ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খুররম মমতাজ

সেই রাশিয়া

প্রকাশিত: ০০:১৭, ৫ জুন ২০২০

সেই রাশিয়া

পূর্ব প্রকাশের পর বাকু, বরফ ও মীরা হাসানোভনা নবাগতরা সবাই একে একে ভিন্ন ভিন্ন শহরে চলে গেল। আমার ভাগ্যে পড়লো আজারবাইজানের রাজধানী বাকু। ট্রেনে মস্কো থেকে পুরো দু’টো দিন লেগেছিল বাকু যেতে। আমার সফরসঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলাম বয়স্ক মোটাসোটা ¯েœহময়ী এক আজারবাইজানি মহিলাকে। তিনি দেখলেন ভিনদেশি একটা বোকা ছেলে যাচ্ছে তার সঙ্গে, যে কিনা এক বর্ণও রুশ ভাষা বলতে পারে না। সেই ছেলের যাত্রা যাতে আনন্দময় হয় সেজন্য তিনি নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন। সময় কাটানোর জন্য মিখাইল শলোকভের ‘এন্ড কোয়াইট ফ্লোজ দ্যা ডন’ পড়তে পড়তে যাচ্ছিলাম আমি। তিনি আমার মুখের উপর থেকে বইটা কেড়ে নিলেন। আঙুল দিয়ে জানালার বাইরেটা দেখিয়ে রুশ ভাষায় যা বললেন তা আমি বুঝতে না পারলেও তার ভাবার্থ ঠিকই বুঝতে পারলাম। তিনি হাত নেড়ে হাসিমুখে বলছিলেন- রাখো তোমার বই পড়া! বাইরেটা দেখো, কত সুন্দর আমাদের রাশিয়া! কত সুন্দর এই দেশ! জানালা দিয়ে দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে যাও।’ সত্যি সুন্দর দৃশ্য। তীব্র বেগে ছুটে চলেছে ট্রেন। সরে সরে যাচ্ছে রাশিয়ার তৃণভূমি, খোলা প্রান্তর, রোদ-ঝলমল মাঠ। একসময় দূরে সমুদ্র দেখা দিল। তিনি সবুজ জলরাশির দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘মোরিয়ে...মোরিয়ে!’ জানলাম রুশ ভাষায় সমুদ্র হচ্ছে ‘মোরিয়ে’। একটু পরে পাশের কম্পার্টমেন্ট থেকে স্কুলপড়–য়া দুই মেয়েকে ধরে নিয়ে এলেন তিনি। তাদের মধ্যে একজন খুব লাজুক, অন্যজন মিশুক টাইপ। দু’জনেই স্কুলে ইংরেজি শিখছে। তাদের সঙ্গে গল্প করে কিছুটা সময় ভালোই কাটলো। লাঞ্চের সময় পোঁটলা খুলে বুড়ি আমাকে তার খাবারের ভাগ দিলেন। ট্রেন থামলো প্রায় ফাঁকা বাকু স্টেশনে সকালের দিকে। বগি থেকে নামতে নামতে দেখলাম স্টেশনের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত একটা লোক ছুটছে আর চেঁচিয়ে ডাকছে, ‘বাঙালি? বাঙালি?’ মাত্রই বাহাত্তর ঘন্টা মুখ বুঁজে ছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিলো যেন যুগ যুগ ধরে একটাও বাংলা শব্দ বলিনি, একটাও বাঙলা শব্দ শুনিনি। তাই নির্জন প্ল্যাটফর্মে বাঙালি...বাঙালি ডাকটা ভীষণ মধুর শোনালো। চেঁচিয়ে ডাকছিলেন যিনি তিনি ফজলু ভাই। বিদেশ বিভূঁইয়ে আপন ভাই পেয়ে গেলাম যেন। এক বছর ছিলাম বাকুতে। আমার আগেই ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল আলাউদ্দিন, আজিম, সেলিম, শক্তি...এরা। সিনিয়র ভাইরা দু’দিনেই আমাদের আপন করে নিলেন। ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। ইন্সটিটিউট থেকে প্রত্যেক ছাত্রকে ওভারকোট, টুপি, গ্লাভস এইসব কেনার জন্য কিছু রুবল দেওয়া হলো। ওভারকোট কিনলাম, কিন্তু সাইজে মিললো না, গায়ে ঢলঢল করতে লাগলো। সিনিয়র মোস্তফা ভাই তার অতিরিক্ত ওভারকোটটা আমাকে ধার দিলেন। রুমমেট পেলাম আলাউদ্দিন আর আজিমকে। সিনিয়র এক ভাই সুইডেন গিয়েছিলেন, সামার জব করে বেশ কিছু ক্রোনার রোজগার করেছেন। তার গল্প শুনে