ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মানব পাচারের সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ২০:৩৩, ৫ জুন ২০২০

মানব পাচারের সিন্ডিকেট

বিদেশে শ্রম বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত অনুন্নত দেশের শ্রমিকদের একটি কাক্সিক্ষত স্বপ্নের জগত। সাধারণ মানুষ ভিন দেশে পাড়ি জমিয়ে তাদের আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থাই শুধু নয়, পারিবারিক সচ্ছলতাকেও আমলে নিয়ে নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। তবে প্রবাসে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ পাওয়া রীতিমতো লড়াইয়ের মতো। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের বিধি মোতাবেক বৈধ এবং সুষ্ঠুভাবে অন্য দেশে চলে যাওয়া সত্যিই এক জীবনযুদ্ধ। ফলে আইনী বিধানকে তোয়াক্কা না করে অনেকেই খপ্পরে পড়ে মানব পাচারকারী চক্রের। এই চক্র শুধু নিজ দেশে নয়, পৃথিবীজুড়ে রয়েছে তাদের গতিবিধি। যদিও তা বিধিসম্মত নয়। ফলে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক ব্যক্তিবর্গ এই অবৈধ পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে প্রায়ই। একইভাবে মানব পাচার সিন্ডিকেট সক্রিয় ও জোরদার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে সুযোগ পেয়ে যায়। এমন অনাচার আর অন্যায়ের শিকার হয়ে বহু প্রবাসী নাগরিক শুধু যে সর্বস্ব খুইয়ে ফেলে তা নয়, তার চেয়েও বেশি মূল্যবান জীবনটাকেও বলি দিতে হয়। পৃথিবীজুড়ে এসব সক্রিয় চক্র প্রবল দাপটে নিজেদের অবৈধ, অনৈতিক কার্যক্রমে অর্থ আত্মসাত করে পকেট ভারি করতেও দ্বিধা করে না। বিপাকে পড়ে হতদরিদ্র, অসহায়, নিঃসম্বল মানুষদের সবচেয়ে দামী জীবনটাও। নিয়মবহির্ভূত এমন সব দুর্ঘটনা কতক চাপা পড়ে যায় আবার কিছুটা সামনেও চলে আসে। বীভৎস, পাশবিক আর নারকীয় হত্যাযজ্ঞে দুর্দমনীয় পেশীশক্তির খোলস বেরিয়ে পড়ে কোন এক সময়। তেমনই একটি নৃশংস খুনের চিত্র উঠে আসে লিবিয়ায় এক মর্মস্পর্শী সাড়া জাগানো ঘটনায়। লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে বাংলাদেশের কিছু মানুষ এই পাচারকারীদের দৌরাত্ম্যে এক মহাসঙ্কটের মুখোমুখি হয়। নতুন ভাগ্য গড়ার আকাক্সক্ষা নিয়ে তারা লিবিয়ায় যায় ইতালিতে কাজের প্রত্যাশায়। দুর্গম মরুভূমির যে পথ দিয়ে পাচারকারীরা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে সেখানে সংশ্লিষ্ট সরকারেরও তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ফলে উন্মত্ত, বেপরোয়া হতেও এসব পাচারকারীর সময় লাগে না। যাওয়ার পথেও চলে হরেক রকম অত্যাচার-নির্যাতন আর মুক্তিপণ আদায়ের অপচেষ্টা। ফলে হতভাগ্য বাঙালীরা পাচারকারী চক্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে রাগে, উত্তেজনায় খুনও করে। ফলে সিন্ডিকেট চক্র আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে নিরীহ মানুষগুলোর ওপর গুলি চালায় নির্বিচারে। এতে ৩০ জন মারা যায়, যাদের মধ্যে ২৬ জন বাংলাদেশী। দেশে এসব হতভাগ্য নিহত ব্যক্তির পরিবারে চলছে শোকের মাতম। বাংলাদেশ সরকারও এর বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিকার দাবি করে আইনী সমাধানের জোর আবেদন জানায়। দোষীদের শাস্তিই শুধু নয়, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ আদায়েরও প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। এই ঘটনায় দাবি ওঠে কঠোর আইনকে জোরালোভাবে বাস্তবায়নের পক্ষে। ৪৭০ জনের মানব পাচার সিন্ডিকেটের অন্যতম একজন কামাল হোসেন। আর এই হাজী কামাল মানব পাচারকারীদের মূল হোতা হিসেবেও চিহ্নিত। তাকে ঢাকা থেকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর থেকেই চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য ফাঁস হতে সময় লাগেনি। অনেক ট্রাভেল এজেন্সিও এই সিন্ডিকেট চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু ঢাকা বিভাগের নয়টি জেলায় বহালতবিয়তে কাজ করছে তালিকাভুক্ত ১৪ পাচারকারী। এছাড়াও অনেক পাচারকারীর বিরুদ্ধে অনেক মামলা রুজু হয়ে আছে থানায়। হাজী কামালকে আটকের পর তাকে রিমা-ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য না নেয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। তবে তাকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আদম ব্যবসার হোতারা নির্বিঘ্নে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে কিছু ট্রাভেল এজেন্সির সহায়তায়। সরকারের একটি দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থা এসব রহস্যজনক তথ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। চমকপ্রদ এই তথ্যে অনেক অজানা ঘটনাও এবার হয়ত সামনে চলে আসতে পারে। তবে ঘৃণ্য মানব পাচারকারীদের কঠোর শাস্তির বিধানসহ তা প্রয়োগ করা না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না আগামীতেও।
×