ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিনা মূল্যে সব করে দেবে সরকার ব্যবহার করা হবে ‘কালিকাপুর মডেল’ বসতবাড়ির ছাদেও সারাবছর শাক সবজি উৎপাদন

আঙ্গিনায় সবজি চাষ ॥ করোনা পরবর্তী সঙ্কট মোকাবেলায় পারিবারিক কৃষিতে জোর

প্রকাশিত: ২২:৪১, ৫ জুন ২০২০

আঙ্গিনায় সবজি চাষ ॥ করোনা পরবর্তী সঙ্কট মোকাবেলায় পারিবারিক কৃষিতে জোর

ওয়াজেদ হীরা ॥ করোনা পরবর্তী সময়ে খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় পারিবারিক কৃষিকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এজন্য বসতবাড়ির আঙ্গিনা থেকে বাসাবাড়ির ছাদেও নানা ধরনের শাকসবজি উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এতে উৎপাদিত পণ্যে পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত হলে বিক্রি করে অর্থও উপার্জন করা যাবে। পারিবারিক কৃষিতে সাফল্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অধিক উৎপাদনের জন্য ‘কালিকাপুর’ নামে একটি মডেল অনুসরণ করা হবে। দেশের প্রত্যেক ইউনিয়নের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে এই ‘কালিকাপুর মডেল’ ব্যবহার করে কৃষকদের বিনামূল্যে সব করে দেবে সরকার। জানা গেছে, খাদ্য উৎপাদনের বর্তমান ধারা আরও বৃদ্ধি করতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসরণ করে দেশের এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখতে চায় না কৃষি মন্ত্রণালয়। বাড়ির পাশের জায়গাগুলোতেও উৎপাদন করতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। শহরের বাসাবাড়ির ছাদেও বিভিন্ন শাকসবজি উৎপাদনে উৎসাহিত করছে। পারিবারিক কৃষিও তারই একটি অংশ। করোনার করাল গ্রাস নিয়ে ইতোমধ্যে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। এর ফলে কোন কোন দেশে খাদ্য সঙ্কট বা দুর্ভিক্ষও হতে পারে। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছে সরকার। জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অঞ্চলভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে শাকসবজি উৎপাদন মডেল অনুসরণ করে সারা বছর শাকসবজি উৎপাদন সম্ভব। বসতবাড়িতে সবজি ও ফল চাষের মাধ্যমে পরিবারের সব সদস্যের শ্রম উৎপাদন কাজে ব্যবহার এবং মহিলা ও ছেলেমেয়েদের অলস সময় সবজি চাষের কাজে লাগিয়ে পারিবারিক শ্রমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এছাড়া পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বিক্রি করে পরিবারের জন্য বাড়তি আয়ের সংস্থান করা যায়। এলাকাভিত্তিক কৃষি সমস্যা শনাক্তকরণ ও তা সমাধানের লক্ষ্যে গবেষণা পরিচালনা করতে গিয়ে বিভিন্ন মডেল আবিষ্কার করা হলেও বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সারাবছর শাকসবজি পেতে কালিকাপুর মডেল প্রথম এবং অন্যতম মডেল। এর জন্য প্রয়োজন মাত্র ১ শতাংশ জমি। যাদের বাড়ির আঙ্গিনায় এক শতাংশ জমি আছে এমন কৃষকদের সরকারী খরচে সব করে দেয়া হবে। কৃষক শুধু দেখাশোনা করবে আর উৎপাদিত পণ্য ভোগ করবে। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুুর রাজ্জাক জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের মডেল ব্যবহার করে পরিবারের চাহিদা মেটানো হবে। মডেলটি কিছু মডিফাই করা হবে। খাদ্য উৎপাদনের বর্তমান ধারা আরও বৃদ্ধি করতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চলছে বলেও জানান কৃষিমন্ত্রী। