ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহারে প্রধানমন্ত্রীর তিন দফা প্রস্তাব

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ৪ জুন ২০২০

সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহারে প্রধানমন্ত্রীর তিন দফা প্রস্তাব

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্র ও অন্যান্য জলজ সম্পদের টেকসই ব্যবহারে বৈশ্বিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য তিন দফা প্রস্তাব পেশ করে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সমুদ্র কর্মকা-ে তাদের প্রতিশ্রুতি নবায়ণের আহ্বান জানিয়েছেন। খবর বাসসর। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মহাসাগরের এবং অন্যান্য জলজ সম্পদের টেকসই ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য, বিশেষ করে আমাদের সম্পদ ও পণ্যের বাজারে প্রবেশ এবং প্রযুক্তি সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার রাতে ভিডিও কনফারেন্সে সুইজারল্যান্ডের জেনেভোয় ‘ভার্চুয়াল মহাসাগর সংলাপ’-এ বক্তৃতা করেন। ‘ওশান এ্যাকশন ভবিষ্যতের প্রজন্মকে সবল করে গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আসুন আমরা হাতে হাত রেখে সমুদ্র এ্যাকশনের জন্য আমাদের প্রতিশ্রুতির নবায়ন করি,’ সংলাপের আজকের ‘শতকোটির পুষ্টি’ শীর্ষক অধিবেশনে তিনি একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তার প্রথম প্রস্তাবে, সামুদ্রিক সম্পদের পরিপূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় সম্পদ, সক্ষমতা ও প্রযুক্তিসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তা করার আহ্বান জানান। দ্বিতীয় প্রস্তাবে তিনি আঞ্চলিক মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি এবং অবৈধ, অননুমোদিত ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ নির্মূল বন্ধের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মৎস্য উন্নয়ন বিষয়ে যৌথ গবেষণা পরিচালনার ওপর জোর দেন। তৃতীয় প্রস্তাবে শেখ হাসিনা উপকূলীয় বাসস্থান ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মাছের উৎস চিহ্নিতকরণ এবং এর ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ এবং ফ্রেন্ডস অব ওশান এ্যাকশন’র ব্যবস্থানায় জেনেভোয় পাঁচ দিনব্যাপী এই সংলাপ গত ১ জুন শুরু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ও করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে ঘূর্ণিঝড় আমফানের চোখ রাঙানির মধ্যে সামাজিক দূরত্ব মেনেই উপকূলের প্রায় ২৪ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে এনে অতি প্রবল এই ঝড় থেকে জনগণকে সুরক্ষার সফলতা নিয়ে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ‘ঘূর্ণিঝড় ও করোনাভাইরাস মোকাবেলা : মহামারীর সময়ে কিভাবে লাখ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিলাম’ শিরোনামের এক নিবন্ধে একসঙ্গে দুই দুর্যোগ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন তিনি। খবর বিডিনিউজের। গ্লোবাল সেন্টার অন এ্যাডাপশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্যাট্রিক ভেরকুইজেনের সঙ্গে যৌথভাবে এই নিবন্ধ লিখেছেন ক্লাইমেট ভালনারএ্যাবল ফোরামের চেয়ারপার্সন শেখ হাসিনা। নিবন্ধে বলা হয়েছে, মে মাসে ভারত মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড় আমফান যখন তৈরি হচ্ছিল তখন কালক্ষেপণের সুযোগ ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের আশ্রয় কেন্দ্রগুলো সামাজিক দূরত্বের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়নি। তখন দেশের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, কিভাবে ২৪ লাখ মানুষকে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের ছোবল থেকে রক্ষা করা যায় তাদেরকে আরও বড় বিপদ কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে। সবচেয়ে ভাল সময়েও জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া চ্যালেঞ্জের। ঘরবাড়ি অরক্ষিত রেখে মানুষ যেতে চায় না। এবার সেই চ্যালেঞ্জ ছিল আরও অনেক বেশি। ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে ভয় পাচ্ছিল। উদ্ধারকর্মীদের নিশ্চিত করতে হয়েছিল যে, এই উদ্ধার তৎপরতায় ভাইরাস সংক্রমণ ঘটবে না। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে বাংলাদেশ বিদ্যমান চার হাজার ১৭১টি আশ্রয় কেন্দ্রের সঙ্গে আরও ১০ হাজার ৫০০টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত করে, যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সবাইকে আশ্রয় দেয়া যায়। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর ৭০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক উপকূলীয় এলাকাজুড়ে উদ্ধার তৎপরতা চালায়। মাস্ক, পানি, সাবান ও স্যানিটাইজার বিতরণ করা হয়। একের পর এক রফতানির আদেশ বাতিল হওয়ায় ধুঁকতে থাকা তৈরি পোশাক শিল্প ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) তৈরির মধ্য দিয়ে আবার উৎপাদনে যায়। মহামারীর চূড়ান্ত ধাপে আমফানের মতো একটি ঘূর্ণিঝড় জলবায়ু ও মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ককে সামনে নিয়ে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওসানিক এ্যান্ড এ্যাটমোসফেরিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশন আটলান্টিক ও ক্যারিবিয়ানের পানির অস্বাভাবিক তাপমাত্রার কারণে এ বছর হারিকেনের মৌসুম রেকর্ড বইয়ে স্থান করে নিতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চল ও ক্যারিবীয় অঞ্চলেও কোভিড-১৯ এর কারণে লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়া কঠিন হয়ে উঠবে। উদ্ধার তৎপরতায় প্রারম্ভিক সাড়া প্রদানের ৫৫ হাজার কর্মী নিয়ে বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রস্তুতির কারণে ঘূর্ণিঝড় আমফানে ভারত ও বাংলাদেশে ১০০-এর কম মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। একজনের মৃত্যুও অনুতাপের, কিন্তু দেশটির পূর্ব-সতর্কতা ব্যবস্থা এবং যথাযথ উদ্ধার তৎপরতার অনুশীলন বছরের পর বছর ধরে লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। অবকাঠামো পুনর্গঠন ও নতুনভাবে জীবিকার ব্যবস্থা করা অবশ্য ভিন্ন বিষয়। এর আগে বহু বার বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্রান্তীয় ঝড় প্রবণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশের দুই তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড সমুদ্রপৃষ্ঠের ৫ মিটারেরও কম উচ্চতায়- এখানে পুনর্গঠন বিরাট কঠিন কাজ। জলবায়ু সঙ্কট তা আরও কঠিন করে তুলেছে। ঘূর্ণিঝড় ক্রমশ আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে, তা হয়ে উঠছে আরও ঘন ঘন। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে কৃষি জমি ও মিঠা পানির জলাশয় লবণাক্ত হয়ে উঠছে। মহামারী এবং এর কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কটে সরকারকে একসঙ্গে স্বাস্থ্য, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক জরুরী পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। উত্তর ভারত মহাসাগরের ঝড়গুলোর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আমফানের কারণে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, আনুমানিক ১৩০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়েছে এর ধ্বংসযজ্ঞে। বাংলাদেশে এই ঝড়ে ৪১৫ কিলোমিটার সড়ক, ২০০ সেতু, হাজার হাজার ঘর-বাড়ি, বিস্তীর্ণ কৃষি জমি ও মৎস্য খামার ভেসে গেছে। ঝড়ের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস থেকে লোকালয় রক্ষায় তৈরি বেড়িবাঁধের ১৫০ কিলোমিটারের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা ছিল প্রলয়ঙ্করী, কিন্তু পরিকল্পনার কারণে দুর্যোগ মোকাবেলায় দেশগুলো ভাল প্রস্তুতি নিতে পেরেছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তাৎক্ষণিক প্রভাব মোকাবেলায় এটা যথেষ্ট নয়, ভবিষ্যত ঝড় মোকাবেলায় কমিউনিটিগুলোকে আরও প্রস্তুত হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ২০১৪ সালে ক্লাইমেট ফিসকল ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়নের কথা তুলে ধরা হয়েছে নিবন্ধে। তার আলোকে ২০১৮ সালে ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়নের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় উপকূলের তিন কোটি মানুষের জান-মাল রক্ষায় জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষায় আরও উঁচু বাঁধ নির্মাণের মতো অবকাঠামো তৈরির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। নিবন্ধে আমফানের পর উপকূলের স্কুল, হাসপাতাল ও ঘর-বাড়ি আরও মজবুত ও দুর্যোগ সহনশীল করে তৈরির কথা বলা হয়েছে, যাতে সেগুলো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবেলা করতে পারে এবং ভবিষ্যতের দুর্যোগের সময় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। নিবন্ধে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ সরকারের আর্থিক সক্ষমতায় বড় চাপ তৈরি করেছে। তবে আমরা বিশ্বাস করি, দীর্ঘমেয়াদী বাজেট ফ্রেমওয়ার্ক ও জলবায়ু সহনশীল পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবেলায় ভালভাবে সাড়া দেয়া সম্ভব। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও জলবায়ু সহনশীলতা পরস্পর সম্পর্কিত। সে কারণে ডেল্টা প্ল্যানে ভূমি ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প এবং লোকজনের সুস্বাস্থ্য ও তাদের দুর্যোগ সয়ে নেয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ সোলার হোম কিটসের কথা বলা যায়, যা প্রতিটি ধ্বংসাত্মক ঝড়ের পর রোগ ছড়ানো বন্ধে পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এ বছর বাংলাদেশই শুধু স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও জলবায়ুজনিত সঙ্কট মোকাবেলা করছে না। তাই এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ : বিশ্বজুড়ে সফলতার ঘটনাগুলো থেকে আমরা শিখতে পারি এবং একে অপরকে সহযোগিতা করতে পারি। একসঙ্গে আমরা আরও শক্তিশালী ও দুর্যোগ মোকাবেলায় আরও সক্ষম হয়ে উঠতে পারি।
×