ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিরিন বানু মিতিল ॥ প্রীতিলতার প্রতিচ্ছবি

প্রকাশিত: ০০:১৮, ৫ জুন ২০২০

শিরিন বানু মিতিল ॥ প্রীতিলতার প্রতিচ্ছবি

একাত্তরের প্রত্যক্ষদর্শী যাঁরা, তাঁরা জানেন সেই সব দিনরাত্রির অবর্ণনীয় ভয়াবহতা! বর্বও হিং¯্র পাকিস্তানী হায়েনাদের তা-ব! আর যারা পরবর্তী প্রজন্মের তাদের চেতনায় অনুভবে জ¦লজ্বল করে প্রবল ঘৃণা লেলিহান শিখা। পূর্বসূরিদের তিক্ত অভিজ্ঞতার রক্তাক্ত লোমহর্ষক স্মৃতিকথায়!... সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকেই তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমী বাঙালী লড়াই করে চলছে তার আত্মমর্যাদা স্বাধিকার আন্দোলনের জন্য। বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের রক্ত দিল বাঙালী। সহ¯্র ষড়যন্ত্র ধূলিসাত করে বাংলা মায়ের মুখের বুলি আপন মর্যাদা ফিরে পেল। আজ বিশে^র দরবারে বাংলাভাষা মধুরতম ভাষার মহিমায় সমুজ্জ¦ল। এইসব অর্জন দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের ফলশ্রুতি। ঊনসত্তরে গর্জে উঠেছিল বাংলার সাহসী জনমানুষ। একাত্তরের সাত মার্চের অবিস্মরণীয় ঘোষণ-জাতির জনকের বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর! আকাশে অলীক আন্দোলন! আন্দোলন, সাহস, দৃঢ়প্যত্যয় বাঙালীর মনে প্রাণে। ভিটেমাটি, স্বদেশের এক টুকরো মাটিও বেহাত করা যাবে না। যে কোন মূল্যে আপন অধিকার রাখতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সেই অসাধারণ ভাষণ অশ্রুতপূর্ব রাজনৈতিক কবিতা, ‘সাতকোটি মানুষকে দাবায় রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।’ বাঙালীর জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণ। ¤্রয়িমাণ বাঙালীর আত্মোপলদ্ধির বদ্ধ দরোজা যেন পাট পাট করে উন্মুক্ত হলো। প্রাণবায়ু ঠোঁটে নিয়ে বাঙালী দেশের জন্য লড়তে এককাট্টা হয়ে গেল অবলীলায়। একাত্তরের এই বাংলার প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার শিরি বানু মিতিলের চেতনার ভূত্ব দুলে উঠলো প্রবল কম্পনের। বুকের অতলে আগুন নিয়ে জন্মেছিল শিরিন বানু। ১৯৫০ সালে ২ সেপ্টেম্বর পাবান শহরের সেলিনা বানুর কোল উজালা করে দুনিয়ার আলোয় চোখ মেলেছিল এই সুকন্যাটি। পিতা বামপন্থী রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ খন্দকার মোহাম্মদ শাহজাহান। মা বামপন্থী রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও পূর্ব বাংলার আইন সভার সাবেক সদস্য। মাতামহ খান বাহাদুর ওয়াসিমউদ্দিন আহমদের রাজনৈতিক আদর্শ মিতিলকে প্রভান্বিত করে। শৈশব-কৈশোর কাল। সূচনা-সময় থেকেই শিরিন ব্যতিক্রমী সমাজসচেতন তথা রাজনৈতিক মুক্ত চেতনার আবহে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। স্বভাবতই গভীর চিন্তা চেতনার প্রগাঢ় দেশ প্রেম এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর বোধ দৃঢ়মূল হয়ে বিস্তার লাভ করে কিশোরীর মননে। আর দশটা বালিকা বা তরুণীর মতো ছক বাঁধা সহজ সরল সুখী জীবনের চিত্র শিরিন লালন করেনি। মাতামোহের বাড়িটি ছিল একসময় বামপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে ছাত্র ইউনিয়ন পাবনা জেলা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে শিরিনের শরিক হওয়ার বিষয়টি ছিল অবধারিত প্রায়। সেই সময়ের সামাজিক রক্ষণশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণযোগ্য চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটে। একজন তরুণী মুক্তিযোদ্ধা হয় কেমনে? এই সঙ্কট দৃঢ়প্রতিজ্ঞ শিরিন বানুকে দমিয়ে রাখতে পারে না! দেশ শত্রু কবলিত। ঘরে বসে বা নিরাপদ আশ্রয় আবিষ্কার করার অতি স্বাভাবিক মন মানসিকতা এই লড়াকু দৃঢ়চেতা মেয়েটির নেই। মামাতো ভাই জিদানের শলা শিরিনকে মন মুহূর্তে উদীপ্ত করল। জিদান বলেছিলেন, ‘ তুমি প্রীতিলতার মতো শার্ট প্যান্ট পরে যুদ্ধে যেতে পার।’ বড় খালা বলেছিলেন ‘যুদ্ধে যাচ্ছ যাও। তবে তোমাদের পিঠে যেন গুলি না লাগে।’ কথাগুলো শুধু কতকগুলো ওজনদার কথা নয়, এ যেন আত্মপ্রত্যয়ী তন্ড উদ্বেল চেতনায় কামান দাগার শামিল। তার চেতনা জুড়ে ছিল, কিউবা, ভিয়েতনাম্ এবার দেশপ্রেমে মাতোয়ারা তরুণীর সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি শামিল হওয়ার মহৎ আয়োজন। তখন পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজের শিরিন বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সুশিক্ষিত মুসলিম মধ্যপরিবারের মেয়ে শিরিন অতঃপর খাকি শার্ট, ফুল প্যান্ট ও ক্যানভাসের জুতো পরে নেমে পড়ল সম্মুখ সমরে। পাবনা হায়েনার থাবা থেকে উদ্ধার করার শক্ত সাধনায়। পরখ করে দেখলে প্রতীয়মান হবে এ মেয়ে নিবেদিত বামপন্থী ঘরানারা কন্যা। একাত্তরের পঁচিশ কালরাতে পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমণ শুরু হলে সাতাশ মার্চ পাবনা পুলিশ লাইনে যোগ দেয়। ছেলে সেজে শিরিন যুদ্ধে অবতীর্ণ। সাতাশ মার্চ পাবনা টেলিফোন এক্সেচেঞ্জে ছত্রিশজন হায়েনা পাকিস্তানীর সঙ্গে জনতার তুমুল মরণপণ যুদ্ধ হয়। বলাবাহুল্য সেই দলে শিরিনই ছিল একমাত্র পুরুষবেশী একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা। পরদিন পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে স্থাপিত মুক্তিযুদ্ধের কন্ট্রোল রুমের পুরো দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শিরিনের ওপর। পাবনার প্রাথমিক প্রতিরোধ পর্ব চলছিল পঁচিশ মার্চ থেকেই। চলে নয় এপ্রিল নাগাদ। জারি হয় সান্ধ্য আইন। ছাব্বিশ মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার শুরু হয়। সর্বস্তরে অবর্ণনীয় অত্যাচার, গণহত্যা শুরু হয়। জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় পাল্টা-আঘাত হানার। ঘরে ঘরে পাবনার অসম সাহসী মেয়েরাও যুদ্ধে নামার মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। বহ্নিশিখার মতো জ¦লে ওঠেন তাঁরা। তাঁদের অস্ত্র ছিল গরম পানি, এ্যাসিড বাল্ব, বঁটি আর দা। শিরিনের মত, ‘ মেরে মরো।’ মিতিলের দুই মামাতো ভাই জিদান ও জিঞ্জির মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় মায়ের নির্দেশে। মহীয়সী বলেছিলেন, ‘তোমাদের কি মানুষ ঘরে অসহায়ভাবে মরার জন্য? মরতে হলে যুদ্ধ করে মরো’। তিনি পাবনা মহিলা পরিষদের আহ্বায়ক কমিটির সভানেত্রী রাকিবা বেগম। শিরিনের পরমাত্মীয়। মামী এবং ফুফু। তিনি ছিলেন দুধ মাও বটে। ডয়চে ভেলের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ব্যক্ত করেছিল শিরিন। তার কথাগুলো থেকে আমরা যা পাই, আটাশ মার্চ শহরের জেল রোডে টেলিফোন ভবনে দখলদার ভবনে ছত্রিশজন পাকিস্তানী সেনার সঙ্গে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাক সেনাদের সবাই মারা পড়ে। দু’জন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। এভাবে খ- খ- যুদ্ধ চলতেই থাকে। তখন যুদ্ধ চলছিল নগরবাড়ি ঘাট, আতাইকুলা ও কাশীনাথপুরে। পাকি হায়েনাদের আক্রমণ হয় আকাশ পথে। পাশের জেলা কুষ্টিয়ায় প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ছে। তাদের