ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ১৯:৩৪, ৯ জুন ২০২০

ঢাকার দিনরাত

যে শহরে বসবাস আমাদের সে শহর সম্পর্কে কি ভিনদেশীরা বেশি জানবে! ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট চমকে যাওয়ার মতো খবর দিল। ‘মরণঘাতী স্রোত’ শিরোনামের নিবন্ধে বলা হয়েছে আইসিডিডিআর,বির কর্মকর্তা জন ক্লেমেন্সের অনুমান, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতেই করোনা সংক্রমণের সংখ্যা ইতোমধ্যে সাড়ে সাত লাখ ছাড়িয়ে থাকতে পারে। তবে সরকারের তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ হাজার ৩৯১ জন; যাদের প্রায় অর্ধেকই ঢাকার। অবশ্য আইসিডিডিআর,বি এ প্রতিবেদনের বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, অধ্যাপক ডি ক্লেমেন্সের বক্তব্য খন্ডিতভাবে ব্যবহার করেছে ইকোনমিস্ট। তারা বলছে, তাদের মহাখালী অফিসের দুই হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ৪-৫ শতাংশ সংক্রমিত। সেটা সম্ভবত মহাখালী অফিস থেকে হয়নি। সে হিসেবে ঢাকায় আক্রান্তের সংখ্যা কত বেশি হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি ইকোনমিস্টকে ঢাকার জনসংখ্যার চার থেকে পাঁচ শতাংশ আক্রান্ত ধরে এই ধারণা দিয়েছেন। বলাবাহুল্য এই সংখ্যা কোন জরিপের ফল নয়। রেড জোনের জর্নাল লকডাউন শিথিল করার ঘোষণায় ঢাকা তার পুরনো চেহারা ফিরে পেয়েছে অনেকটাই। তবে এই সময়টাতেই আবার করোনোভাইরাস পরিস্থিতির অবনতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই সরকার এবার নতুন মাত্রায় এলাকাভিত্তিক লকডাউনের (অবরুদ্ধ) মতো বিধিনিষেধ আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে। সংক্রমণ বিবেচনায় বিভিন্ন এলাকাকে ‘রেড, ইয়েলো এবং গ্রিন জোনে’ ভাগ করে ‘রেড জোনে’ লকডাউন বা চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। যেসব এলাকায় এক লাখ মানুষের মধ্যে ৩০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে সেসব এলাকা রেড জোন বা বিপজ্জনক বলে ঘোষিত হবে, এবং সেখানে লকডাউন কড়াকড়িভাবে আরোপ করা হবে। চলতি সপ্তাহেই ঢাকায় এর কাজ শুরু হয়েছে। আশা করছি পরের সপ্তাহে রেড জোনের জর্নাল লিখে উঠতে পারবেন অনেকেই। তবে ঢাকাবাসীর মনে ভয়ঙ্কর যে দুঃস্বপ্ন বার বার হানা দিচ্ছে বলে ধারণা করি সেটি হলো প্রিয়জন-স্বজনহীন পরিবেশে নভোচারীর মতো পোশাকে (পিপিই) সজ্জিত গুটিকতক লোকের মাধ্যমে সমাধিস্থ হওয়ার দৃশ্য। করোনা সন্দেহে মাকে রাস্তায় ফেলে গেলেন ছেলে, পুলিশ নিল হাসপাতালে। এমন সংবাদ পড়ে রবিবার সকালবেলা খানিকটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। মৃত্যুভয় মানুষকে কি এমন অমানুষ করে তোলে! সৃষ্টির সেরা জীব বলে গর্বিত মানুষকে মহামারী আর কত নিচে নামাবে? কয়েক দিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন ৫৫ বছর বয়সী মনিরা বেগম। রাজধানীর মিরপুর এলাকার একটি বস্তিতে ছেলের সঙ্গে থাকেন তিনি। করোনার উপসর্গ থাকায় আক্রান্ত সন্দেহে তাঁকে অন্য কোথাও যাওয়ার পরামর্শ দেন বস্তিঘরের মালিক। এরপর নিজের ছেলেই তাঁকে শনিবার দুপুরে ফেলে যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে। সেখানে ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ফুটপাথে পড়ে থাকেন হতভাগ্য মনিরা বেগম। এরপর বিষয়টি নজরে আসার পর দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করে পুলিশ। