ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মহামারী ও ধর্মবিদ্বেষ সেই একই কাহিনী

প্রকাশিত: ২১:০৪, ১০ জুন ২০২০

মহামারী ও ধর্মবিদ্বেষ সেই একই কাহিনী

চতুর্দশ শতাব্দীতে বিউবনিক প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ নামে এক ভয়ঙ্কর মহামারী ইউরোপ ও এশিয়ার বিশাল তল্লাটজুড়ে তা-ব চালায়। মহামারী একদিকে যেমন মানুষের অপরিমেয় দুর্ভোগ, দুঃখ-কষ্ট ডেকে আনে, অন্যদিকে তেমন এর মধ্য দিয়ে মানুষের ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ও বিদ্বেষের বর্বর অভিপ্রকাশও ঘটে। ব্ল্যাক ডেথ বা বিউবনিক প্লেগের সময় মহামারীর জন্য বলির পাঁঠা করা হয়েছিল ইহুদীদের। কোথাও অভিযোগ ছিল এরা কুয়ার পানিতে বিষ মিশিয়ে মহামারী ঘটিয়েছে। আবার কোথাও বলা হয়েছিল যে, খ্রীস্টানদের প্রতি বিদ্বেষবশত তারা এই মহামারী সৃষ্টি করেছে। বলাই বাহুল্য, মধ্যযুগের ইউরোপে এই প্লেগের কারণে বহু জায়গায় ইহুদীরা খ্রীস্টানদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ইতিহাসে যখনই কোথাও মহামারী হয়েছে তখনই বিপন্ন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে এবং তারা হামলার শিকার হয়েছে। তাই দেখা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটলে ইংরেজ বংশোদ্ভূত প্রটেস্ট্যান্ট আমেরিকানরা চড়াও হয়েছিল আইরিশ বংশোদ্ভূত ক্যাথলিক আমেরিকানদের ওপর। গড়ে ওঠে নেটিভদের আন্দোলন। সেই আন্দোলনে রোমান ক্যাথলিক ধর্ম ও মহামারী উভয়ের বাহক হিসেবে চিহ্নিত হয় আইরিশ অভিবাসীরা। তারা প্রটেস্ট্যান্ট এ্যাংলো-আমেরিকানদের প্রতি এই দ্বিবিধ হুমকির জন্য দায়ী হিসেবে আক্রান্ত হয়। এ তো গেল ইউরোপ ও আমেরিকার কথা। এবার দৃষ্টি দেয়া যাক আধুনিক ভারতের মহামারীর ওপর। ২০০৪ সালে ইতিহাসবিদ প্রশান্ত কিদামবির একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ‘আরবান হিস্ট্রি’ নামক সাময়িকীতে। ১৮৯৬ সালে মুম্বাই নগরীতে প্লেগের প্রভাব কি ছিল সেটাই নিবন্ধের বিষয়বস্তু। তিনি লক্ষ্য করেন যে, সে সময় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্লেগ বিরোধী নীতির মধ্যে সুস্পষ্ট শ্রেণীগত পক্ষপাতিত্ব ছিল। সেই নীতি প্রধানত নগরীর আশপাশের মহল্লা এবং শহরের গরিবদের ওপর হামলার রূপ পরিগ্রহ করে। ব্রিটিশরাও ভারতের এলিট শ্রেণী স্থির নিশ্চিত হয়েছিল যে, নগরীর বস্তিবাসীরাই ছিল প্লেগ রোগের প্রধান বাহক। প্রকৃত আঘাতটা নেমে এসেছিল অপেক্ষাকৃত গরিব এলাকাগুলোর ওপর শত শত কুঁড়েঘরে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করা হয় কিংবা ধূলিসাত করা হয়। এর ফলে হাজার হাজার মুম্বাইবাসী সহায় সম্বলহীন-নিঃস্ব হয়ে পড়ে। গত বছর ইতিহাসবিদ ডেভিড আর্নল্ড ১৯১৮ সালে ভারতে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর ওপর একটি নিবন্ধ ‘ট্রানজ্যাকশনস অব দি রয়াল হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি’ সাময়িকীতে প্রকাশ করেন। সেই মহামারীতে উপমহাদেশে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি লোক মৃত্যুবরণ করেছিল। মহামারীতে অধিকাংশই আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণ করেছিল গরিবরা। আর্নল্ড মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর স্যানিটারি কমিশনারের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন : ‘মহামারীর সংহারীরূপ সবচেয়ে প্রকটভাবে দেখা গিয়েছিল গ্রামগুলোতে। সেখানে জনগণের পূর্ণ অসহায়ত্বের সঙ্গে খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব যুক্ত হয়ে এমন এক বিপর্যয়কর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, যা বর্ণনার অসাধ্য।’ ওদিকে পাঞ্জাবের স্যানিটারি কমিশনারের মন্তব্য ছিল এই যে, ‘সবচেয়ে দুর্ভোগ ও দুর্দশাক্লিষ্ট মানুষজন ছিল গরিব-দুঃখীরা ও গ্রামীণ শ্রেণীগুলো, যাদের আবাসিক অবস্থা, চিকিৎসা সুবিধা, খাদ্য ও বস্ত্রের অবস্থা শোচনীয়।’ ভারতে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব চতুর্দশ শতকের ইউরোপের ‘ব্ল্যাক ডেথ’ এবং ব্রিটিশ শাসনের সময়কার মহামারীগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান মহামারীর জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে টার্গেট করা হয়েছে। অন্যদিকে শ্রমজীবী শ্রেণীগুলো, যারা কোনক্রমে জীবন ধারণ করে এক অতি নাজুক অবস্থায় কালাতিপাত করছে, তারাও বিপুল দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। এমনটি কি হওয়ারই কথা ছিল? মধ্যযুগের ইউরোপে রাষ্ট্রগুলো ছিল ধর্মান্ধভাবে খ্রীস্টান শ্রেষ্ঠত্ববাদের প্রতি নিবেদিত। ভারত তো আর সেই সব দেশের মতো নয়, বরং তত্ত্ব¡গতভাবে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ব্রিটিশ রাজ তো মর্মে মর্মে ছিল স্বৈরতান্ত্রিক। স্বাধীন ভারত তো আর তা নয়, বরং এটি এক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং এই রাষ্ট্রের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ তত্ত্বগতভাবে ভোটারদের কাছে দায়বদ্ধ, যাদের মধ্যে দরিদ্র ও বিপন্ন জনগোষ্ঠীও রয়েছে। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী নিজে জনসমক্ষে যেসব বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে ভারত সরকারের শ্রেণীগত পক্ষপাতিত্বের লক্ষণীয় অভিপ্রকাশ ঘটেছে। লকডাউনের প্রয়োজন ছিল। তবে নিশ্চয়ই এর পরিকল্পনা আরও ভালভাবে করা যেতে পারত। দক্ষিণ আফ্রিকার অর্থনীতি ভারতের মতো গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে আগত শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। দক্ষিণ আফ্রিকায় এই বহিরাগত শ্রমিকদের নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য পুরো তিনদিন সময় দেয়া হয়েছিল। এই একই কাজটা ভারতে করা যেতে পারেনি কেন? যদি তা করা হতো, তাহলে লকডাউন বলবত হওয়ার আগে নাগরিকরা যে যেখানে থাকতে চেয়েছিল, সেখানে তাদের পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রচলিত ট্রেন ও বাস নেটওয়ার্ককে কাজে লাগাতে তেমন কোন অসুবিধা হতো না। শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নিজস্ব নিরাপত্তা জাল রয়েছে যা সরকারের ওপর নির্ভরশীল নয়, যেমনÑ বিনিয়োগ, সঞ্চয়, আয় অবসর ভাতা ও আবাসন। এই সম্পদগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত ঘটনাবলীর দ্বারা সৃষ্ট অপ্রত্যাশিত সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। গ্রামাঞ্চল থেকে শহরগুলোতে আসা লাখ লাখ মেহনতী মানুষের এজাতীয় কোন নিরাপত্তা জাল নেই। সে কারণেই হঠাৎ করে কর্মহীন হয়ে পড়লে তারা বরং গ্রামেই ফিরে যাবে। সেখানে তারা জমিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে এবং নিজ নিজ পরিবারের সাহায্য-সমর্থনের যে কাঠামো আছে, তার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্য-বিবৃতিতে বার বার যা উল্লেখ করেছেন তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও তাদের নিরাপত্তার কথাই তার মনে প্রাধান্য লাভ করেছিল। এ ছিল এক বেদনাদায়ক বিচ্যুতি। বাস্তবিকই হাজার হাজার ভারতীয় সুদূর গ্রাম অভিমুখে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টাকালে তাদের প্রতি পুলিশ যে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, তা কোভিড-১৯ এর দৃশ্যমান স্মৃতি হিসেবে স্থায়ী হয়ে থাকবে। রাষ্ট্রের শ্রেণীগত পক্ষপাতিত্বের আরেকটি নিদর্শন হলো এই যে, লকডাউন বলবত হওয়ার পর গুজরাটি তীর্থযাত্রীদের সুদূর উত্তরাখ- থেকে নিজ রাজ্যে ফিরিয়ে আনার জন্য বিলাসবহুল বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভারতের কোচিং সেন্টারগুলোর রাজধানী হিসেবে পরিচিত কোটা থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছাত্রদের তাদের নিজ রাজ্য উত্তর-প্রদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য অতটা উন্নত না হলেও অন্যান্য বাসের ব্যবস্থা করা হয়। অথচ আগে থেকেই নানাবিধ সমস্যায় ভারাক্রান্ত রাজ্য সরকারগুলো মরিয়া হয়ে আবেদন-নিবেদন করা সত্ত্বেও কেন্দ্র সরকার শহরগুলো থেকে সহায় সম্বলহীন শ্রমিকদের নিজ নিজ জেলায় ফিরিয়ে নেয়ার জন্য ট্রেনের ব্যবস্থা করেনি। এদিকে সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর প্রতি ভারতীয় সমাজের পক্ষপাতিত্বের অভিপ্রকাশ নানাভাবেই ঘটেছে। নিজামউদ্দীনের মারকাজে তবলিগী জামাতের সমাবেশ ছিল চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ। এই সমাবেশ যারা হতে দিয়েছিল এবং তাতে উৎসাহ যুুগিয়েছিল তাদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। অথচ দোষী ব্যক্তিদের দায়ী না করে এ ঘটনাটিকে ভারতীয় মুসলমানদের ব্যাপক পরিসরে ঘৃণ্য বা নিকৃষ্টরূপ দেয়ার একটা অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। শাসক দলের সদস্যরা যেসব কটূক্তি ও অশালীন ভাষা ব্যবহার করেছেন, এক শ্রেণীর টেলিভিশন চ্যানেল সেগুলো নির্লজ্জভাবে বড় করে প্রচার করেছে। এই চ্যানেলগুলো সমাবেশের এ ঘটনা নিয়ে একের পর এক এমন সব অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছে মর্মবস্তুর দিক দিয়ে সেগুলো স্থ’ল সাম্প্রদায়িক। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের মুখপাত্ররাও তাদের দৈনন্দিন ব্রিফিংয়ে ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। এমন কিছু না করার পরামর্শ তাদের উদ্দেশে এত বিলম্বে জারি করা হয় যে ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। সারা ভারত থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে যে, স্রেফ ধর্ম বিশ্বাসের কারণে মুসলমান বিক্রেতা, শ্রমিক, কারিগরদের বয়কট করা হচ্ছে। মুসলমানবিরোধী ধর্মবিদ্বেষের এমন আশঙ্কাজনক বিস্তারের প্রতি প্রধানমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভূমিকা রেখেছেন। একদিকে নিজের মৌনতা অবলম্বন ও বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে তিনি এর প্রসারে সরাসরি অবদান রেখেছেন। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর কর্মকর্তাদের টুইটে কিছু কঠোর মন্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী এই মর্মে এক উপশমমূলক টুইট করেন যে, করোনা রোগটি কোন জাতি বা ধর্ম চেনে না। কিন্তু ততদিনে সারাদেশের শহর ও গ্রামের লাখ লাখ মানুষ সাম্প্রদায়িকতার ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে গেছে। করোনাভাইরাস মহামারী কিছু কিছু দিক দিয়ে ভূমিকম্প কিংবা সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের অনুরূপ। এটা এমন হঠাৎ করেই এসেছে যে, রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়েই অপ্রস্তুত অবস্থায় থেকেছে। কিন্তু এটা আঘাত হানার পর এর ব্যাপকতা যখন অনুধাবন করা গেছে, তখন আমাদের অধিকতর বিচক্ষণতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাড়া দেয়া উচিত ছিল। তার পরিবর্তে আমাদের নামসর্বস্ব গণতান্ত্রিক সরকার স্বৈরাচারী ব্রিটিশ রাজের মতোই গরিবের প্রতি নির্বিকার ঔদাসীন্যের পরিচয় দিয়েছে। আর আমাদের তথাকথিত আধুনিক সমাজ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি যে ধরনের বিদ্বেষপ্রসূত ঘৃণার অভিপ্রকাশ ঘটিয়েছে, তা একদা ছিল মধ্যযুগীয় ইউরোপের বৈশিষ্ট্য। সূত্র : দি টেলিগ্রাফ
×