বিভিন্ন দল পিছিয়ে যাচ্ছে চুয়াডাঙ্গার দিকে। পাবনার ছাত্রনেতা ইকবালের দলের একটি গাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় মিতিল ও তাঁর এক ভাই থেকে যায় কুষ্টিয়ায়। পরে কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গা যাওয়ার পথে ভারতের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সাংবাদিক মানস ঘোষ শিরিনের ছবিসহ সাক্ষাৎকার ছাপেন। এরপর পুরুষের ছদ্মবেশে যুদ্ধ করার সুযোগ পাননি। মুক্তিযুদ্ধকালীন একদিনের ঘটনা প্রবলভাবে আন্দোলিত করে শিরিনের মুক্তিকামী মন। তিনি জানান, আমি যখন কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গার দিকে যাচ্ছিলাম তখন একদিন গভীর রাতে আমাদের দলটিকে পথের মাঝে আটকানো হয়। মূলত ঐ অঞ্চলে পাকি সেনাদের প্রতিরোধ করতেই সতর্কতামূলক পাহারায় যারা ছিলেন তাঁরা আমাদের পরিচয় জানতে চায়। আমরা পরিচয় দিলেও তাঁরা প্রথমে বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না। কারণ আমাদের সঙ্গে যিনি আর আই ছিলেন তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের। ফলে তাঁর ভাষার টানটা ছিল বিহারিদের মতো।...কিন্তু আমার পরিচয় জানার পরই দেখা গেল যে, তাঁরা সবাই আমাকে ঘিরে ধরল তাদের মধ্যে এক বৃদ্ধ পিতা আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মা আমরা আর ভয় করি না। আমাদের মেয়েরা যখন আমাদের সঙ্গে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে তখন বিজয় আমাদের হবেই।’... বিশ এপ্রিল আরও প্রশিক্ষণের জন্য ভারত চলে যান শিরিন। নাচোল বিদ্রোহের স্বনাধন্য নেত্রী ইলা মিত্রের বাড়িতে বেশ কিছুদিন ছিলেন শিরিন। প্রথমে কয়েকজন বিশিষ্ট নারী বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ঘুরে ঘুরে বিপর্যস্ত মেয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দল গঠন শুরু করে। নারী নেত্রী ইলা মিত্র বার কয়ে শিরিনের সঙ্গে নেতৃত্ব দেন। ফলশ্রুতি দাঁড়ায় লাগাতার পরিশ্রমের এই অভিযানে দল গঠন শুরু হয়। অবশেষে ছত্রিশজন নারী নিয়ে গোবরা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে সদস্য সংখ্যা দুইশত চল্লিশ এর উপরে দাঁড়ায়। সেখানে শিরিনও প্রশিক্ষণ নেয়। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কলকাতায বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তব্য দিতে থাকে। অস্ত্রে সঙ্কটের কারণে মহিলা গ্রুপের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। যে কারণে দলের একটি অংশ আগরতলা যায় মেডিকেল কোরের সদস্য হিসেবে। বাকিরা বিভিন্ন এলাকায় ভাগ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়। ‘মুক্তির লড়াই এ নারী’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় পুরুষের পাশে থেকে সমান তালে লড়াই করেছেন। কিন্তু বীরাঙ্গনা শব্দের মধ্যে দিয়ে নারীদের যোদ্ধার চাইতে নির্যাতিত হিসেবেই বেশি বিবেচনা করা হয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ শিরিন বানু মেজর জলিরের নেতৃত্বে পারিচালিত নয় নম্বর সেক্টরে যোগ দেয়। ভারতে সাংবাদিক মানস ঘোষের লেখা থেকে কিছু চুম্বক অংশ এখানে উল্লেখ করছি। এখানে শিরিন বানুর মুক্তিযুদ্ধেরকালীন কর্মকা-ের কিছু স্বচ্ছ চিত্র পরিস্ফুট। ... ‘শিরিনকে আমার অসামান্য লেগেছিল। আমি যশোর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহীর বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের খবর যোগাড় করতে গিয়ে প্রচুর মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি। কিন্তু