ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় মহিলা দলের ডিফেন্ডার মাসুরা পারভীন রুমেল খান

‘উঠতে বসতে সর্বক্ষণই ফুটবল মিস করছি’

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ১০ জুন ২০২০

‘উঠতে বসতে সর্বক্ষণই ফুটবল মিস করছি’

ফুটবল খেলার শুরুতে পরিবার থেকে বাধা পেয়েছেন। খেয়েছেন অনেক বকাঝকা। একদিন তো জার্সি, প্যান্ট, বুট সবকিছু কেড়েই নেয়া হয় যেন আর খেলতে না পারেন! ফল ব্যবসায়ী রজব আলী গাজী এবং গৃহিণী মা ফাতেমা বেগম এখন অবশ্য তাদের বড় কন্যার খ্যাতি-যশের পরিচয় পেয়ে বরং গর্বিতই। তাদের মুখ উজ্জ্বল করা সেই কন্যাটির নাম মাসুরা পারভীন। দারুণ মায়াকাড়া চেহারার অধিকারী ও ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির অধিকারী মাসুরা হচ্ছেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলের রক্ষণভাগের এক অপরিহার্য খেলোয়াড়। সেন্টার ব্যাক পজিশনের এই ফুটবলার মহিলা ফুটবল লীগ বন্ধ হয়ে গেলে গত ১৮ মার্চ গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তার বাড়ি হচ্ছে সাতক্ষীরার ইটাগাছা পূর্বপাড়ায়। ২০০১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এই ধরণীর আলোয় আসা সুদর্শনা মাসুরা উঠতে বসতে খেতে সর্বক্ষণই ফুটবলকে মিস করছেন। ভিডিওতে খেলা দেখে এবং ফেসবুকে নিজের খেলার পুরনো ছবিগুলো দেখে দুধের ঘোলে স্বাদ মেটাচ্ছেন। জনকণ্ঠকে মাসুরা জানান, ‘নিজের ফিটনেস ধরে রাখতে স্ট্রেচিং, স্কিপিং এবং কোর অনুশীলন করছি। তবে রমজান মাসে অনুশীলন করিনি রোজা থাকার কারণে।’ নিজের এলাকার করোনা পরিস্থিতি নিয়ে মাসুরার ভাষ্য, ‘আমাদের এখানে রাস্তাঘাটে পুলিশ পাহারায় থাকে। সবাই মোটামুটি সচেতন। আমার বাবা একটু অসুস্থ। তার জন্য ওষুধ কিনতে এবং বাজার করতে বাইরে যেতে হয়। তখন বোরকা পরে বের হই। এছাড়া বাসায় থাকলে দিনে ৫/৬ বার সাবান দিয়ে হাত ধুই।’ প্রবাসীদের মাধ্যমেই এদেশে করোনা ছড়িয়েছে বলে মনে করেন মাসুরা। তিনি বলেন, ‘এছাড়া আরও কারণ আছে করোনা ছড়ানোর, যেমন দশ দিনের সরকারী ছুটির অপব্যবহার, গার্মেন্টস খোলা ও বন্ধ নিয়ে শ্রমিকদের আসা-যাওয়া, ঈদের আগে শপিংমল খুলে দেয়া, গণপরিবহন খুলে দেয়া এবং জনগণের অসচেতনতা... এসব করোনার বিস্তার আরও ভালভাবে করিয়েছে।’ করোনা থেকে রেহাই পেতে অনেকেই থানকুনি পাতা খান। এ প্রসঙ্গে মাসুরা বলেন, ‘আমি কোন পাতা খাইনি। ওসব বিশ^াস করি না। এসব কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এগুলো দরকার নেই।’ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষদের সরকারীভাবে সাহায্য করতে গিয়ে অনেক জনপ্রতিনিধি গম, চাল, তেল চুরি করছেন। এ সম্পর্কে মাসুরার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, ‘মানুষকে সাহায্য করার চেয়ে ভাল ও বড় আর কিছু হতে পারে না। আর সেখানে মানুষকে এভাবে ঠকানো ও বঞ্চিত করাটা খুবই নিন্দনীয় ও অপরাধ। এই চোরদের এমন মানসিকতা মেনে নেয়া যায় না। এদের কয়েকজনকে কঠোর শাস্তি দেয়া উচিত, তাহলে বাকিরা সতর্ক হয়ে যাবে, এমন অপকর্ম করার আর সাহস পাবে না।’ অনেক ডাক্তারই করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে চান না। তবে মাসুরা পক্ষ নিলেন ডাক্তারদেরই, ‘ডাক্তারদের তুলনাই হয় না। তারাই সবচেয়ে বেশি মৃত্যুঝুঁকিতে আছেন। শুনেছি অনেক ডাক্তারকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। যেসব বাড়ির মালিকরা এমনটা করেন, তাদেরও বাসা থেকে বের করে দেয়া উচিত!’ করোনায় মৃতদের লাশ দাফনে বা সৎকারে বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটছে অনেক স্থানে। ‘এটা ঠিক নয়। এটা বোঝা উচিতÑ করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি মারা গেলে দুই ঘণ্টা পর তার দেহের করোনাভাইরাসও মারা যায়। ফলে লাশ দাফন বা সৎকারে সমস্যা বা ভয়ের কিছু নেই।’ মাসুরার মন্তব্য। মাসুরা আশাবাদীÑ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আবারও মহিলা ফুটবল লীগ মাঠে গড়াবে। ‘এর আগেই হলে আরও ভাল হয়।’ মাসুরার অবসর কাটে ফোনে বান্ধবী ও আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে, বাসায় মাকে কাজে সাহায্য করে, টিভি দেখে, লুডু খেলে ও মোবাইলে গেম খেলে। মাসুরারা তিন বোন। তিনি সবার বড়। তার ফুটবল খেলা শুরু ২০১০ সালে। ২০১৩ সালে প্ল্যান অ-১৫ বালিকা ট্যালেন্ট হান্টের মাধ্যমে উঠে আসেন। ২০১৪ সালে অ-১৬ জাতীয় ফুটবল দলে ডাক পান। এরপর খেলেছেন অ-১৭, ১৮, ১৯ ও সিনিয়র দলেও। ঘরোয়া পর্যায়ে খেলেছেন বিজেএমসি, আরামবাগ ও দিপালী যুব সংঘের হয়ে। জাতীয় দল ও বসুন্ধরা কিংসে (কিংসের সহ-অধিনায়ক তিনি) ৫ নম্বর জার্সি পড়ে খেলেন মাসুরা। লিগ আবারও শুরু হলে কিংসই চ্যাম্পিয়ন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মাসুরা। ডিফেন্সে খেলেন বলে তার গোল মাত্র ১টি (অ-১৮ দলের হয়ে)। বাংলাদেশের তৃষ্ণা চাকমা, ভারতের বালা দেবী, ব্রাজিলের থিয়াগো সিলভা এবং মার্সেলোর ভক্ত মাসুরা। সাবিনা খাতুনের মতো তিনিও অংশ নিয়েছেন ২০১১ ও ২০১৩ সালের মহিলা ফুটবল লীগে। এ প্রসঙ্গে একটা মজার কথা শোনান মাসুরা, ‘এখন আমি বসুন্ধরা কিংসের হয়ে লীগ খেলছি। সেই দলের কোচ মাহমুদা শরীফা অদিতি। তার সঙ্গে আমি ২০১৩ সালের লীগে আরামবাগের হয়ে খেলেছি! মাসুরার ভবিষ্যত লক্ষ্য? ‘বাংলাদেশের মহিলা ফুটবল অনেক এগিয়ে গেছে, আগামীতে আমরা এশীয় মানে যেতে চাই।’ মাসুরা কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কাবাডি খেলোয়াড়ও বটে। ২০১৫ সালে বিচ কাবাডি গেমসে অংশ নেন বিজেএমসির হয়ে। সেখানে তার খেলা দেখে কোচ জলিল তাকে জাতীয় দলে ডাকেন। এর আগে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসে অংশ নেন মাসুরা। সেই আসরে খেলেন হ্যান্ডবল, ভলিবল, খো খো এবং কাবাডি। স্কুলে পড়ার সময় ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়, লং জাম্প ও দড়ি লাফে অংশ নিয়ে বেশিরভাগ সময়ই প্রথম স্থান অধিকার করতেন মাসুরা।
×