীর্বাদ করেছিলেন এক প্রলঙ্কর ‘ধূমকেতু’ রূপে। রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ নামক নাটিকাটি নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ পত্রে নজরুল কে কবি হিসাবে উল্লেখ করে ঘোষণাও দেন। এ রকম নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে তিনি কবিতা, অজস্র গান, গল্প, উপন্যাস লিখতে থাকেন। তার লেখায় প্রচুর আরবী, ফার্সী শব্দেরও তিনি ব্যবহার করেন নিজস্ব কুশলতায়। ইসলামী মূল্যবোধকে ধারণ করে অজস্র কবিতা, গান ও গজল তিনি রচনা করেন। মহানবী (সা)-এর জীবনভিত্তিক কাব্য ‘মরু ভাস্কর’ এক্ষেত্রে তার এক অনন্য সৃষ্টি। পাশাপাশি শ্যামা সঙ্গীতসহ বেশকিছু কীর্তনও রচনা করেছেন। বাংলা কবিতা ও গানের ক্ষেত্রে নিজে ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়েও যে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি তার সৃষ্টিকে ধারণ করেছেন তা খুব কম কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যেই দেখা যায়। তবে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির লেখক, ব্যক্তিত্ব সে সময়েও অনেকে ছিলেন। তবে নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে লেখার উপাদান, পাত্র-পাত্রী ও অনুষঙ্গ আহরণের দিক থেকে নজরুলের মতো দৃষ্টান্ত বিরল। বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের এটিও একটা বড় ধরনের অবদান। আর উদার মানবিকতার এ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি এক শ্রেণীর ধর্মীয় সঙ্কীর্ণবাদীদের রোষানলের শিকার হন বার বার। তারা নানাভাবে এমনকি কেউ কেউ তাকে ‘কাফের’ আখ্যায়িত করতেও কুণ্ঠিত বোধ করেননি। নজরুল ইসলাম বাংলা সঙ্গীতের সর্বাধিক গানের রচয়িতা। তিন হাজারের মতো গান লিখেছেন তিনি। এসব গান, নানা সুরে, তালে বাণীতে অনবদ্য। পৃথিবীতে এত সংখ্যক ও বৈচিত্র্যময় গান আর দ্বিতীয় কোন কবি, গীতিকার লিখেছেন বলে জানা যায় না। কবি কাজী নজরুল ইসলাম আর যদি কিছু সৃষ্টি নাই করতেন তবে গানের জন্যই তাকে চিরকাল স্মরণ রাখতে হতো। সঙ্গাীতের এ বিশাল ভান্ডার, বৈচিত্র্যমন্ডিত সুর, বাণীর গভীরতা ও আবেদন বাংলা গানের জগতে এক অতুলনীয় ঐশ্বর্যময় সম্পদ। নজরুল ইসলামের সাহিত্য সাধনার সময় জুড়েই ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি শৃঙ্খল মুক্তির এ আন্দোলনের একজন অংশীদার। কবিতা ও গান লিখে তিনি যেমন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তেমনি কখনও কখনও সক্রিয় থেকেছেন সাধারণ মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। এ জন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তবু তিনি মাথা নত করেননি কখনও। সৃষ্টিশীলতা ও তার বাস্তব জীবন অভিন্ন মোহনায় এক হয়ে মিশেছে। তবে তা কোন সুখকর সমন্বয় ছিল না । সেখানে কষ্ট আর দারিদ্র্যের ভার, অপরিসীম বেদনা তাকে অবদমিত করেছে বার বার। এ বিবিধ অবদমনেই ক্রমে ‘নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকাী গন্ধ বিধূর ধুপ’-এর নিমর্ম জীবন বেঁচে নিতে বাধা করেছে তাকে। এখানে এ মহান কবির জীবনের এক বিরাট ট্র্যাজেডি নিহিত। তবে সবচেয়ে বড় সত্য যা শাশ্বত মহিমায় উদ্ভাসিত তা হলো কালের অবিরাম যাত্রায় অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। সাহিত্য, সংস্কৃতিও নবতর সৃষ্টিতে সমৃদ্ধি লাভ করে। কিন্তু নজরুল ইসলামের সৃষ্টি কাল থেকে কালান্তরে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। তার সৃষ্টি ‘কালান্তরের অগ্নিবীণা’ হিসেবে ধ্বনিত হবে চিরকাল।
×