ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানী জলসবুজে পরিণত করার মহাপরিকল্পনা

প্রকাশিত: ২১:৪২, ৭ জুন ২০২০

রাজধানী জলসবুজে পরিণত করার মহাপরিকল্পনা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ পরিবেশের উন্নয়ন ও দূষণের মাত্রা কমাতে সরকারী- বেসরকারী উদ্যোগে নগর সবুজায়নের মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের পাশাপাশি রূপরেখা তৈরিরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে প্রথম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরুর পর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনে তা বাস্তবায়ন করা হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীকে জলসবুজে পরিণত করতে বিক্ষিপ্তভাবে যে সকল অপরিকল্পিত কাজগুলো রয়েছে সেগুলোকে একত্রে মহাপরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে আসতে পারলে ঢাকা ধূসর শহর থাকবে না। সবুজ শহরে পরিণত হবে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নগর বনায়নের মহাপরিকল্পনার শুভ সূচনা করেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম। শুক্রবার রাতে বেসরকারী সংগঠন গ্রীন সেভার্সের উদ্যোগে নগরবিদ ইকবাল হাবিবের সমন্বয়ে এই অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স প্রেসিডেন্ট ড. আকতার মাহমুদ, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট জালাল আহমেদ, ইনস্টিটিউট অব ফরেস্টার্স প্রেসিডেন্ট ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (সম্প্রসারণ ও কো-অর্ডিনেশন) মাহফুজ হোসেন মিরদাহ, নিসর্গী ও লেখক মোকাররম হোসেন, ইউএস ফরেস্ট সার্ভিস ইন বাংলাদেশ এর কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর আশরাফুল হক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ফ ম জামাল উদ্দিন, ইউএস ফরেস্ট সার্ভিস ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রামের আরবান আউটরিচ পার্টনারশিপস স্পেশালিস্ট লাইজা পাকুয়ো, ইউএস ফরেস্ট সার্ভিস ইন্টারন্যাশনাল প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট মাইকেল রিযো এবং গ্রীন সেভার্সের প্রতিষ্ঠাতা আহসান রনি। রাত সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে নগর সবুজায়নের মহাপরিকল্পনার বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন ও ঢাকা সবুজায়নের রূপরেখা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে অংশ নিয়ে হাতিরঝিল প্রকল্পের পরামর্শক ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, পেশাজীবী, পরিবেশকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঢাকাকে পরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ করতে একটি প্লাটফর্মে কাজ করার জন্য ‘নগর বনায়নের মহাপরিকল্পনা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ১০টি হাত এক করতে চাই। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে পরিকল্পিত নগর বনায়ন করতে চাই। প্রথমে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন দিয়ে শুরু হলেও একে একে ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুরসহ নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় বাস্তবায়নমুখী নগর বনায়ন পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। নগর বনায়নের মহাপরিকল্পনার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন ও বিজ্ঞানসম্মত, অর্থনীতিনির্ভর, গবেষণাধর্মী, বাস্তবধর্মী, বাস্তবায়নমুখী পরিকল্পনার রূপরেখা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কাছে অতি দ্রুত পেশ করা হবে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স প্রেসিডেন্ট ড. আকতার মাহমুদ বলেন, সাধারণ মানুষের জন্য কিভাবে বসবাসযোগ্য করে তুলতে পারি, সেটাই মুখ্য। ঢাকার চারপাশের নদী এবং ভেতরে যে খালগুলো রয়েছে, সেগুলোকে নিয়ে ব্লু এবং গ্রীন নেটওয়ার্ক তৈরি করা যেতে পারে। নগর বনায়নের এই মহা পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স পাশে আছে। