ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লিবিয়ায় ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন চালাত পাচারকারীরা

প্রকাশিত: ২২:১৬, ৯ জুন ২০২০

লিবিয়ায় ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন চালাত পাচারকারীরা

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ মানবপাচারের শিকার ২৬ বাংলাদেশীকে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে হত্যার ঘটনায় ২২ মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ২২ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম। আইজিপি বেনজীর আহমেদের কঠোর নির্দেশে র‌্যাব, ডিএমপি, সিআইডি, পিবিআইসহ বাংলাদেশ পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সব ইউনিট একযোগে অভিযানে নেমেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সোমবার সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিট রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এক নারীসহ আরও ৩ মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে- সোহাগ হোসেন (৫০), খালিদ চৌধুরী (৪২) ও সানজিদা (৩৮)। সিআইডির সূত্র জানায়, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশী হত্যাকা-ের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় মানবপাচারে জড়িত চক্রের সদস্যদের ধরতে সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম ইউনিট ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করছে। সেই অভিযানের অংশ হিসেবে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে সিআইডি বাদী হয়ে পল্টন থানায় ২টি ও বনানী থানায় একটি মানবপাচার মামলা দায়ের করেছে। এ পর্যন্ত মানবপাচার সংক্রান্ত সারাদেশে দায়েরকৃত ১২টি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। ইতোমধ্যেই কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদিকে রবিবার রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশী হত্যা ও মানবপাচারের ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে- বাদশা মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া, আকবর আলী, সুজন, নাজমুল হাসান ও লিয়াকত শেখ ওরফে লিপু। এ সময় তাদের কাছ থেকে চারটি পাসপোর্ট, দুইটি মোবাইল ফোন ও টাকার হিসাবসম্বলিত দুইটি নোট বুক উদ্ধার করা হয়। সোমবার সকালে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোঃ আবদুল বাতেন জানান, মানবপাচারের ঘটনায় ভিকটিমদের ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর হয়ে লিবিয়াতে পাচার করার পরিকল্পনা, প্রক্রিয়া করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঢাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করার কারণে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দায়েরকৃত মামলাসমূহের ছায়া তদন্ত শুরু করে। তিনি জানান, লিবিয়ার বিভিন্ন স্টেটে কাজ ও লিবিয়া হতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশী দালালরা অন এ্যারাইভাল ও ভিজিট ভিসার মাধ্যমে লোকজনকে লিবিয়ায় পাচার করে। লিবিয়ায় পাচার করে ভিকটিমদের লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রেখে অমানুষিক শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করে। নির্যাতিত ভিকটিমদের কান্নাকাটি, আকুতি মিনতি করা অডিও অথবা সরাসরি মোবাইলে কথাবর্তা বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজনদের পাঠায় ও টাকা দাবি করে। ভিকটিমদের বাঁচাতে তার আত্মীয়-স্বজন কোন কোন ক্ষেত্রে ভিটাবাড়ি বিক্রি করে টাকা পাঠায়। ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আব্দুল বাতেন জানান, নিহত মাদারীপুরের ৭ জনকে বাংলাদেশ হতে লিবিয়াতে আমির হোসেনের কাছে পাচার করেছিল তার ভাই গ্রেফতারকৃত আকবর হোসেন। গ্রেফতারকৃত বাদশা মিয়া ১৩ বছর যাবত লিবিয়াতে অবস্থান করে। লিবিয়ার বেনগাজি, জোয়ারা শহরে তার নিজস্ব ক্যাম্প আছে। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে সে নিয়মিত লিবিয়াতে মানবপাচার করে। পাচারকৃত বাংলাদেশীদের তার ক্যাম্পে আটক রেখে ইতালিতে সমুদ্রপথে পাচার করে। মাদারীপুরের নিহতদের মধ্যে ৪ জনকে তার ক্যাম্পে আটক রেখে ত্রিপোলিতে পাচার করার এক পর্যায়ে এ হত্যাকান্ড ঘটে। আবদুল বাতেন জানান, গ্রেফতারকৃত জাহাঙ্গীর আলম ঢাকাতে অবস্থান করে নিজস্ব কায়দায় বেনগাজিতে মানবপাচার ছাড়াও স্থানীয় অন্য দালালদের কাছ থেকে প্রাপ্ত পাসপোর্টগুলো স্ক্যান করে সফট কপি দুবাই এবং লিবিয়াতে প্রেরণ করে টুরিস্ট ভিসা, অন এ্যারাইভাল মোয়াফাকা সংগ্রহ করে। গ্রেফতারকৃত সুজন ভিকটিম ইছার উদ্দিন, বিজয় ও মোঃ সজলদের লিবিয়ায় পাঠায়। ২৮ মে লিবিয়ায় ট্র্যাজিডিতে ভিকটিম মোঃ সজল আহত হয়ে লিবিয়ায় এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। নিখোঁজ মোঃ বিজয় ও ইছার উদ্দিনের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। গ্রেফতারকৃতদের পল্টন থানা ও তেজগাঁও থানায় মানবপাচার ও সন্ত্রাসবিরোধী আইনে রুজুকৃত মামলায় সোমবার রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশী হত্যাকান্ডের পর মানবপাচার ও সন্ত্রাস দমন আইনে সারাদেশে ২২টি মামলায় রবিবার পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সে হিসেবে সোমবার সিআইডি তিনজন ও ডিবি পুলিশ ৬জনকে গ্রেফতার করে। এ নিয়ে নয় জনকে ধরে মোট গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়াল ২২ জনে। ডিবি পুলিশ জানায়, ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ উপশহরের মরুভূমিতে ২৬ জন বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এতে ১১ জন মারাত্মক আহত হয়। লিবিয়া এবং ইতালিতে অভিবাসী হতে যাওয়া শত শত বাংলাদেশী বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনে আহত, নিহত ও চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন। এ সকল ঘটনায় ভিকটিমদের আত্মীয় স্বজনদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে মাদারীপুর জেলা, কিশোরগঞ্জ জেলা এবং ডিএমপির পল্টন ও তেজগাঁও পৃথক থানায় ২২টি মামলা করা হয়। লিবিয়ায় বাংলাদেশীদের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না ॥ আইজিপি পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, আমাদের দেশের নাগরিকদের প্রতারণার মাধ্যমে যারা বিদেশে নিয়ে গেছে, যাদের কারণে লিবিয়ায় তাদের এই নির্মম মৃত্যু ঘটেছে, তাদের একজনকেও ছাড় দেয়া হবে না। তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে এই চক্রের প্রত্যেক সদস্যকে আইনী প্রক্রিয়ায় কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। রবিবার রাতে পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এক মতবিনিময় সভায় আইজিপি বেনজীর আহমেদ জানান, ‘যাতে ভবিষ্যতে কোন বাংলাদেশীকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে, তার জীবন নিয়ে খেলার দুঃসাহস কোন মানুষ দেখাতে না পারে। দেশ ও বিদেশে যেখানেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, এদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করা হবে। হত্যাকান্ডের বিষয়টি অত্যন্ত মর্মান্তিক উল্লেখ্য করে বেনজীর আহমেদ জানান, স্বজনদেরকে যারা ভাই-বোন, পিতা-মাতা হারা করেছে, তাদের কোনও মাপ নেই। অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বজনদের কান্নার দাগ শুকানোর আগেই, এই অপরাধীচক্রকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক আইনী পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দেন আইজিপি। মাঠ প্রশাসনকে কঠোর বার্তা দিয়ে আইজিপি বলেন, এদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার পর আমি দ্বিতীয়বার তোমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব, এর আগে নয়। পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মোঃ সোহেল রানা জানান, আইজিপির কঠোর নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে র‌্যাব, ডিএমপি, সিআইডি, পিবিআইসহ বাংলাদেশ পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট সব ইউনিট একযোগে অভিযানে নেমেছে।
×