ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একক চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি বিশেষজ্ঞদের

সংক্রমণের শুরুতেই ওষুধ দিলে করোনায় মৃত্যু শূন্য

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ৫ জুন ২০২০

সংক্রমণের শুরুতেই ওষুধ দিলে করোনায় মৃত্যু শূন্য

রশিদ মামুন ॥ শুরুতেই সংক্রমণ চিহ্নিত করে ওষুধ প্রয়োগে করোনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এতে মৃত্যুহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা খুব বেশি কষ্টকর নয়। পাশাপাশি সামাজিক বিস্তৃতি বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন রোধ করে করোনাকে বিদায় জানানো যেতে পারে। দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, অর্থনীতিকে সচল রাখার স্বার্থেই আমরা সারাক্ষণ ঘরে বসে কাটাতে পারব না। এজন্য আমাদের একটি বিধিবদ্ধ চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। যাতে করোনা ভীতিকে জয় করা যায়। দেশে হু হু করে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। এখন পর্যন্ত সারাদেশে ৫৭ হাজার ৫৩৬ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৮১ জন মারা গেছেন। সারা বিশে^ এখন পর্যন্ত করোনার বিরুদ্ধে লড়েছেন ৬৫ লাখ ১৪ হাজারের বেশি মানুষ। আর বিশে^ তিন লাখ ৮৬ হাজার ২৮৯ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত মারা গেছেন। সারা বিশে^র মানুষের এখন একমাত্র মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে কোভিড-১৯। দেশের খ্যাতনামা বক্ষব্যধি বিশেষজ্ঞ, বক্ষব্যধি হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বার্তায় বলেন, করোনা থেকে বাঁচতে এখন দেশব্যাপী একটি চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তন করা যেতে পারে। যে কোন রোগী একদিনের জ¦র এবং শ্বাসকষ্ট হলেই সাধারণ চিকিৎসার সঙ্গে আইভারম্যাকটিন গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ডাঃ রাশিদুল বলেন, ওজন ৬০ কেজির কম হলে দুটি ট্যাবলেট একসঙ্গে একবার যে কোন বেলায়। অন্যদিকে ওজন ৬০ কেজির বেশি হলে তিনটি ট্যাবলেট একবারে একই বেলায় গ্রহণ করতে হবে। ওষুধটি আমাদের বাজারে ঞধন. ঝপধনড়, ওাবৎধ, চধৎধশরষ (৬সম) নামে পাওয়া যায়। এর সঙ্গে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সকালে দুটো এবং রাতে দুটো খেতে হবে। ওষুধটি জবপড়হরষ (২০০সম) বা অন্য অনেক নামে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এই ডোজটি যদি শুরুতেই আমরা দিতে পারি তাহলে ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। মানুষের যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে তা দিয়ে ৫০ থেকে ৮০ ভাগ ভাইরাসই প্রতিরোধ করা সম্ভব। কারো কারো ক্ষেত্রে ১০০ ভাগই সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও রয়েছে। কারো কারো শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে তার ওষুধের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে করোনার পরীক্ষা হোক বা না হোক বিষয়টি ক্ষতিকর হবে না বলেও দাবি করেন তিনি। এই বক্ষব্যধি বিশেষজ্ঞ বলেন, এই চিকিৎসা পদ্ধতি যদি আমরা প্রবর্তন করতে পারি তাহলে মৃত্যুর হারকে আমরা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনতে পারব। এক্ষত্রে জ¦র বা শ^াসকষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ্যাজমা, সিওপিডি বা সাধারণ জ¦র হলে যে ওষুধ সেবন করেন সেগুলো চালিয়ে যাবে। একই সঙ্গে যাদের বয়স ৫০ এর উপরে তারা রিভারক্সবেন