ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলম শাইন

বজ্রপাত ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ২১:০৪, ৬ জুন ২০২০

বজ্রপাত ঝুঁকিতে বাংলাদেশ

ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, তাপপ্রবাহ বৃদ্ধি, নদী ভাঙ্গন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক ও মরুকরণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশের নিত্যদিনের সঙ্গী। হালে যোগ হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত বজ্রপাত। যদিও বজ্রপাত দেশে কম-বেশি সব সময়ই ঘটেছে, তবে সম্প্রতি সেই সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। আগে আমরা বজ্রপাত ঘটতে দেখেছি মৌসুমভিত্তিক। বিশেষ করে বর্ষা এবং কালবৈশাখী মৌসুমে একটু বেশি লক্ষ্য করেছি। সম্প্রতি বজ্রপাতের হার সেই তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরের যে কোন সময় সামান্য মেঘ জমলেই কিংবা ঝড়ের পূর্বাভাস দেখা দিলেই বজ্রপাত হচ্ছে উপর্যুপরি। সে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে ওই মুহূর্তে। এতে বিপুল প্রাণনাশের সংবাদও পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই মৌসুমের শুরুতেই বজ্রপাতে ৬৬ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া গেছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটছে বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসা ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ বছরের এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া যায়। গবেষক দলের প্রধান নাসার বিজ্ঞানী স্টিভ গডম্যানের গবেষণা মতে জানা যায়, এশিয়ার বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার মধ্যে বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার অবস্থান পঞ্চম। অপরদিকে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, দেশের মধ্যে সিলেটের সুনামগঞ্জে বেশি বজ্রপাত ঘটছে। নাসার আরেক গবেষণায় জানা যায়, মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে প্রচুর বজ্রপাত ঘটে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কঙ্গোর কিনমারা ডেমকেপ এবং ভেনেজুয়েলার মারাকাইবো লেক এলাকায় জুন থেকে নবেম্বর পর্যন্ত প্রচুর বজ্রপাত ঘটে। বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, বজ্রমেঘ, বজ্রঝড় ও বজ্রপাত কোন একক প্রতিফলন নয়। এসব হচ্ছে আবহাওয়ার অনেকগুলো উপাদানের ফল। সংবাদপত্র মারফত জানা যায়, বাংলাদেশের সুনামগঞ্জে তিন মাসে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫টি বজ্রপাত আঘাত হানে। মূলত ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানে বেশি বজ্রপাত ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তারা জানিয়েছেন, ভারতের খাসিয়া পাহাড় ও মেঘালয়ে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত মেঘ জমতে থাকে। জমাকৃত মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে অত্র এলাকায় অর্থাৎ সুনামগঞ্জে বজ্রপাত বেশি ঘটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্র্যেগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের একজন অধ্যাপক জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগোলিক অবস্থান। তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরের পরেই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে গরম আর্দ্র বাতাস বাংলাদেশের ওপরে ভেসে আসছে। অপরদিকে উত্তর থেকে হিমালয়ের ঠান্ডা বাতাস ধেয়ে আসছে। এই দুই ধরনের বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল হওয়ায় বাংলাদেশে ব্যাপক বজ্রপাত ঘটছে।’ অন্য আরেক গবেষক জানান, বাংলাদেশে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে শুরু করে শীতের আগ পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রচুর জলীয়বাষ্প উর্ধমুখী হয়ে মেঘের ভেতর ঢুকে পড়ে। আর সেই জলীয়বাষ্প ঢুকে যাওয়ার কারণে মেঘের ভেতরে থাকা জলকণা ও বরফকণার সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে বজ্রপাতের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে যেভাবেই বজ্রপাত হোক না কেন, তাতে জানমালের প্রচুর ক্ষতি সাধিত হচ্ছে এটিই সত্য। বিশেষ করে বজ্রপাতে পুরুষের মৃত্যুর হার বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ মাঠ-প্রান্তরে, জলাশয়ে, কিংবা রাস্তাঘাটে