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ-এর প্রেসিডেন্ট জালাল আহমেদ বলেন, আমরা সবাই এই নগরের নাগরিক। অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ, দূষণ কমানো, গাড়ি কমিয়ে গণপরিবহন বাড়িয়ে নগরকে বাসযোগ্য করার মহাপরিকল্পনায় নগর পিতার হাত শক্ত করার জন্য আমাদের সহযোগিতা সবসময় থাকবে। আমরা যে যার দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারি। পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ফেজ থাকতে হবে। স্বল্পমেয়াদী, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে। বন বিভাগের সাবেক চীফ কনজারভেটর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিক্ষিপ্তভাবে যে সকল অপরিকল্পিত কাজগুলো রয়েছে সেগুলোকে একত্রে মহাপরিকল্পনার মধ্যে নিয়ে আসতে পারলে ঢাকা ধূসর শহর থাকবে না। সবুজ শহরে পরিণত হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সমস্যাগুলোকে আমলে এনে আমাদের কাঠামো তৈরি করতে হবে। ফরেস্ট্রি আর গার্ডেনিং এক নয়। সঠিক উপায়ে বনায়ন করতে গেলে কি কি করা লাগেবে; সেটা পরিকল্পনার মধ্যে আনতে হবে। আমরা প্রজাতি নির্বাচন থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার বিষয়ে সহায়তা করতে পারব। বন অধিদফতরকেও যুক্ত করা যেতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মাহফুজ হোসেন মিরদাহ বলেন, আমাদের ঢাকায় স্থান উপযোগী বৃক্ষরোপণ করতে হবে। গাছগুলো উৎপাদনমুখী হতে হবে; শহরের মানুষ গাছগুলো থেকে খাদ্য ও পুষ্টির বাড়তি সুবিধা পেতে পারে। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জনবল ও কারিগরি পরামর্শের মাধ্যমে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের পরিকল্পনায় রাজধানীর গাবতলীতে গ্রীন সেভার্সের মাধ্যমে গাছের হাসপাতাল নির্মাণ পরিকল্পনার মূল সমন্বয়ক আহসান রনি বলেন, আগের ঐতিহ্য ফিরে আসুক। প্রত্যেকটি গাছের অভিভাবক তৈরি হোক। অভিভাবকের দায়িত্ব নিতে পারে সিটি কর্পোরেশন। আমরা চাই প্রতিটি গাছ শুধু রোপণ নয়, যতœ ও লালন নিশ্চিত করা হোক। কোথায় কোন গাছ কবে লাগাব, সেই নিশ্চয়তাও এই পরিকল্পনার মধ্যে পেতে চাই। লেখক মোকাররম হোসেন বলেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে বৃক্ষের জন্য আলাদা বিভাগ চাই। গাছের নিয়মিত পরিচর্যা, লালন, পরিসংখ্যান প্রয়োজন। গাছ লাগান, লালন করুন, পরিবেশ বাঁচান-এই বিষয়টি এখন আমলে আনতে হবে। বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করে সঠিক গাছ চিহ্নিত করে উপযুক্ত গাছ নির্বাচনসহ বৃক্ষরোপণ করতে হবে। ৬টি ঋতুকে প্রাধান্য দিয়ে সবুজায়ন পরিকল্পনা করতে পারি; যাতে ঢাকা কখনও বিবর্ণ না থাকে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ফ ম জামাল উদ্দিন বলেন, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ এই পরিকল্পনার সঙ্গে থাকবে, সর্বাত্মক সহযোগিতাও করা হবে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম বলেন, সারা ঢাকাবাসী আজ সৌভাগ্যবান; আপনাদের এতো বড় প্লাটফর্ম আমরা পেয়েছি। নগর বনায়নের জন্য আন্দোলন করবেন। আমি নেতৃত্ব দেব। আগামীকাল থেকেই আমরা গাছ লাগাব। আর কোথাও অপ্রয়োজনে একটি গাছও কাটতে দেয়া যাবে না। বনায়নের শুরু হোক এখান থেকেই। ৪/৫ ফুট লম্বা গাছ রোপণ করা যেতে পারে। আবার বৃক্ষ ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো হচ্ছে না। গাছের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। আহসান রনি বলেন, গাছ রোপণের বিষয়টি ডাটাবেজের মাধ্যমে পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে। কোন গাছ লাগালে ফুলের গন্ধ আসবে, কোন গাছ লাগালে মশা চলে যাবে, কোন গাছ লাগালে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরতে পারি; এরকম একটি মাস্টারপ্লান করতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে যেসব খাল রয়েছে, সেগুলো পরিকল্পনা করে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে প্রেজেন্টেশন করতে পারি; এতে তারাও এগিয়ে আসবে। ইকবাল হাবিব বললেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অর্থ দিতে চায়; কিন্তু তারা প্লাটফর্ম ও পরিকল্পনা চায়। আমরা সেই ব্যবস্থা করে দিতে পারি। পরিকল্পিত বনায়ন ঢাকার সবুজায়ন করার পরিকল্পনা করতে হবে। আমরা একসঙ্গে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য শহর উপহার দিতে চাই। তিনি বলেন, সকলে হাত মেলালে সারা বাংলাই হাতিরঝিলের মতো জলসবুজের উদ্যানে পরিণত হতে পারে। ছাদ বাগান থেকে শুরু করে প্রাঙ্গণ বাগান, প্রাঙ্গণ বাগান থেকে শুরু করে নগর বাগান-প্রতিটি ক্ষেত্রে সকলকে সঙ্গে নিয়ে নগর আন্দোলন শুরু করার প্রত্যয় নিয়েই এই আয়োজন করা হয়।
×