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, দেশে খাদ্য উৎপাদনে যে অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে এবং উৎপাদনের যে উচ্চ প্রবৃদ্ধি চলমান রয়েছে সেখানে থেমে গেলে হবে না। সেজন্য তা আরও বেগবান ও ত্বরান্বিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী করোনার দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য দেশের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির বর্তমান ধারা শুধু অব্যাহত রাখা নয়, তা আরও বেগবান ও ত্বরান্বিত করতে কৃষি মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করছে। যাতে করে দেশে খাদ্যের কোন ঘাটতি না হয়, দুর্ভিক্ষ না হয়। বরং দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের সম্ভাব্য খাদ্য সঙ্কটে আর্তমানবতার সেবায় বাংলাদেশ যাতে তার উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য নিয়ে সহযোগিতা করতে পারে। এ বিষয়ে কৃষি সচিব মোঃ নাসিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা প্রত্যেক ওয়ার্ডে এই ব্যবস্থা করব। প্রতি ওয়ার্ডে ছয়জনকে এর আওতায় আনব। সারাদেশে এজন্য ব্যয় করব ৫০ কোটি টাকা। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কৃষকদের বেড তৈরি করে দিবে, রক্ষা করতে বেড়া তৈরি করে দিবে, সার-বীজ সবই দেয়া হবে জমির মালিক শুধু দেখাশোনা করবেন আর ফসল ভোগ করবেন। সচিব বলেন, এজন্য আমরা একটি মডেল ব্যবহার করব। আঞ্চলিক চাষাবাদের ক্ষেত্রে দেশে প্রথম মডেল। কালিকাপুর মডেলটি একটু আপডেট করে অনুসরণ করব। যাতে মাত্র এক শতাংশ জমিতেই কৃষক ১৪টির মতো শাকসবজি আবাদ করতে পারেন। একটির পর একটি ফসল উঠবে। এতে পরিবারের চাহিদা মিটবে। বেশি উৎপাদন হলে কিছু বিক্রি করবে। বারির সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোঃ ফারুক হোসেন জনকণ্ঠকে মডেল নিয়ে বলেন, একে অঞ্চলের চাহিদাকে সামনে রেখে নানা ধরনের মডেল গবেষণায় উঠিয়ে আনা হয়েছে। আমরা এখনও মডেল নিয়ে কাজ করছি। এসব পারিবারিক চাহিদা মেটাতে খুবই কার্যকর। মডেলটি যেভাবে ব্যবহৃত হয় ॥ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউটের তথ্যে দেশের প্রথম কালিকাপুর মডেলটি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার কালিকাপুরে অবস্থিত ফার্মিং সিস্টেম গবেষণা এলাকায় ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে এ সবজি উৎপাদন মডেল উদ্ভাবন করা হয়। এ মডেলের সবজি বিন্যাস অনুসরণ করে চাষাবাদের মাধ্যমে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিবারের সারাবছরের সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। বারির তথ্য অনুযায়ী, এজন্য বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ৫ বাই ৬ মিটার মাপের বাগান তৈরি করতে হবে। উঁচু স্থান বেছে নিলে ভাল হবে। নির্বাচিত জমিতে ৫ মিটার লম্বা ৮০ সেমি চওড়া ৫টি বেড তৈরি করতে হবে এবং দুই বেডের মাঝখানে নালা থাকবে ২৫ সে. মিটার। সবজি বিন্যাস হিসেবে জানা গেছে, প্রথম খ-ের বিন্যাসে মুলা/টমেটো/লালশাক/-লালশাক-পুঁইশাক, দ্বিতীয় খ-ের