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি করোনামুক্ত হয়ে দুই হাজার পুলিশ ইতোমধ্যে কাজে যোগ দিয়েছেন। ঢাকার সবই শঙ্কা আর বিপন্নতায় মোড়ানো নয়। আছে অবাক করা সুসংবাদও। প্রথমত বলতেই হবে করোনার সঙ্গে বসবাস করার একটা দৃঢ় মনোবল লক্ষ্য করা যাচ্ছে অনেকের মধ্যেই। স্বাস্থ্যবিধি শতভাগ মেনে ঘরের বাইরে সকাল-সন্ধ্যা থাকছেন বহু কর্মজীবী মানুষ। অন্যদিকে করোনাক্রান্ত রোগীর জন্য সহমর্মিতা বাড়ছে, আগের মতো ভয়ে পিছপা হচ্ছে না মানুষ। এরই মধ্যে উত্তরায় চালু হয়ে গেছে জাপান-ইস্টওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট কোভিড হাসপাতাল। একটি পত্রিকায় অন্যরকম সুসংবাদ পেলাম। এটি উল্লেখ করা দরকার। তাতে বলা হয়েছে লকডাউনে ‘সুখী ও স্বস্তিতে’ ঢাকাকে ঘিরে থাকা ৫ নদ-নদীর কথা। করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের ঘোষণা করা সাধারণ ছুটির মধ্যে ঢাকার আশপাশের পাঁচটি নদ-নদীর পানির মানের উন্নতি হয়েছে। বিভিন্ন নিরিখে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর পানির মান দ্বিগুণেরও বেশি উন্নত হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণে এ চিত্র উঠে এসেছে। একজন পানি বিশেষজ্ঞ জানান, ‘ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষণের মূল দুই উৎসের অন্যমত শিল্পবর্জ্য। করোনার সাধারণ ছুটির সময় কলকারখানা বন্ধ ছিল। তাই স্বভাবতই পানির মান বাড়বে, এটা প্রত্যাশিত। তবে দূষণের আরেক উৎস ওয়াসার পয়োবর্জ্য বন্ধ হয়নি। এটি বন্ধ হলে পানির মান আরও ভাল হতো।’ মহামারী ও দস্তয়েভস্কি আলবেয়ার কামু আস্ত একটা উপন্যাসই লিখেছিলেন মহামারী বিষয়ে প্লেগ নামে। মহামারী নিয়ে বিশ্বসাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠলে কামুর নামটিই বেশি উচ্চারিত হয়। যদিও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং হোসে সারামাগো, এ দুজনের দুটি এ সংক্রান্ত উপন্যাস বহুল পঠিত। উপন্যাস দুটির নাম যথাক্রমে ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ ও ‘ব্লাইন্ডনেস’। বাংলা উপন্যাসে কি সর্বপ্রথম শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের দ্বিতীয় পর্বে এসেছিল প্লেগের সংক্রমণের ভয়ে রেঙ্গুনে কোয়ারেন্টাইনের কথা? বঙ্কিমের রচনায় যদিও রয়েছে মড়কের বিবরণ। তবে দেশী হোক বা বিদেশী, এসব উপন্যাসই বাস্তব পরিস্থিতিরই বিবরণ। কোনটিই কল্পিত মহামারী নয়। কল্পনায় অভিনব মহামারীর বিবরণের প্রসঙ্গ উঠলে সবার আগে আসবে নিশ্চয়ই দস্তয়েভস্কির নাম। অবশ্য