ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ স্বামী-স্ত্রী সংসার

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ৫ জুন ২০২০

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ স্বামী-স্ত্রী সংসার

মানব সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম দম্পতি হচ্ছেন হযরত আদম আলায়হিস সালাম ও হযরত হাওয়া আলায়হাস সালাম। তাঁরা আসমানী সুখের বাগিচা জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পৃথিবীতে আসেন শুধুমাত্র একটা ভুলের জন্য আর তা হচ্ছে, আল্লাহর নিষেধ সত্ত্বেও ইবলিস শয়তানের প্ররোচনায় একটি গাছের কাছে গিয়ে ভুলক্রমে সেই গাছের ফল খেয়ে ফেলেছিলেন। কুরআন মজীদে এর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আল্লাহ জাল্লাহ শানুহু ইরশাদ করেন : যখন আমি ফেরেশতাদের বললামÑ আদমকে সিজ্্দা করো, তখন ইবলিস ব্যতীত সবাই সিজদা করল। সে (ইবলিস) অমান্য করল ও অহঙ্কার করল। সুতরাং সে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হলো এবং আমি বললাম : হে আদম! তুমি ও তোমরা স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করো, যেখানে ইচ্ছা স্বচ্ছন্দে আহার করো, কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়ো না, যদি হও তাহলে তোমরা অন্যায়কারীদের (জালিম) অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। কিন্তু শয়তান (ইবলিস) তা থেকে তাদের পদস্খলন ঘটাল এবং তারা যেখানে ছিল সেখান (জান্নাত) থেকে বহিষ্কৃত হলো। আমি বললাম, তোমরা একে অন্যের শত্রুরূপে নেমে যাও। পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল। (সূরা বাকারা : আয়াত (৩৪-৩৬)। হযরত আদম ‘আলায়হিস সালাম ও হযরত হাওয়া ‘আলায়হাস সালাম জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসবার সময় ছিটকে যান। হযরত হাওয়া গিয়ে পড়েন জেদ্দায় এবং হযরত আদম পড়েন শ্রীলঙ্কায়। জেদ্দার সে স্থানটি আজও সংরক্ষিত আছে এবং শ্রীলঙ্কায় যে পাহাড় চূড়ায় হযরত আদম আলায়হিস সালাম পড়েছিলেন সেই পাহাড় চূড়াটি আজও সংরক্ষিত আছে। এই পাহাড় চূড়াটিকে হিন্দু ও বৌদ্ধরা বলে শ্রীশ্রী পাদম, মুসলিমরা বলে বাবা আদম পাদম আর খ্রীস্টানরা বলে এ্যাডাম্্স পিক। পর্তুগীজ ভাষায় একে বলা হয় পিকোডি এ্যাডাম। এখানে একটি বিশাল পাথরে হযরত আদম আলায়হিস সালামের পায়ের ছাপ দেখা যায়। হযরত আদম আলায়হিস সালাম এখানে আর হাওয়া ‘আলায়হাস সালাম জেদ্দায় দীর্ঘ সাড়ে তিন শ’ বছর বিচ্ছেদ অবস্থায় থেকে রাতদিন তাঁদের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে কান্নাকাটি করতে থাকেন। অতঃপর হযরত মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হিস সাল্লামের উসিলায় তাঁদের তওবা কবুল করেন আল্লাহ্। তাঁরা এই সাড়ে তিন শ’ বছর যে বাক্য উচ্চারণ করে কান্নাকাটি করেছিলেন তা হচ্ছে রব্বানা জলামনা আন্ফুসানা ওয়া ইল্লাম তার্গ্ফিলানা ওয়াতার হামনা লানা কুনান্না মিনাল খাসিরীন- হে আমাদের রব্! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি, আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু আদম-হাওয়া এই প্রথম স্বামী-স্ত্রীকে দীর্ঘকাল পর এক জায়গায় মিলন ঘটালেন যে স্থানে সেই স্থানটির নাম হয়ে গেল আরাফাত-পরস্পর পরিচিত হওয়ার স্থান। প্রতিবছর জিলহজ মাসের ৯ তারিখে এই আরাফাত ময়দানেই হজের মূল অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এই দিবসটাকে ইয়াওমুল হজ- হজের দিবস বা ইয়াওমুল আরাফা-আরাফা দিবস বলা হয়। হযরত আদম ও হাওয়ার স্মৃতিবিজড়িত এই আরাফাত ময়দানেই রোজ হাশরে বিচারকার্য অনুষ্ঠিত হবে। হযরত আদম-হাওয়া আরাফার ময়দান থেকে তিন মাইল পশ্চিমে এগিয়ে এসে পাহাড় বেষ্টিত যে স্থানটিতে রাত যাপন করলেন সে স্থানটির নাম মুযদালিফা। এখানেই তাঁরা সর্বপ্রথম সন্তান প্রজনন ক্রিয়া সম্পন্ন করেন বলে জানা যায়। যে কারণে জায়গাটিকে মুযদালিফা বলা হয়। তারপর তাঁরা মুযদালিফা থেকে প্রায় ৬ মাইল দূরে এসে যে পাহাড়বেষ্টিত স্থানে এসে সংসার গড়ে তোলেন সে স্থানের প্রাচীন নাম বাক্কা, যা পরবর্তীতে মক্কা মুর্কারমা নামে পরিচিত হয়। এখানে তাঁরা সংসার গড়ে তোলেন। তাঁদের বহু সন্তান-সন্তুতি হয়। তাঁদের জোড়ায় জোড়ায় (এক ছেলে এক মেয়ে) সন্তান হতে থাকে। এক জোড়ায় ছেলে এবং অন্য জোড়ার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে-শাদির ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু হাবিল কাবিল আদমের এই দুই সন্তান একই মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে এবং শেষমেশ সেই মেয়েটিকে পাওয়ার জন্য কাবিল হাবিলকে পাথরের আঘাতে হত্যা করে। পৃথিবীতে প্রথম মৃত্যু সংঘটিত হয় একটি মেয়েকে কেন্দ্র করে। প্রেম ঘটিত সংঘাতে এভাবেই এক সংসার বহু সংসারে পরিণত হতে হতে মানব সংসার জগতজুড়ে জগত সংসারে পরিণত হয়। সংসার গঠিত হয় মূলত স্বামী-স্ত্রী যৌথ পরিশ্রমে। ইসলাম স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক মর্যাদা সমান স্তরে উন্নীত করেছে। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : হুন্না লিবাসুল্লাকুম ওয়া আন্তুম লিবাসুল লাহুন্না- তারা (স্ত্রীগণ) তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)। স্বামী-স্ত্রীর পরিশ্রমেই সংসার গড়ে ওঠে। কথায় আছে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। ইসলাম বিদ্যা অর্জনকে নর-নারী উভয়ের ক্ষেত্রে অবশ্য কর্তব্য হিসাবে ঘোষণা করে। যে সংসারে শিক্ষার আলো আছে, বিশেষ করে শিক্ষিতা মাতা আছে মূলত সেই সংসার গোছাল সংসারে পরিণত হয়; সেই সংসারের ছেলেমেয়ে, সন্তান-সন্ততিরা সাধারণত মনুষ্যত্বের গুণাবলীসমৃদ্ধ হয়ে বেড়ে ওঠে। আলোকিত সংসার আমার সেই সংসারকে বলতে পারি। অবশ্য ক্ষেত্র বিশেষে যে সংসারে পিতা-মাতা উভয়েই চাকরি করেন কিংবা পিতা-মাতার মধ্যে ঝগড়াবিবাদ লেগেই থাকে সেই সংসারে বা পরিবারকে সমাজ বিজ্ঞানের ভাষায় ব্রোকেন ফ্যামিলি বা ভাঙ্গা পরিবার বলে, আমি সেই সংসারের কথা বলছিনে। যে স্বামী-স্ত্রী একটা প্রীতিকর পরিবেশে তাদের সংসার বিন্যস্ত করতে পারে, পারস্পরিক সহনশীলতা, সমঝোতা, সম্প্রীতি এবং কর্মবণ্টনে সমতা ও সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারে তা সুখের হয়ে ওঠে। হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : কোন মুমিন নর যেন কোন মুমিন স্ত্রীকে তার শত্রু না ভাবে। কেননা সে যদি তার কোন একটা ব্যাপার অপছন্দ করে তবে তার অন্য একটা ব্যাপারকে পছন্দ করবে (মুসলিম শরীফ)। এখানে এটাই বোঝানো হয়েছে যে, স্বামী বা স্ত্রী দুজনার কারও একটি মন্দ আচরণের জন্য তার প্রতি অসদাচরণ না করে তার যেগুলো ভাল গুণ আছে সেসব দিক বিবেচনায় এনে মন্দটার কথা ভুলে যেতে হবে নরম কায়দায় তাকে সংশোধিত করার মাধ্যমে। আল্লাহ্্ জাল্লা শানহু ইরশাদ করেন : স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও। (সূরা নিসা : আয়াত ৩৪) কুরআন