ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভর্তুকি মূল্যে চাল ডাল পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হবে

বাজেটে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল নেয়া হচ্ছে

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ৫ জুন ২০২০

বাজেটে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল নেয়া হচ্ছে

এম শাহজাহান ॥ করোনা সঙ্কটের মধ্যে ভোগ্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনার কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে নতুন বাজেটে। ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে বাজারে ন্যায্যদাম নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া স্বল্প আয়ের মানুষদের স্বস্তি দিতে কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহের মতো চ্যালেঞ্জ নিচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্যে আসন্ন প্রস্তাবিত বাজেটে সার্বিক গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া, খাদ্যপণ্য আমদানি ও উৎপাদনে সহায়ক শুল্ককর ও ভ্যাট নীতি অবলম্বন ও ভর্তুকি মূল্যে বাজারে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের মতো পণ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখা হবে। আশা করা হচ্ছে, চলমান করোনা সঙ্কটের মধ্যেও জিনিসপত্রের দাম ক্রেতাদের নাগালের মধ্যে থাকবে। বিশেষ করে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, চিনি ও আটার মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের আমদানিতে সর্বোচ্চ রেয়াতি সুবিধা দেয়া হবে। করোনা সঙ্কটের শুরুতে চালের দাম বাড়লেও বোরোর বাম্পার ফলনে ইতোমধ্যে চালের দাম কমে গেছে। স্থিতিশীল রয়েছে অন্যান্য পণ্যের দাম। এ কারণে বাজেট ঘোষণার পর এবার ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না বলে সংশ্লিষ্টরা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। জানা গেছে, গত ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার, গড় মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার কৌশল নিয়েছিল। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের ঘরে অবস্থান করছে। এটাকে সরকারের অন্যতম অর্থনৈতিক সাফল্য বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এপ্রিল ও মে মাসে দেশজুড়ে লকডাউন ছিল। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছিল দেশের সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকা-। এরকম পরিস্থিতিতেও গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের মে মাসের মূল্যস্ফীতি ভাল অবস্থানে রয়েছে বলে দাবি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। চলতি বছরের মে মাসে মূল্যস্ফীতির হার জাতীয় পর্যায়ে ৫ দশমিক ৩৫ ভাগ, যা এপ্রিলে ছিল ৫ দশমিক ৯৬ ভাগ এবং ২০১৯ সালের মে মাসে ছিল ৫ দশমিক ৬৩ ভাগ। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি গত মে মাসে কমেছে। মে মাসে খাদ্যপণ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্য উভয় খাতেই মূল্যস্ফীতি কমেছে। বিবিএস আরও বলছে, গত মে মাসে আগের এপ্রিল মাসের তুলনায় চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ডিম, শাকসবজি ইত্যাদির দাম কমেছে। ফলে মে মাসে মূল্যস্ফীতি কমে যায়। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, করোনার মধ্যে পণ্য সরবরাহ ঠিক থাকায় মূল্যস্ফীতি কমেছে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমায় ভোগ্যপণ্য নিয়ে মানুষকে এই সঙ্কটের মধ্যেও হা হুতাশ করতে দেখা যায়নি। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব ধরনের কর ছাড়, ভর্তুকি ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। আর এ কারণে কোন পণ্যের দাম বাড়েনি। তিনি বলেন, আসছে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দাম কমানোর কৌশল গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, মে মাসে সার্বিকভাবে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি কমেছে। বিবিএসের তথ্য উপাত্ত তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ০৯ শতাংশ। এপ্রিল মাসে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ। মে মাসে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। এপ্রিল মাসে এই হার ছিল ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ। গত মে মাসে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি ছিল। গত মাসে শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ, আর গ্রামে ছিল এ হার ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ জানা গেছে, গত ২০০৭-০৮ অর্থবছরে চালসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ওই সময় ক্ষমতাসীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের সঙ্গে সঙ্গে ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ হাঁসফাঁস করতে থাকে। পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আসতে শুরু করে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোর অগ্রগতির ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সফল হয়েছে বর্তমান সরকার। এই সাফল্যের পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এগুলো হচ্ছে- আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অব্যাহতভাবে কমে যাওয়া এবং অন্যটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজারে বোরো, আমন ধান ও সবজি উৎপাদনসহ সার্বিক খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতামূলক মুদ্রানীতির প্রভাব। এছাড়া ভারত ও চীনে মূল্যস্ফীতি কমার পাশাপাশি জিনিসপত্রের দাম কমে যাওয়ার সুফল পেয়েছে বাংলাদেশ। কারণ এই দেশ দুটি থেকে সিংহভাগ পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। এছাড়া কৃষিসহ উৎপাদনশীল লক্ষ্যভিত্তিক ঋণ সরবরাহ, ক্রমহ্রাসম্যান সুদের হার, বাজার সংবেদনশীল মুদ্রা বিনিময় হার এবং সব মিলিয়ে প্রবৃদ্ধি সহায়ক মুদ্রানীতির ধারাবাহিকতা অর্থনৈতিক কর্মকা-ের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কয়েক বছর ধরেই নিম্নমুখী রয়েছে। আর এ কারণেই আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর দাম আরও কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও বেকার মানুষ বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে অনেকে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছেন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে করতে অনেকে হেরে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকারকে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, আগামী ১১ জুন বৃহস্পতিবার মহান জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। করোনা থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বাজেট প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকা- সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এছাড়া দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ওএমএস ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর আওতায় ১০ টাকায় প্রতিকেজি চাল বিক্রি করা হচ্ছে। সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবি ভর্তুকি মূল্যে পেঁয়াজ, ভোজ্যতেল, ডাল, তিনিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য বিক্রি করছে। এতে বাজারে জিনিসপত্রের দাম স্বাভাবিক রয়েছে। এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, বাজেটে এখন সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হলো ভোক্তা বা সাধারণ মানুষের ক্রয় সামর্থ্য বাড়ানো। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসেবে নগদ সহায়তাসহ যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, এগুলো আগামী বছরও অব্যাহত রাখতে হবে। বাজেটে এর প্রতিফলন থাকবে বলে আমরা আশা করছি। তিনি বলেন, মানুষের ক্রয় সামর্থ্য বাড়ানোর আরেকটি উপায় হলো বেসরকারী খাতকে আয়ে ফিরিয়ে আনা। এজন্য এ খাতে বিভিন্ন প্রণোদনা ও প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দিতে হবে। জানা গেছে, নতুন বাজেটে খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি উৎপাদন বাড়াতে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেয়া হবে, যা এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক থাকবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
×