ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ শফিকুল ইসলাম

ছয় দফার মর্মকথা ও ছোট শিশু শেখ রাসেলের স্মৃতি

প্রকাশিত: ১৬:২৬, ৭ জুন ২০২০

ছয় দফার মর্মকথা ও ছোট শিশু শেখ রাসেলের স্মৃতি

আজ ৭ জুন, ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস এবং ছয় দফা আন্দোলনের ৫৪তম বার্ষিকী। এই দিবস স্মরণে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ বলা হয়ে থাকে এই ছয় দফাকে। আমি মনে করি ছয় দফা হলো একটি ভূখণ্ড ও জাতীয় পতাকা নির্মাণের দলিল। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করেন। এই ৬ দফাকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন-সংগ্রামই পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। ৬ দফা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় ছাত্র সমাজের ৫ দফা দাবি। পরে ১১ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত ও পরিচালিত হয়। এই ছয় দফাই আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তির বীজ বপন করে দিয়েছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ শোষকদের যেমন করে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে এই ভূখণ্ড থেকে বিতাড়ন করতে ঐকমত্য হয়েছিল, তেমনি ১৯৬৬ সালে ঘোষিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা পাকিস্তানীদের শাসন থেকে আমাদের মুক্ত করার মূলমন্ত্র হিসেবে জনমানুষের মাঝে স্বীকৃতি পায়। ৬ দফার প্রতিটি দফা বাংলার প্রত্যেকটি গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাংলার স্বাধীনতাকামী জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাবিগুলোর মধ্য অন্তর্নিহিত মর্মকথা ছিল বাংলার স্বাধীনতা। ৬ দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। ৬ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গৌরবময় কীর্তি ছিল ৬ দফা আন্দোলনের নেতৃত্ব। ৭ জুন ১৯৬৬, ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়। ওইদিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালী শহীদ হন (উইকিপিডিয়া)। শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার পক্ষে জনমত আদায়ের লক্ষ্যে সারা বাংলায় গণসংযোগ শুরু করেন। এ সময় তাকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট, খুলনা, পাবনা, ফরিদপুরসহ নানা স্থান থেকে বার বার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬ এর প্রথম তিন মাসে তিনি ৮ বার গ্রেফতার হন এবং জামিন পান। এরপর একই বছরের ৮ মে আবার গ্রেফতার হয়ে তিন বছর জাতির পিতা কারারুদ্ধ ছিলেন। (কারাগারের রোজনামচা) বঙ্গবন্ধুর জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে কারাগারে। ছয় দফাকে কেন্দ্র করে যখন বঙ্গবন্ধুকে বার বার কারাগারে যেতে হয়েছিল, তখন তার ছোট ছেলে শেখ রাসেল দুধের শিশু। কিছুই বুঝতে শেখেনি শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন শেখ হাসিনাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নিকট স্বাভাবিক মনে হলেও শেখ রাসেলের জন্য তা ছিল খুবই অস্বাভাবিক এবং নতুন অভিজ্ঞতা। সে তাঁর পিতার ভালবাসা ও মায়া মমতা থেকে বার বার বঞ্চিত হয়েছে। ১৮ মাসের শেখ রাসেল ধরে নিয়েছিল যে কারাগারই হলো প্রিয় আব্বার বাড়ি। ছোট শিশু শেখ রাসেলর বাবা থেকেও না থাকার মতো ছিল, তাই তার মাকেই আব্বা ডাকা শুরু করেছিল সে। আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু দিন শেষে একজন পিতাও ছিলেন। তখন ঈদে তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও। ভাল করে ঈদ করিও, না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে। পিতা শেখ মুজিব লিখেছিলেন, ‘দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে। এ থেকেই আমাদের উপলব্ধি হয় যে ছোট শিশু শেখ রাসেল কিভাবে তাঁর পিতার স্নেহ ও মমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠেছিল (কারাগারের রোজনামচা)। প্রধানমন্ত্রী তাঁর এক লেখায় লিখেছেন- আব্বা ওর জন্মের পর পরই জেলে চলে গেলেন। ৬ দফা দেয়ার কারণে আব্বাকে বন্দী করল পাকিস্তানী শাসকরা। রাসেলের বয়স তখন মাত্র দেড় বছরের কিছু বেশি। কাজেই তার তো সব কিছু ভালভাবে চেনার বা জানারও সময় হয়নি। রাসেল আমাদের সবার বড় আদরের; সবার ছোট বলে ওর আদরের কোন সীমা নেই। ও যদি কখনও একটু ব্যথা পায় সে ব্যথা যেন আমাদের সবারই লাগে। আমরা সব ভাইবোন সব সময় চোখে চোখে রাখি, ওর শরীরে এতটুকু আঁচড়ও যেন না লাগে। কী সুন্দর তুলতুলে একটা শিশু। দেখলেই মনে হয় গালটা টিপে আদর করি। তিনি আরও লিখেছেন- আব্বা যখন ৬ দফা দিলেন তার পরই তিনি গ্রেফতার হয়ে গেলেন। রাসেলের মুখের হাসিও মুছে গেল। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে রাসেল আব্বাকে খুঁজত। রাসেল যখন কেবল হাঁটতে শিখেছে, আধো আধো কথা বলতে শিখেছে, আব্বা তখনই বন্দী হয়ে গেলেন। মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আব্বার মামলা-মোকদ্দমা সামলাতে, পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। সংগঠনকে সক্রিয় রেখে আন্দোলন-সংগ্রাম চালাতেও সময় দিতে হতো। (বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বার্ষিক প্রকাশনা ‘মাতৃভূমি’-২০১১)। ২৭ মে ১৯৬৭, বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, রেণুর শরীর ভাল নয়। পায়ে বেদনা, হাঁটতে কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখাতে বললাম। রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বছরের ছেলে আমাকে বলছে, ‘৬ দফা মানতে হবে- সংগ্রাম, সংগ্রাম-চলবে-চলবে... ‘ভাঙা ভাঙা করে বলে, কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম ‘ও শিখল কোথা থেকে?’ রেণু বলল, বাসায় সভা হয়েছে, তখন নেতাকর্মীরা বলছিল তাই শিখেছে। ’(কারাগারের রোজনামচা)’ পিতৃস্নেহহীন এক ধূসর সময় পার করেছিল সোনামণি শেখ রাসেল। ভাবতেই অবাক লাগে, এই নিষ্পাপ মায়াময়ী ছেলেটিকে রেহাই দেয়নি সেই নরপশুরা। কিভাবে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করছে কাপুরুষের দলেরা। ধিক্কার জানাতেও ঘৃণা হয়। এর চেয়ে আরও কি চরম খারাপ ভাষা আছে, যা প্রয়োগ করে ওদের নৃশংসতার নিন্দা জানানো যেতে পারে! ওই নির্মম হত্যার সঙ্গে জড়িত ঘাতকরা যারা বিদেশে পলাতক রয়েছে তাদের দেশে এনে বিচার না করা পর্যন্ত প্রিয় শেখ রাসালের আত্মা শান্তি পাবে না। যত দ্রুত হোক এদের ফিরিয়ে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। বঙ্গবন্ধুকে জেলে আটকে রেখেও পাকিস্তানী শাসক জাতির পিতার সাহস ও মনোবলে চিড় ধরাতে পারেনি। যা তাঁর প্রতিদিনের লেখাগুলো বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়। পাকিস্তানী সরকারের দমন-পীড়ন, নানা ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে ছয় দফার দাবিতে জাতির পিতা ছিলেন অনড়। ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘৬ দফা বাদ দিয়া কোন দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ হাত মেলাতে পারে না। আর করবেও না। ৬ দফা ছাড়তে পারব না। যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব। তিনি কোনদিন কোন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। এই অনমনীয় আপোসহীনতার জন্য আজকে আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। জাতির পিতা জন্মগ্রহণ না করলে হয়তবা পাকিস্তানী শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা আমাদের জন্য সুদূরপরাহত হয়ে যেত। মুজিববর্ষে আগামী ৭ জুন ২০২০ এ তাই আমাদের অঙ্গীকার হবে আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর সঠিক আদর্শ ধারণ করে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করব এবং দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করব যেখানে থাকবে না কোন জঙ্গীবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, ত্রাণ চুরি, মাদক, বৈষম্য এবং অবিচার। শিশু শেখ রাসেল আজ আমাদের মাঝে নেই, তবু বাংলাদেশ জুড়ে যে অসংখ্য শিশু বেড়ে উঠছে, তাদের মধ্যেই বেঁচে থাকবে শেখ রাসেল, সেই সব শিশুদের জন্য এক নিরাপদ ও শান্তির বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব। লেখক : শিক্ষক ও সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×