মজিদে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সমান অধিকারের বিধান দিয়ে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : স্ত্রীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে যেমন আছে তাদের ওপর স্বামীদের। (সূরা বাকারা : আয়াত ২২৮)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ (স) ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জিলহজ শুক্রবার দুপুর বেলায় বিদায় হজের ভাষণে স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন : ইত্তাকুল্লাহা ফীনইনসায়ে ফাইন্নাকুম আখাযতুমূহুন্না বিআমানিল্লাহি ওয়াস্্ তাহলালতুম্ ফুরুজাহুন্না বিকালিমাতিল্লাহ- তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে তোমাদের নারীদের ব্যাপারে। কেননা, তোমরা আল্লাহর জিম্মাদারিতে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর নির্দেশেরই আওতায় তাদের স্পর্শকাতর অঙ্গ তোমাদের জন্য হালাল করে নিয়েছ। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ) তিনি সেই ভাষণে আরও বলেছিলেন, তোমাদের স্ত্রীদের ওপর যেমন, তোমাদের হক (অধিকার) আছে তেমনি হক তাদেরও তোমাদের ওপর আছে। (ওই)। স্ত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ করতে আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ করেন : ওয়া ‘আশিরূহুন্না বিল্্ মারূফ- আর তোমরা তাদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার কর। (সূরা নিসা : আয়াত ১৯) প্রিয় নবী (স) বলেছেন : স্ত্রী হচ্ছে স্বামীর পরিবারের সদস্যদের এবং সন্তান-সন্ততির তত্ত্বাবধায়ক। (বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ) পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে। মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলিফা। আদম-হাওয়া এই প্রথম দম্পতিই পৃথিবীতে মানব বংশধারা বিস্তারের সূত্রপাত ঘটান। তাই স্বামী-স্ত্রী অবদান বিশ্ব মানব সভ্যতা স্থাপনে সমভাবে রয়েছে। ইসলামের পূর্বে স্ত্রীদের অবদান স্বীকৃত ছিল না। ইসলাম এসে সেই অবদানেরই কেবল স্বীকৃতি দেয়নি সেই সঙ্গে সমমর্যাদার মসনদে অধিষ্ঠিত করছে। ‘ইসলামে চারটে পর্যন্ত যাদের বিয়ে করা বৈধ তাদের মধ্য থেকে বিয়ে করার বিধান দিলেও একটা বিয়ে করাই উত্তম বলেছে। ইরশাদ হয়েছে : ফাইন্ খিফ্তুম আল্্লা তা’দিলু ফাওয়াহিদিতা- আর যদি আশঙ্কা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না তা হলে একটা (সূরা নিসা : আয়াত ৩)। এর মাধ্যমে এটাই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বহু বিবাহের সেই ঘন কালো অন্ধকার যুগে বহু বিবাহের শেকড়ে কুঠারাঘাত করে তা উৎপাটিত করেছে ইসলাম এবং স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যাতে অটুট থাকে সে ব্যাপারেও ইসলাম নির্দেশনা দিয়েছে। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (স) বলেছেন- একটা জিনিস যা বিধিসম্মত হলেও আল্লাহ পছন্দ করেন না তা হচ্ছে তালাক। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেছেন- কোন স্ত্রী যদি তার স্বামীর দুর্ব্যবহার কিংবা উপেক্ষার আশঙ্কা করে তাহলে তারা আপোস-নিষ্পত্তি করতে চাইলে তাতে কোন দোষ নেই এবং আপোস-নিষ্পত্তিই শ্রেয়। (সূরা নিসা : আয়াত ১২৮) স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মধুর সম্পর্ক বজায় রেখে সংসার নির্বাহ করলে সেই সংসার সুখের সংসারে পরিণত হয়। লেখক : পীর সাহেব, দারিয়াপুর শরীফ
×