আলাউদ্দিন খুব উজ্জিবিত। সে এখন থেকেই প্ল্যান করতে লাগলো আগামি সামারে সে-ও সুইডেন কিংবা লন্ডনে যাবে, ক্রোনার-পাউন্ড রোজগার করবে দুই হাতে। যেতে হলে টিকিট ইত্যাদির জন্য টাকা লাগবে, রুবল জমাতে হবে, তাই সে প্রথম থেকেই প্রচন্ড কৃচ্ছতা শুরু করে দিল। এদিকে ক্লাসও শুরু হয়েছে। হোস্টেলের নিচে এক আজারবাইজানি লোক রুটি-মাখন বিক্রি করতো। মাখনের উপরে পুরু ক’রে জেলি দিয়ে দিত, সঙ্গে এক মগ গরম চা। খরচ খুব কম, মাত্র তেরো কোপেক। তাই খেয়ে আমরা ক্লাসে যাই। দুপুরে বাইরে কিছু খেয়ে নিই, রাতে ফিরে হোস্টেলের ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে হয়। পরে ছুটির দিনগুলিতে রান্নাবান্নার আয়োজন করা হলো। কিন্তু আলাউদ্দিন ঘোষণা দিল সে তিন বেলাই রুটি-মাখন-জেলি খাবে, সারা মাস। তাতে তার যে রুবল জমবে, তাই দিয়ে সে লন্ডন-স্টকহোম যাবে। কাজি শফিকের সঙ্গে আজিমের বন্ধুত্ব। শফিক ভাই আজিমকে নিজের রেকর্ড প্লেয়ার আর রেকর্ডগুলো দিয়ে দিলেন। এর মধ্যে একটা ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের লং প্লে। আমাাদের রুমে প্রায়ই দেবব্রত বিশ্বাসের গান বাজতে লাগলো। দেবব্রত আমার প্রিয় শিল্পী। তার ভরাট গলার গান শুনতে শুনতে মন চলে যায় হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা বাংলাদেশের মাঠ-ঘাট আর সবুজ প্রান্তরে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ফুলার রোড, আঠারো নম্বর বিল্ডিংয়ে আমাদের ফ্ল্যাট, পাড়ার মাঝখানের বিশাল কড়ই গাছ, ইকবাল হলের মাঠ, পুকুর, বন্ধুরা...আহা! এ কোথায় কতদূরে চলে এলাম! রাতের বেলা আলো নিভিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে গান শুনি আর স্মৃতির সাগরে ভাসতে থাকি। বাইরে বরফ ঝরা শীতের রাত আর ভেতরে চৈত্র দিনের গান বাজে দেবব্রত বিশ্বাসের উদাত্ত কন্ঠে: ‘চৈত্র পবনে মম চিত্ত বনে বাণী মঞ্জরী সংকলিতা ওগো ললিতা ওগো ললিতা...’ বসন্তের পরে আসে শীতের গান- ‘এ কী মায়া লুকাও কায়া জীর্ণ শীতের সাঁঝে আমার সয় না...’ বাড়িতে আমার দুই বোন, তাদের কথা ভাবি আমি- ছায়ানটে গান শেখে তারা, হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রতিদিনই প্র্যাকটিস করে। এই গানগুলো তাদের খুব প্রিয়, আমারও। ওদের কথা ভাবতে ভাবতে প্রিয় শিল্পীর সঙ্গে আমি গলা মেলাই মনে মনে- ‘রিক্ত পাতা শুষ্ক শাখে / কোকিল তোমার কই গো ডাকে?’ এখানে বরফের রাজ্য, ক্যাম্পাসের গাছপালাগুলো পাতাহীন, রিক্ত, নিঃস্ব। কালো কালো ডালের উপর গুুঁড়ি গুঁুিড় সাদা তুষার জমেছে, লম্বা কালো ডালগুলোকে দেখায় অতিকায় শুঁয়োপোকার মতো। এখানে কোকিল কোথায়...কোথায় কোকিলের ডাক? গান শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে শুনতে পাই কোকিলের ডাক, কু-উ কু-উ করে ডাকছে একটা কালো কোকিল আমার বাড়ির পাশের জাম গাছের ডালে বসে। আহা! কী তীব্র আর মায়াভরা তার ডাক! বাইরে বাকুর আকাশ থেকে সারারাত তুষার ঝরে। আমি স্বপ্ন দেখতেই থাকি...আমাদের তিনতলা ফ্ল্যাটের বারান্দায় আমরা পাঁচ ভাই-বোন। শবেবরাতের রাত। বারান্দার রেলিঙে জ্বলছে মোমবাতি। যেন দূর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ফেরেশতারা আলো দেখে আমাদের বাসায় আসে। (চলবে)
×