প্রতিদিন একটি করে ১০ দিন থেকে এক মাস গ্রহণ করবেন। ওষুধটি বাজারে জরাধৎড়ী- (১০সম), জরাধী- (১০সম) জরাধনবহ- (১০সম) নামে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। তবে কেউ এ্যাসপ্রিন ক্লোপিডোজার্ল জাতীয় রক্ত তরল করার ওষুধ খেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রিভারক্সবেন গ্রহণ করবেন। রক্ত জমাট না বাঁধে একসঙ্গে এমন দুটি ওষুধ খেলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে বলেও তিনি সতর্ক করেন। এভাবে কারো যদি পর পর তিন সপ্তাহ জ¦রও আসে তার ক্ষেত্রে একই মাত্রার ওষুধ সেবনের পারামর্শ দিয়ে বলেন, এতে মানুষের শরীরের কোন ক্ষতি হবে না। এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শও নিতে বলেন। সারা বিশে^ই এখন করোনা প্রতিরোধের অন্যতম বড় উপায় হিসেবে শুরুতেই সংক্রমণ চিহ্নিত করাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এতে করে বিশে^ মৃত্যুহার আগের তুলনায় কমে এসেছে। তবে এখনও করোনার সংক্রমণ খুব একটা কমেনি। বরং প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তবে, যেহেতু নিরাময়ের জন্য ওষুধ মানুষের হাতের নাগালেই রয়েছে সেগুলো সময়মতো প্রয়োগেই মিলতে পারে সাফল্য। তবে দেশে এক্ষেত্রে সময়মতো করোনার পরীক্ষা না হওয়াকে বড় একটি সমস্যা মনে করছেন অনেকে। সাধারণত করোনা সংক্রমণের পর লক্ষণ প্রকাশ পেতে কয়েকদিন সময় লেগে যায়। এরপর লক্ষণ প্রকাশের তিন দিন পর করোনা টেস্ট করা হয়। আর এই টেস্টের রেজাল্ট হাতে পেতে কমপক্ষে আরও ৭২ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এই সময়ের পরিমাণ আরও বেশি। সেক্ষেত্রে রোগী ভাইরাস নির্মূলের জন্য কোর রকম ওষুধ না গ্রহণ করলে সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এজন্য বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনা চিকিৎসায় টেস্ট করানোর ওপর সব থেকে বেশি জোর দিচ্ছে। তবে করোনা চিকিৎসায় পিসিএর কিটের মাধ্যমে যে টেস্ট করা হয় এটি ব্যয় বহুল এবং ল্যাবে করতে হয়। চাইলেই মানুষের দরজায় দরজায় ল্যাব নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বিকল্প হিসেবে অনেক দেশ র‌্যাপিড কিট দিয়ে টেস্ট করছে। আমাদের দেশেও এটি শুরু করা জরুরী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। অধ্যাপক ডাঃ মোঃ রাশিদুল হাসান বলেন, করোনার ক্ষেত্রে শুরুতেই যদি আমরা চিকিৎসা দিতে পারি সেক্ষেত্রে রোগীর অক্সিজেনও প্রয়োজন হয় না। এমন ওষুধ আমাদের হাতের নাগালে অল্প পয়সায় মিলছে। তবে করোনা ভাইরাস এত বেশি শক্তিশালী যে একটু দেরি হলেই আর এসব ওষুধ কাজ করছে না। তখন রোগী বিপাকে পড়ছেন। এজন্য শুরুতেই সংক্রমণ চিহ্নিত করে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। তিনি বলেন, করোনা রোগী আমাদের কাছে এলে আমরা শুরুতে তার অক্সিজেন লেভেল কত আছে তা দেখছি। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা (এসপিওটু) এর পরিমাণ ৯৫ থেকে ৯২ এর মধ্যে থাকলে আমরা ধরে নেই তার মৃদু সংক্রমণ ঘটেছে। এছাড়া এসপিওটু ৯২ থেকে ৮৮ পর্যন্ত মাঝারি সংক্রমণ এবং ৮৮ নিচে হলে ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ হয়েছে। তখন আমরা রোগীর করোনা চিকিৎসার সঙ্গে বুকের এক্স-রে, সিবিসি এবং সিআরপি করি। সিবিসি স্বাভাবিক থাকলেও সিআরপি ২০ এর ওপর থাকার সঙ্গে ফুসফুসে সামান্য সামান্য সাদা ছোপ ছোপ দাগ আসে। এজন্য তার অক্সিজেন প্রয়োজন না হয়। রাশিদুল হাসান বলেন, পৃথিবীতে এখন করোনা চিকিৎসায় কিছু ওষুধের ভাল ফল পাওয়া গেছে। এসব উদাহরণ আমাদের দেশেও