এটির উল্লেখ বিশেষ একটা দেখি না। আমার প্রিয় লেখক, অন্যতম বিশ্বসেরা ঔপন্যাসিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির জন্মই এক অর্থে ভয়ঙ্কর মহামারীর অভিঘাতের ভেতর। ১৮২১ সালে তাঁর জন্মের আগের বছর কলেরা চূড়ান্ত রূপ নিলেও মহামারীটির সূচনা হয়েছিল দস্তয়েভস্কির নিজের দেশ রাশিয়া থেকেই। তাঁর দশ লাখ স্বদেশবাসীকে কেড়ে নেয় কলেরা, আর গোটা বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ছিল তেইশ লাখের মতো। লেখকের জীবদ্দশায় আরেকটি মহামারী হয়েছিল, সেটি ১৮৫৫ সালে। এই তৃতীয় প্লেগ মহামারী শুরু হয়েছিল অধুনা করোনার মতোই চীন থেকে। দেড় কোটি মানুষ তার শিকার হয়, তবে ভারতবর্ষে মহামারীর রূপ ছিল মহাপ্রাণঘাতী। রাশিয়ান ফ্ল মহামারীটি হয়েছিল অবশ্য ফিওদরের মৃত্যুর আট বছর পর। এই মহান লেখকের লেখায় গত সপ্তাহে এক মহামারীর উল্লেখ পেয়ে যাবো, এমনটি ভাবিনি। চলমান করোনা মহামারীকালে তাঁর ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসটির ভেতর তাই ‘কল্পিত’ মহামারীর বয়ান আমাকে স্তম্ভিত করেছে। পরে জানতে পারি তুরস্কের লেখক ওরহান পামুকও বিষয়টি তুলে ধরেছেন তাঁর একটি আত্মআলোচনাধর্মী লেখায়। মহামারী বিষয়ক উপন্যাস লিখতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তিনি কথাসাহিত্যে মহামারীর বিবরণ সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। তবে দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে বর্ণিত মহামারীটিকে পামুক ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন, সেটি মোটেই প্লেগ নয়, অন্যকিছু। একেবারে অভিনব ও রক্তহিম করে দেয়ার মতো আজব এক মহামারী। রীতিমতো বিভীষিকা। যেখানে ভাইরাস নয়, মানুষই মানুষকে হত্যার নৈরাজ্যে মেতে ওঠে। সে প্রসঙ্গেই আসছি। মনে হতে পারে একেবারে অযাচিতভাবেই মহামারী প্রসঙ্গটির প্রবেশ বা অনুপ্রবেশ ঘটেছে দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে। যদিও নির্বাসনদ- ভোগরত এবং অসুস্থতার শিকার নায়কের দুঃস্বপ্নে এই অভিনব মহামারীর বিস্তার নিয়ে কী আর বলা যায়, বাতিলই বা কীভাবে করা চলে! উদ্ধৃতি দিলে পরিষ্কার হবে বিষয়টি। ঢাউশ উপন্যাসটির একবারে শেষ প্রান্তে রয়েছে এর বিবরণ। সারা পৃথিবীতে গুটিকয়েক মানুষই কেবল ওই মহামারী থেকে অব্যাহতি পেলেন, ‘তাঁরা ঈশ্বরের মনোনীত, শুদ্ধচরিত্রের মানুষ।’ জ্বর ও বিকারের ঘোরে রাস্কোল্নিকভ্ স্বপ্নে দেখেছে এই মহামারীর বিস্তার। লেখা হয়েছে: ‘কোথা থেকে এক ধরনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রোগজীবাণু দেখা দিয়েছে, মানুষের দেহের ভেতর তারা বাসা বাঁধছে। কিন্তু ঠিক জীবাণু এরা নয়, এরা প্রেতযোনি, যথেষ্ট বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। যে সমস্ত মানুষের দেহে এরা বাসা বাঁধছে তারা সঙ্গে-সঙ্গে ভূতগ্রস্ত ও উন্মাদ হয়ে পড়ছে। একের পর এক লোকবসতি, শহরের পর শহর, পুরোপুরি একেকটা জাতি এই রোগের কবলে পড়ে গেল, উন্মাদ হয়ে গেল। সবাই আশঙ্কাগ্রস্ত, কেউ কাউকে বুঝতে পারে না, প্রত্যেকে ভাবছে সত্য একমাত্র তারই অধিগত। একে অন্যকে দেখে কষ্ট পাচ্ছে, বুক চাপড়াচ্ছে, কাঁদছে, অসহায়ের মতো হাত-পা ছুড়ছে। কেউ জানে না কার বিচার করবে, কীভাবে করবে। কোনটা ভাল কোনটা মন্দ এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে একমত তারা হতে পারছে না। অর্থহীন বিদ্বেষের জ্বালায় একে অপরকে হত্যায় মেতে উঠছে। বিশাল বিশাল সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটিয়ে এক দল আরেক দলের ওপর আক্রমণের উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু সেনাবাহিনী অভিযানে নামার পথেই আচমকা নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে মেতে উঠছে, বাহিনীর সারি ভেঙে পড়ছে, সৈন্যরা একে অন্যকে আক্রমণ করছে, নিজেদের মেরে-কেটে সাফ করছে, কামড়ে ছিঁড়ে টুকরোটুকরো করে খেয়ে ফেলছে।...’ লক্ষণীয় দস্তয়েভস্কি বর্ণিত মহামারীর ভাইরাসটির লক্ষ্য হলো মানুষের মস্তিষ্ক। তাতে মানুষ উন্মাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে এবং নিজেরাই নিজেদের মেরে সাফ করছে ঝাড়েবংশে। লেখকের কল্পনাশক্তিকে ইন্টারেস্টিং মনে না হওয়ার কারণ নেই। তৃতীয় প্লেগ মহামারীর সময়ে তিনি পরিণত যুবক, সাইবেরিয়ায় দ- ভোগ করে আসা মানুষ, যিনি কয়েক বছরের মধ্যেই হাত দেবেন এই ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসটি রচনায়। সেখানে শেষভাগে থাকবে সাইবেরিয়ার কারাগারের গল্প এবং চকিত ‘কল্পিত’ মহামারীর উল্লেখ। মহামারীর অভিঘাত লেখকদের লেখায় আসবে, হয়ত আগামীতে এই করোনাভাইরাস নিয়ে রচিত হবে মহৎ কোন উপন্যাস। সে বাংলা ভাষাতেও হতে পারে। এবারে অন্য কথা। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে ‘ভাইরাস ভার্সেস স্যাপিয়েন্স’ নামে একটি কবিতা পোস্ট করি ফেসবুকে। দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে মহামারীর বিবরণ পাঠের পর আমার ওই কবিতাটি আরেকবার পড়ি। সেখানে করোনাভাইরাসের জবানিতে বলা হয়েছে অভিনব এক ভাইরাসের কথা। সেটিরও লক্ষ্য হবে মানুষের মস্তিষ্ক। আগ্রহী পাঠকদের জন্য তুলে দিলাম। ‘করোনাভাইরাস আবার বলতে শুরু করে আমাদের গুরুভাই মানবসমাজে মেশার দিনক্ষণ করেনি এখনও ঠিক বাতাসে সাঁতার কাটা তার একমাত্র হবি পাখির ঝাঁকের মতো উড়ে যাবে তারা খুব নিচে দিয়ে মানুষের মাথা ছোঁয়া উচ্চতায় এমনিতে ভারি সুবোধ, তবে বিরক্ত হলে মানে বাধা পেলে বদলে যায় তারা, আর হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর আমাদের গুরুভাইয়ের ধৈর্য্য বড় কম, বড়ই অস্থির অল্প সময়ের মধ্যে তারা পৌঁছে যাবে সোজা মগজের কোষে আর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে ধমনীর এই তোমরা, মানে স্যাপিয়েন্স তার গালভরা এক নাম দিয়েছিলে একদিন ‘ব্রেন স্ট্রোক’ তাই সাবধান, ওদের পথে বাধা হয়ো না হে ওরা বাতাসে ভাসুক উড়ুক সাঁতরাক যতযুগ মন চায়...’। ৭ জুন ২০২০ [email protected]
×