কোন তরুণী-নজরে পড়েনি। আমি রোজ অফিসের গাড়ি করে দর্শনা হয়ে চুয়াডাঙ্গা যেতাম। চুয়াডাঙ্গা ছিল মুক্তিযুদ্ধের পশ্চিমাঞ্চলের সদর দফতর। কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরী ছিলেন ওই অঞ্চলের প্রধান। একদিন সেখানে গিয়ে দেখা হলো পাবনার ডিসি বা ডেপুটি কমিশনার নুরুল কাদের খানের সঙ্গে। তিনি ক্যাম্ব্রিজ বিশ^বিদ্যালয়ের ¯œাতক এবং সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানের (সিএসপি) এক দুঁদে আমলা।... তিনি বললেন, চুয়াডাঙ্গায় তিনি অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ নিতে এসেছেন। কেননা পাক বাহিনী পাল্টা আক্রমণের ছক কষে পাবনা পুনর্দখল করতে চাইছে।...অতঃপর একটা প্রায় অকেজো বাষ্পচালিত ইঞ্জিন যোগাড় করে তার সঙ্গে দুটা রেলের বগি জুড়ে দিয়ে স্তূপীকৃত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঈশ^রদীর পথে পাড়ি জমালাম। সে ছিল রুদ্ধশ^াস পরিক্রমা বা অভিজ্ঞতা।... ভোর পাঁচটায় যখন ঈশ^রদী পৌঁছি স্টেশনের দেখি প্রচুর মুক্তিযোদ্ধা।... তখনই আমার চোখে পড়ে শিরিনের ওপর। শারীরিকভাবে রফিকুল ইসলাম বকুল বা ইকবালের মতো বলিষ্ঠ মুক্তি সে নয়। বরং সে খুব শীর্ণ ও লাজুক প্রকৃতির। আমার কাছে এসে বলল ‘নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত।’ আমার হাত থেকে প্রায় জোর করে এয়ার ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘দামী কিছুই নেই তো?’ উত্তর দেয়ার আগেই সে বলে ওঠে, ‘যুদ্ধের খবর করতে এত ঝুঁকি নিয়ে আমাদের পাবনায় এসেছেন। আমাদের মেহমানদারি করতে দিন।...’ ডিসি আমাদের বকুল, ইকবাল ও শিরিনের হাতে সঁপে দিয়ে কালেক্টরে চলে গেলেন।... পাবনা শহরে বিভিন্ন রণাঙ্গন দেখে কালেক্টরে পৌঁছেই দেখি ডিসি সাহেব উৎকণ্ঠায় তাঁর চেম্বারে পাঁয়চারী করছেন।...’ মানস ঘোষের সঙ্গে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে শিরিনের উত্তরে এই সাংবাদিক তাজ্জব বনে যান। শিরিন বলেছিল, ‘এনার বাংলা মেয়েরা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্তের উত্তরসূরি। তারা আমাদের যে পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সেই পথে আমরা চলতে অভ্যস্ত। বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছেন, বাঙালীর জন্য পাকিস্তান হয়নি। সে জন্য শুধু আমি নই, আমার পুরো পরিবার মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করতে।’ মানস ঘোষ আরও লিখেছেন... ‘হঠাৎ কালেক্টরেটে ২০/২৫ জনের একটি সশস্ত্র দলের উদয় হলো। সকলের হাতে চীনা অটোমেটিক রাইফেল। তার স্বরে তারা চেঁচিয়ে বলছে, ‘আমাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ডিসি তাদের দাবি-দাওয়া সম্বন্ধে কথা বলুক। তাদের কয়েকজন আকাশে তাক করে কয়েক রাউন্ড গুলিও ছুড়ল। শিরিন একজনে চিহ্নিত করে বলল, ‘ওই লোকটা হচ্ছে টিপু বিশ^াস। এরা আপনাদের নক্সালদের মতো মাও এর ভক্ত।’ হঠাৎ শিরিন ওদের উদ্দেশে করে বলে ওঠে, ‘এটা কী এসব করার সময়? আপনারা বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বিশ^াসঘাতকতা করেছেন, বেঈমানি করেছেন। আপনাদের লজ্জা করে না? বাঙালীরা আপনাদের কোনদিন ক্ষমা করবে না। আপনাদের অভাব অভিযোগ থাকলে ডিসি সাহেবকে স্মারকলিপি দিয়ে যান। কিন্তু ডিসি সাহেব মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুবই ব্যস্ত। তাকে অযথা ডিস্টার্ব করবেন না।’