রয়েছে। তিনি দেশে করোনা চিকিৎসায় বহুল ব্যবহৃত আইভারম্যাকটিন ব্যবহারের ওপর জোর দেন। এর সঙ্গে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারে ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান। ডাঃ রাশিদুল হাসান বলছেন, এসপিওটু’র পরিমাণ যখন ৯০ এর উপরে থাকে তখন করোনা সারাতে আইভারম্যাকটিন এবং হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সফল হচ্ছে। কিন্তু সংক্রমণের মাত্রা বেশি হলে আর এসব ওষুধ কাজ করে না। তখন এসব ওষুধ প্রয়োগে রোগীর আরও ক্ষতি হয়। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাকে উদ্ধৃত করে বলেন, সেখানে ৯০ হাজার রোগীকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগ করা হয়েছিল, যাদের সংক্রমণের মাত্রা বেশি ছিল। তাদের জন্য এটি আরও বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে সংক্রমণের একেবারে শুরুতে প্রয়োগের কথা বলছেন তিনি। এর আগে বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডাঃ তারেক আলম তার হাসপাতালে ৬০ রোগীর ওপর আইভারম্যাকটিন প্রয়োগ করে চমকপ্রদ ফল পাওয়ার কথা জানান। তখন পরজীবী ধ্বংসকারী ওষুধটির কার্যকারিতা নিয়ে কেউ কেউ বিরোধিতা করেন। তবে পুলিশ হাসপাতালে ব্যাপকভাবে আইভারম্যাকটিন প্রয়োগে বিস্ময়কর সাফল্য পাওয়ার পর ডাঃ তারেক আলমের পক্ষেই সমর্থনের পাল্লা ভারি হয়। দেশের সীমানা পেরিয়ে ডাঃ তারেক আলমের দেখানো পথ ধরে ভারতেও ওষুধটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়। অর্থাৎ সংক্রমণের শুরুতেই আইভারম্যাকটিন প্রয়োগে ভাল ফল পাওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রমাণিত। তবে এটির আরও পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালানো হচ্ছে। অন্যদিকে শুরু থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনে করোনা প্রতিরোধের দাবি করে আসছে। দেশটি ব্যাপকভাবে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহারও করছে। এমনটি ট্রাম্প করোনা থেকে বাঁচতে আগেভাগেই হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন গ্রহণ করেছেন। করোনা হওয়ার আগে থেকেই হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন গ্রহণ করার খবর ছড়িয়ে পড়লে বাদ সাধে ডব্লিউএইচও। তারা বিবৃতি দিয়ে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে বলেন। এ বিষয়ে আরও নিবিড় গবেষণা চলছে বলেও ডব্লিউএইচওর পক্ষ থেকে জানানো হয়। বৃহস্পতিবার আগের ঘোষণা থেকে সরে এসেছে ডব্লিউএইচও। এখন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক টেডরস আধামন ঘেব্রেইসাস সম্প্রতি ওষুধটির ট্রায়াল বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে করোনার সংক্রমণ বেশি হলে অর্থাৎ রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ ৮৮-এর নিচে হলে রোগীকে অক্সিজেন দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ পরিবর্তন করতে হবে। এক্ষত্রে রেমডিসিভির প্রয়োগ করার ওপর জোর দিয়েছেন ডাঃ রাশিদুল হাসান। একই সঙ্গে তিনি বলেন, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯০ থেকে ৮৮ এর মধ্যে হলে ফেবিপিরাভির দিতে হবে। এটি প্রথমদিন ওজন ৪০ কেজির বেশি হলে সকালে এবং রাতে আটটি করে ১৬টি খেতে হয়। এর পর সকালে এবং রাতে তিনটি করে মোট ছয়টি ট্যাবলেট ৭ থেকে নয় দিন খেতে হয়। তবে এন্টিবায়োটিক গ্রহণে ভাইরাস নেগেটিভ হওয়ার সম্ভাবনা নেই জানিয়ে বলেন, এটি অন্য উপসর্গ থেকে বাঁচাতে পারে। সেক্ষেত্রে ডক্সিসাইক্লিক বা এজিথ্রোমাইসিন গ্রহণ করা যেতে পারে।
×