ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তদন্তের দায়িত্ব ডিবির হাতে

লিবিয়া ট্র্যাজেডি ॥ ১৬ জনকে আসামি করে পল্টন থানায় মামলা

প্রকাশিত: ২১:৩৩, ৬ জুন ২০২০

লিবিয়া ট্র্যাজেডি ॥ ১৬ জনকে আসামি করে পল্টন থানায় মামলা

শংকর কুমার দে ॥ লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে নির্মম ও নৃশংসভাবে খুনের ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় ১৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছেন লিবিয়ায় আটকা পড়া রাকিব নামের এক যুবকের বাবা মান্নান মুন্সি। মানবপাচার এবং সন্ত্রাস দমন আইনে এ মামলা করা হয়েছে। মামলাটির তদন্তভার দেয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখাকে (ডিবি)। বাবা মান্নান মুন্সি মামলায় অভিযোগ করেছেন, দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় গিয়ে দুই দফায় সাত লাখ টাকা দিলেও রাকিব নামে তার পুত্র আটকা পড়ে আছে লিবিয়ায়। এর আগে লিবিয়া ট্র্যাজেডির ঘটনায় ৩৬ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় মানবপাচার-হত্যা মামলা দায়ের করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে লিবিয়ায় পাচার হওয়া ব্যক্তিদের পক্ষে তাদের স্বজনরা মামলা করেছেন। লিবিয়া হত্যাকা-ের ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১৮ জনকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়া ট্র্যাজেডির ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ৫ মিনিটে রাজধানীর পল্টন থানায় মানবপাচার এবং আঘাতে খুনের অভিযোগে হত্যা মামলা দায়ের করেন পাচার হওয়া রাকিবের বাবা মান্নান মুন্সি। লিবিয়ায় রাকিবকে আটকে রেখে নির্যাতনের মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগে রাজধানীর পল্টন থানায় মামলাটি দায়ের করেছেন তিনি। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ১৬ জনকে আসামি করে মানবপাচার এবং সন্ত্রাসবাদ দমন আইনে মামলাটি দায়ের করার পর তদন্তভার গ্রহণ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ১৬ জনের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় মানবপাচার ও সন্ত্রাসবাদ দমন আইনে মামলা করার পর তদন্ত শুরু হয়েছে। মে মাসের আগে দুই দফায় মোট সাত লাখ টাকা দালালের মাধ্যমে দেন লিবিয়ায় গিয়ে আটকে পড়া রাকিব নামে ওই যুবকের বাবা মান্নান মুন্সি। শরীয়তপুরের মান্নান মুন্সি বাদী বৃহস্পতিবার রাতে এ মামলা করেন রাজধানীর পল্টন থানায়। মামলা নম্বর-৩। মামলার এজাহারে বাদী মান্নান মুন্সি বলেছেন, গত ৭-৮ মাস আগে পরিচিত অনেক টাকা বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে মহসিন ও মনির তার ছোট ছেলে রাকিবকে লিবিয়ায় পাঠানোর কথা বলেন। রাজি হয়ে প্রথম দফায় কিছু জমি-জমা বিক্রি করে সাড়ে তিন লাখ টাকা মহসিনকে দেয়া হয়। এরপর রাকিবকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে তাকে জিম্মি করে আরও সাড়ে তিন লাখ টাকার জন্য নির্যাতন করা হয়। ছেলেকে জিম্মি করে মারধর করা হচ্ছে জেনে সহ্য করতে না পেরে বাকি জমি-জমা বিক্রি করে মহসিনের হাতে আরও সাড়ে তিন লাখ টাকা দেয়া হয়। এ সময় মনির লিবিয়ায় থাকলেও মারধর বন্ধ হয়নি। সম্প্রতি লিবিয়ায় সংগঠিত নৃশংস হত্যার ঘটনায় রাকিব বেঁচে গিয়ে ফোনে জানিয়েছেন, তিনি পালিয়েছেন। এরপর থেকে আর তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। যে বা যারা রাকিবকে জিম্মি করে মারধর করছে তাদের শান্তি দিতে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। ডিবির উত্তর বিভাগের ডিসি মশিউর রহমান বলেছেন, বাদী মান্নান মুন্সির ছেলেসহ অন্যদের লিবিয়ায় নেয়া ও মামলার আসামিরা ছাড়াও আর কারা এর সঙ্গে জড়িত তা তদন্ত করে দেখা হবে এবং আইনের আওতায় আনা হবে। মামলাটির তদন্তভার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিবি উত্তর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান। বুধবার, ৩ জুন রাতে পল্টন থানায় মানবপাচার এবং সন্ত্রাসবাদ দমন আইনে দায়ের করা মামলাটি ডিবি তদন্ত করবে। বাদীর ছেলে রাকিবসহ অন্যদের কিভাবে লিবিয়ায় নেয়া হয়েছে, উল্লেখিত আসামিরা ছাড়াও আর কারা এ চক্রের সঙ্গে জড়িত তা তদন্ত করে দেখা হবে বলেও জানান ওই ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা। পল্টন থানার ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহিন উদ্দিন জানান, লিবিয়া ট্র্যাজেডির পর বৃহস্পতিবার, ৩ জুন রাতে ১৬ জনের নামোল্লেখ পল্টন থানায় একটি মামলা (নম্বর-০৩) দায়ের করেন মান্নান মুন্সি। লিবিয়ায় নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনার সময় রাকিব পালিয়ে বেঁচে যায় বলে অভিযোগ করেছেন রাকিবের বাবা মান্নান মুন্সি। পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় অভিযোগ করেছেন তিনি। ডিবির পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মান্নানের ছেলেকে দালালরা লিবিয়ায় পাঠিয়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে পরিবার যোগাযোগ করতে পারছে না। সে বেঁচে আছে না মারা গেছে, তাও স্পষ্ট নয়। গত ২৮ মে লিবিয়ার ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদাহতে ২৬ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং ওই ঘটনায় ১১ জন আহত হয়ে এখন লিবিয়ায় চিকিৎসাধীন। ওই ঘটনায় চার আফ্রিকান অভিবাসীও নিহত হন। সিআইডির মামলা ॥ লিবিয়ায় পাচারের শিকার ২৬ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় এর আগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) একটি মামলা করে। গত ২ জুন পল্টন থানায় দায়ের করা ওই মামলায় মোট ৩৮ জনকে আসামি করা হয়। মঙ্গলবার রাতে সিআইডির এসআই রাশেদ ফজল বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন বলে পল্টন থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক জানান। মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে এবং হত্যার অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে। সিআইডির দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয়েছে মোট ৩৮ জনকে। র‌্যাবের হাতে দুদিন আগে ঢাকায় গ্রেফতার কামাল হোসের ওরফে হাজী কামাল (৫২) ছাড়াও ঢাকার শহীদ তাজউদ্দিন সরণির ট্র্যাভেল এজেন্সি নাভীরা লিমিটেড এবং হাতিরঝিলের ফ্লাইওভার ট্যুরস এ্যান্ড ট্র্যাভেলস লিমিটেডের মালিক দুই ভাই শেখ মোঃ মাহবুবুর রহমান (৪৯) ও শেখ সাহিদুর রহমান (৪০) এবং পুরানা পল্টনের স্কাই ভিউ ট্যুরস এ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিককে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। দুই ভাইকে গ্রেফতারের পর ৪ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। লিবিয়া ট্র্যাজেডির ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজনের বরাতে সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উন্নত জীবিকার সন্ধানে ইউরোপ যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন ৩৮ বাংলাদেশী। বেনগাজি থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে মানবপাচারকারীরা তাদের ত্রিপোলি নিয়ে যাচ্ছিল। লিবিয়ার ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদাহতে ওই দলটি লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়। তখন পাচারকারীরা আরও টাকা দাবি করে। এ নিয়ে বচসার মধ্যে আফ্রিকার মূল পাচারকারীকে মেরে ফেলা হলে তার পরিবার এবং বাকি পাচারকারীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৩০ জনকে হত্যা করে, আরও ১১ জন আহত হন। গত ২৮ মে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানবপাচারের শিকার ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যা ও আরও ১১ জন আহতের ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের উপ-পরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নং ৪। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, লিবিয়া ট্র্যাজেডি নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বই এই নৃশংস হত্যাকা-ের বিষয়ে নিন্দা জানিয়ে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন। পুলিশ সদর দফতর, র‌্যাব, ডিবি, সিআইডি ও গোয়েন্দা সংস্থা এই বিষয়ে তদন্ত করছে। আসামিদের গ্রেফতারের বিষয়ে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং এসব মামলায় ১৮ আসামিকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওইসব মামলায় এখনও বেশিরভাগ মানবপাচারকারী পলাতক রয়েছেন। তদন্তে মানব পাচারকারী হিসেবে যাদের তথ্য উপাত্ত ও নাম উঠে আসছে তাদের বিরুদ্ধে মামলার দ্রুত চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে এবং গ্রেফতারের বাইরে থেকে গেলে তাদের বিরুদ্ধে আদালতের মাধ্যমে ওয়ারেন্টট জারি ও এরপর আন্তর্জাতিক পুলিশ ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হবে। সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, নিরীহ মানুষের জীবনের বিনিময়ে মানব পাচারকারী ও দালাল চক্র যে অর্থ-সম্পদ করেছে, এই সম্পদ তারা ভোগ করতে পারবেন না। তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে। এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে সিআইডি। বড় বড় যত সঙ্ঘবদ্ধ মানবপাচারকারী রয়েছে ইতোমধ্যে তাদের নাম আমরা সংগ্রহ ও ইনকোয়ারি শুরু করেছি। দেশী কিংবা বিদেশী যত প্রভাবশালী মানবপাচারকারী হোক না কেন তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা হবে না। মানব পাচারকারী ও দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সিআইডি কর্মকর্তার দাবি।
×