পুরুষের অবস্থান নারীদের তুলনায় বেশি হওয়ায় দুর্যোগের কবলে তারাই বেশি পড়ছেন। ফলে সংসারের উপার্জনক্ষম মানুষটিকে অকালে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশে। যে সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। তার মধ্যে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ব্রাক্ষ্মণবাড়ি, লালমনিরহাট ও দিনাজপুর অঞ্চলে বেশি বজ্রপাত ঘটেছে। আবার কয়েক বছরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে বেশি বজ্রপাত ঘটছে। ২০১২ সালে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় বজ্রপাতে একসঙ্গে ১৩ জনের মৃত্যুর খবরও আমরা জানতে পেরেছি। সেই বজ্রপাতটি ঘটেছে তা-ও কীনা আগস্ট মাসে। অর্থাৎ তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে বজ্রপাত এখন আর মৌসুম ভিত্তিতে হচ্ছে না। বছরের যে কোন সময় আঘাত হেনে প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। অতিরিক্ত বজ্রপাত ঘটার জন্য জলবায়ুর পরিবর্তনকেও দায়ী করা হচ্ছে। যে হারে বৃক্ষনিধন এবং কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বাড়ছে তাতে বায়ুমন্ডলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে পারিপার্শ্বিক অবহাওয়া বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে। এই বৈরি আবহাওয়াকে এখন বজ্রপাতের অনুকূলে নয়, মানুষের অনুকূলে আনতে হবে বনায়ন সৃষ্টির মাধ্যমে। বড় বড় গাছ লাগিয়ে বনায়ন সৃষ্টি করতে হবে, তাতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কারণ বজ্রপাত ঘটার সঙ্গে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে মাঠ-প্রান্তরসহ রাস্তার দু’ধারে তালগাছ লাগাতে হবে বেশি বেশি। বিশেষজ্ঞদের দাবি তালগাছ হচ্ছে প্রকৃতির বজ্র নিরোধক দন্ড। কাজটি করতে হবে এখনই। কারণ একটি তালের চারা রোপণের ১৪ বছর পর সেটি বজ্র নিরোধক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম হয়। পাশাপাশি বজ্র নিরোধক দন্ড লাইটপোস্টে সিমেন্ট ব্যবহার করে টানিয়ে দিতে হবে। যেটি নেপালে করা হয়েছে। আমাদের দেশেও বিজিবি ক্যাম্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। এগুলোকে বলা হয় ‘লাইট মিনার স্টার’। যা ব্যবহার করা যেতে পারে মাঠ-প্রান্তরেও। এই দন্ড ব্যবহার খুব সহজ প্রযুক্তি। জানা গেছে, তাতে বেশি অর্থকড়িও খরচ হয় না। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি, ব্রিটিশ শাসনামলে এক ধরনের চুম্বকীয় পিলার পুঁতে রাখা হয়েছিল দেশের মাঠ-প্রান্তরে কিংবা রাস্তার পাশে। সেগুলোর গায়ে খোদাই করে লেখা ছিল ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় বেশি পুঁতে রাখার কারণে অনেকের কাছে এগুলো ‘সীমান্ত পিলার’ নামে পরিচিত। বোতল আকৃতির ওজনদার সেই পিলার বজ্র নিরোধকের কাজে ব্যবহৃত হতো; কয়েক বর্গকিলোমিটার সুরক্ষা দিত। জানা গেছে, পিলারের আশপাশে বজ্রপাত ঘটলেও মানুষের তেমন ক্ষতি হতো না। অথচ অসাধুরা লোভের বশবর্তী হয়ে সেই পিলারগুলো তুলে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন খুব একটা নেই কোথাও সেই চুম্বকীয় পিলার, থাকলেও পাহারা দিয়ে রাখতে হচ্ছে। আর চুরি যাওয়া সেই চুম্বকীয় পিলারের খেসারত দিতে হচ্ছে এখন আমাদের। শেষ কথা হচ্ছে, চুম্বকীয় পিলার হারিয়ে এখন চুপচাপ বসে থাকলে চলবে না আমাদের। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হবে সবাইকে সাহসের সঙ্গে, ধৈর্য ধারণের মাধ্যমে। দেশের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে এর থেকে উত্তরণ পেতে হলে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যুব সম্প্রদায় এবং শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশের আনাছে-কানাছে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। একযোগে লাখ লাখ তালের চারা রোপণ করতে হবে দেশে। তবেই বজ্রপাত থেকে মুক্তি মিলবে। কাজটি করতে হবে খুব দ্রুততর; কারণ একটি তালের চারা বেড়ে উঠতে অনেক সময়ের প্রয়োজন পড়ে। এ ছাড়াও অন্যান্য গাছ লাগাতে হবে প্রচুর, সেটি ঝোপজঙ্গল হলেও আপত্তি নেই; বনায়ন সৃষ্টি হলেই হলো। অর্থাৎ বনায়ন সৃষ্টির মাধ্যমে ছায়া শীতল রাখতে হবে দেশকে। আমাদের জানতে হবে এবং জানাতে হবে যে, গাছ শুধু জলবায়ু পরিবর্তন রোধেই ভূমিকা রাখে না, এটি বজ্র প্রতিরোধকও। সুতরাং গাছ লাগিয়ে দেশ বাঁচাই এবং নিজে বাঁচি। লেখক : কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও বন্যপ্রাণী বিশারদ
×