বিন্যাসে: লালশাক+বেগুন-লালশাক-ঢেঁড়শ, তৃতীয় খ-ের বিন্যাসে পালংশাক-রসুন/লালশাক-ডাঁটা-লালশাক, চতুর্থ খ-ের বিন্যাসে বাটিশাক-পেঁয়াজ/গাজর-কলমিশাক-লালশাক, পঞ্চম খ-ের বিন্যাসে বাঁধাকপি-লালশাক-করলা-লালশাক করা যেতে পারে। এছাড়াও কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে কৃষকের প্রয়োজন ও উপযোগী ফসল মডেলে ব্যবহার করতে পারে। জানা গেছে, কালিকাপুর এফএসআর এলাকাটি ১৯৯৭ সালে পাবনার সদর উপজেলার গয়েশ্বরপুরে স্থানান্তর করা হয়। পরে দীর্ঘদিন গবেষণা চালিয়ে একটি নতুন মডেল আবিষ্কার করা হয় যা ‘গয়েশ্বরপুর মডেল’ নামে পরিচিতি পায়। এই মডেল ব্যবহার করে শাকসবজির পাশাপাশি ফল ও কিছু মসলা জাতীয় ফসল আবাদ করা যায় যাতে পরিবারে পুষ্টি অনেকটাই মেটানো সম্ভব হয়। এছাড়াও দেশের সবজি উৎপাদনে আরও কয়েকটি মডেল ব্যবহার করা হয় এর মধ্যে ‘লেবুখালি মডেল’, ‘কলাপাড়া মডেল’, ‘পালিমা মডেল বা টাঙ্গাইল মডেল’, সিলেট অঞ্চলের জন্য ‘গোলাপগঞ্জ মডেল’ ‘ঈশান গোপালপুর মডেল’, ‘আট কপালিয়া মডেল’, ‘রংপুর মডেল’, ‘বরেন্দ্র মডেল’, ‘খাগড়াছড়ি মডেল’ ইত্যাদি ব্যবহৃত হচ্ছে। বসতবাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষের সুবিধা ॥ কৃষি সংশ্লিষ্ট ও কৃষিবিদরা জানান, অল্প পরিমাণ জমিতে অনেক ধরনের সবজি ও ফল আবাদ করা যায়। সবজি আবাদে অপেক্ষাকৃত কম সময় লাগে। একই জমিতে বছরে কয়েকবার সবজি চাষ করা সম্ভব। পুষ্টির দিক থেকে প্রায় সব শাকসবজি উন্নত মান সম্পন্ন হয়ে থাকে। ফলে বছরব্যাপী উপযুক্ত পরিমাণ সবজি খেয়ে পুষ্টিহীনতা দূর করা এবং রোগমুক্ত থাকা সম্ভব হয়। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বিক্রি করে পরিবারের জন্য বাড়তি আয়ের সংস্থান করা যায়। বসতবাড়ির আঙ্গিনায় পরিবারের মহিলা ও ছেলেমেয়েদের অবসর সময়ে সবজি চাষের কাজে লাগিয়ে পারিবারিক শ্রমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এদিকে গত কয়েক দশকে দেশে ছাদ বাগানের গুরুত্বও বেড়েছে। শহরের ছাদ বাগানগুলোতে ফুল ফলের গাছের পাশাপাশি অনেকেই শাকসবজি লাগাচ্ছেন। রাজধানীর বিভিন্ন বাসাবাড়ির ছাদে দেখা মেলে এক টুকরো করে সবুজ উদ্যান। ইস্কাটনে নিজের বাসায় বেগুন, টমেটো, মরিচ, লাউ লাগিয়ে ফসল পাচ্ছেন ইমতিয়াজ হোসেইন। শখের বশে করলেও এখন উৎপাদিত পণ্যের কারণে বাজার থেকে অনেক সবজি সাশ্রয় হচ্ছে তার। একই বাসায় ছাদে কুমড়ো লাগিয়েছেন গৃহিণী সরিফা খাতুন। এছাড়াও নিজেদের লাগানো পুঁই শাক, লালশাক, ধনে পাতাও রয়েছে। তিনি বলেন শখের বশে লাগালেও উৎপাদন ভালো। বেশি করে লাগালে একটি পরিবারের কখনই সবজির জন্য বাজারে যেতে হবে না বলেন তিনি। রাজধানীর বিভিন্ন ছাদ বাগানে বিভিন্ন ধরনের ফুল ও ফলের গাছ লাগানোর দৃশ্যও দেখা গেছে। কৃষি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশে যারা ছাদ বাগান করেন শখের বশে তারা এখন নিয়মিত যদি বিভিন্ন শাকসবজি করেন তাহলে নিজেদের চাহিদা মেটার পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে দেশের উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এজন্য ছাদ বাগানে ফুল ফলের পাশে একটু করে হলেও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির জন্যও তারা গুরুত্বারোপ করেন।
×