... কালেক্টরিতে টিপু বিশ^াসের উপস্থিতির খবর সেখানে উপস্থিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে টান টান উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। রফিকুল ও টিপুর লোকেরা এরে অপরের দিকে রাইফেল তাক করে অবস্থান নেয়। দুই পক্ষই মারমুখী। তখন অন্য এক শিরিনকে দেখলা কালেক্টরির দোতলা থেকে নেমে সে সোজা দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই পক্ষকে কালেক্টরি ছেড়ে চলে যেতে বলল। কিন্তু কোন পক্ষ আগে যাবে তা নিয়ে গোল বাঁধল। ...পাবনার আকাশ হঠাৎ দুটি এক ইঞ্জিনের ছোট বিমানের আবির্ভাবে এক কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। ডিসি সাহেব কালেক্টরির দোতলার বারান্দা থেকে রফিকুলদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘টিক্কা খান পাঠিয়েছে ‘রেকি করতে। কারণ সে ঢাকা থেকে এক বিশাল বাহিনী সড়কপথে পাঠিয়েছে পাবনা পুনর্দখলের লক্ষ্যে’। সঙ্গে সঙ্গে রফিকুল জানান, আমরা তাহলে নগরবাড়ি ঘাটে গিয়ে হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করি।’ ... তখন ঘরে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলেন ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদ। তিনি বললেন, ‘পাক হানাদার বাহিনী পাঁচটি ফেরি করে নগরবাড়ি নেমেছে এবং পাবনা শহরের দিকে এসেছে। নগরবাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তারা ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে। আমরা রাইফেল ও মাটার দিয়ে সামাল দিতে পারছি না।’... ‘এইসময় ডিসি সাহেবের পোর্টেবল ওয়্যারলেসের সেটে খবর আসছিল পাকিস্তানী হানাদান পাবনার দিকে ধেঁয়ে আসছে। ডিসি সিদ্ধান্ত নেন এবার মালপত্র গুটিয়ে কুষ্টিয়ার দিকে যেতে হবে। শিরিনকে রফিকুল ও ইকবালদের হাতে সঁপে দিয়ে পাবনা ছাড়লেন। শিরিনদের জন্যে পদ্মা পার হবার জন্য নৌকার ব্যবস্থা করে গেলেন। এই পরিস্থিতিতেও শিরিন ছিল অবিচল। বরং সে বলছিল, ‘আপনারা এগোন। আমরা আসছি। এক সঙ্গে পদ্মা পারি হওয়া ঠিক কাজ হবে না।’... শিরিন বানুর চেতনা প্রদীপের সল্তে পাকানো হয়েছিল তাঁর শৈশব কৈশোরকালেই। আগেই উল্লেখ করেছি ওর মাতামোহের বাড়ি বাম রাজনীতির শক্তপোক্ত ঘাঁটি ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় শিরি গর্ভধারিণী শ্রদ্ধাভাজন মা সেলিনা বানু মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির লঙ্গরখানায় স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন। স্বনামধন্য ইলা মিত্র নাচোলের বিদ্রোহী রানির সঙ্গে ১৯৪৯ এর সময়কালে শিরিনের বাবা খন্দকার শাহজাহান, বামপন্থী একনিষ্ঠ কর্মী বহু পরিশ্রমসাধ্য কাজ করেছেন। কচুয়াডাঙ্গা বর্ডারে শিনিসহ আরও মুক্তিকামী তরুণদের আশ্রয় ও পরিকল্পনা কেন্দ্র ছিল। ভারতে যাবার পর একজন সহৃদয় শিল্পনীতির বাড়িতে গোবরা স্থাপিত হবার দিনগুলোয় শিরিন বানু সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বিপর্যস্ত হতাশাগ্রস্ত নারী, যারা কোনক্রমে বর্ডার পার হয়ে এসেছিলেন তাদের মানসিক শক্তি বাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করত। তার সঙ্গে ছিলেন কৃষ্ণা, বীনা, বিভা, জিনাতুন নেসা তালুকদার। একপর্যায়ে শ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাজেদা চৌধুরী গোবরা ক্যাম্পে স্বেচ্ছাশ্রম দেন। বর্ডারে সম্ভবত বরেণ্য দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় শিরিনের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন এবং আকাশবাণীতে প্রচার করেন। শিরিন বানু মিতিল সশ্রদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে ও নানা রকমের শ্রমসাধ্য মুক্তিচেতনা কর্ম করেও সনদপত্র ওঠায়নি। ফলে কিছু প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অবশ্য তাতে বাংলার নব্য প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কিছু যায় আসে না। প্রকৃতপক্ষে শিরিন ছিল বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই মহাদেশের তরুণ প্রজন্মের রোল মডেল। মনে হয় আমাদের অমার্জনীয় অপরাধ এমন দেশপ্রেমী মুক্তিযোদ্ধা জীবনভর শুধু লড়াইই করে গেলেন। মেলেনি কোন যোগ্য রাষ্ট্রীয় সম্মান। যা তার অবশ্য প্রাপ্য ছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ায় পড়তে যান। সেখানকার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি অব রাশিয়ায় নৃবিজ্ঞানে পাঠ সমাপ্ত করে ১৯৮০ সালে দেশে ফিরে আসেন। শিরিন চাইল্ড অব মাদার কেয়ার নামে একটি সেবাকেন্দ্রের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ হিসেবে যুক্ত ছিল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিরিন ‘প্রিপ ট্রাস্ট’ নামের এনজিওর পরিচালন হিসেবে এ্যরোমা দত্ত, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ পৌত্রীর সঙ্গে কাজ করেন। আমরা অশেষ গর্ববোধ করি শিরিনকে নিয়ে, কেননা এই অকুতোভয় নির্লোভ মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সহপাঠী, সমবয়সী স্বজন অকৃত্রিম বন্ধু ছিল। ষাটের দশকের মাঝামাঝ শিরিনকে মহীয়সী মাতা সেলিনা বুন কুমিল্লার ফরিদা বিদ্যায়তনের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। সেই সময়কাল আমার বাবা তাসাদ্দুক লোহানী কুমিল্লা জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সেই সূত্রে তিনি কান্দিরপাড়ের কোয়র্টারে আসতেন। আমরা এই সম্মানিত মানুষটির পদধূলি আমারেদ চত্বরে বর্তে যেতাম। শিরিনও ছিল সবার প্রিয়পাত্রী। ও পড়ত শৈলরাণী বালিকা বিদ্যালয়ে। তখনও ও মধ্যে সচেতন কল্যাণমুখী চিন্তা চেতনার বিকাশ হচ্ছিল। আমরা নিজেদের সৌভাগ্য মানি বাংলাদেশের লেখিকা সংঘের পক্ষ থেকে এই অসাধারণ মানুষটিকে সম্মাননা জানাতে পেরেছিলাম। খুবই অকিঞ্চিতকার হয়তো। কিন্তু হলভর্তি দর্শক শ্রোতা সেদিন কাছ থেকে তাকে দেখে বক্তব্য শুনে আপ্লুত হয়েছিল। দিনটি ছিল ১৯ মার্চ ২০১৬ সাল, সকাল ১০.৩০ মিঃ। এরপর মাত্র কয়েকটি হাতে গোনা দিন। মাত্র কয়েকটি দিবস। ২১ জুলাই মধ্যরাতে শিরিন বানু মিতিল যাবতীয় লড়াই, যাবতীয় জীবনস্মৃতি সুখ দুঃখের অনুভব বিসর্জন দিয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের শেষ নিঃস্বাসটুকু ফেলে। তিন সন্তান স্বামী এবং অগনিত বন্ধু স্বজন, শুভাকাক্সক্ষীকে কাঁদিয়ে। মাত্র পয়ষট্টি বছর বয়স হয়েছিল ওর। ওকে বিদায় জানাতে শহীদ মিনারে থৈ থৈ জনমানুষ ব্যাথিত জনের ঢল নেমে আসছিল সেদিন। ২০০৫ সালে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানী কমলা ভাসিনের নেতৃত্বে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত সহ¯্র সংগ্রামী নারীর যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, তাতে বাংলাদেশের ষোলজন নারীরর মধ্যে শিরিন বানুও অন্তর্ভুক্ত ছিল। শুধু দেশপ্রেমের কাজল দুচোখে মেখে জীবনযাপন করে গেলো শিরিন। তোমাকে ভুলবে না ইতিহাস। ভুলার না এই প্রিয় বাংলাদেশ-এই প্রিয় বিশ্বও! পরপারে শান্তিময় জীবন হোক তোমার। শতকোটি কুর্নিশ তোমার জন্য হে বীর, হে নির্লোভ মুক্তিযোদ্ধা। হে বন্ধু হে প্রিয়! বন্ধু আমাদের সকল ব্যর্থতা ক্ষমা করো। ‘বন্ধু রহো রহো সঙ্গে।’... নইলে আমরা দিশাহারা হয়ে পড়ব॥
×