ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

সততার জন্য ইঞ্জিনিয়ার খুন হলে মাফিয়ারাই তো জিতে!

প্রকাশিত: ২০:৫৬, ৪ জুন ২০২০

সততার জন্য ইঞ্জিনিয়ার খুন হলে মাফিয়ারাই তো জিতে!

ইঞ্জিনিয়াররা সৎ হয় না- এমন একটা ভাবমূর্তি দীর্ঘকাল যাবত আত্মীয় পরিম-লে, প্রতিবেশীদের মধ্যে, বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সেই সঙ্গে আমরা এও জানি, প্রকৃতপক্ষে সব পেশাতেই সৎ অসৎ আছে। কিন্তু অধিকাংশ প্রকৌশলী সমাজ দ্রুত বিত্তবান হয়ে ওঠে বলে এ পেশার মানুষের মধ্যে সৎ মানুষের অভাব প্রকট বলে মানুষ মনে করে। একজন দেলোয়ার হোসেন সৎ ছিলেন বলে অসৎ দেশপ্রেমহীন অর্থলোভী ঠিকাদার নামের খুনীদের পরিকল্পনার লক্ষ্য হয়ে এই ভয়ঙ্কর ভাইরাসের তা-বের মধ্যেও নির্মম খুনের শিকার হন! এর সহজ অর্থ হচ্ছে- আমাদের সমাজ-প্রশাসনিক কাঠামো সততাকে উৎসাহ বা সুরক্ষা দিতে অক্ষম! মনে হয়, সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো সততাকে উৎসাহ বা সুরক্ষা দিতে অক্ষম! মনে হয়, সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো এমন একটি চেনের মধ্যে আবদ্ধ, যেটি যখন প্রত্যেক ধাপে অসৎ-দুর্বৃত্ত অর্থলোভীদের ইচ্ছায় চলতে থাকে। যখন এই চলমান চেইনের মাঝখানে থাকা একজন সৎ কর্মকর্তা দুর্বৃত্তায়নের মাঝখানে সততার দেয়াল তুলে জনগণ ও সরকারের স্বার্থ রক্ষার্থে জনগণের সেবক হয়ে দাঁড়ান, তখন ঐক্যবদ্ধ অর্থলোভী মাফিয়া ঠিকাদার, কর্মকর্তা সরকারের কোন শক্তিধর ব্যক্তি তাকে নৃশংস হত্যার মাধ্যমে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়। ফলে বিশাল একটি মানসিক আঘাতে আমরা ব্যর্থ হই, শোকার্ত এবং ক্রুদ্ধ হই। অবশ্যই গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সব কর্মকর্তা, সর্বোচ্চ মহল থেকে সর্বনিম্ন পর্যন্ত, সবাই তাদের অফিসের সবচাইতে সৎ কর্মকর্তাটিকে অবশ্যই চিনতেন, তাকে সৎ মানুষ হিসেবে সম্মান করতেন, দুর্বত্তরা ছাড়া। খুন করে শেষ পর্যন্ত খুনী অপরাধী ধরা পড়ে- এটা আমরা অজস্র খুনের মামলায় দেখি। তবে এর ব্যত্যয়ও রয়েছে বৈকি- সেই সাগর-রুনী হত্যা, ত্বকী হত্যাসহ বেশ কিছু সাড়া জাগানো হত্যা মামলা তো এখনও শুরুই হয়নি। এই হত্যাকা-গুলোর নেপথ্যে যেসব বড় মাফিয়ার নাম শোনা গিয়েছিল, তাদের এমনকি খুনিরও বিচার না হওয়ার ফলে এই সৎ কর্মকর্তা দেলোয়ারসহ অন্য সৎ ও নিরীহ-সজ্জন মানুষদের হত্যাকা-কে উৎসাহিত করেছে, এতে সন্দেহ নেই। দেলোয়ার হত্যার পরিকল্পকেরা সরকারী শক্তিধর কোন কেন্দ্র থেকে প্রশ্রয় লাভ না করলে সম্ভবত দেলোয়ার হত্যার কথা না ভেবে তাকে বদলি করার কথাই ভাবত, যা হতো সহজ একটি কাজ। কিন্তু আমরা যখন নারায়ণগঞ্জের সাত খুন হত্যাকা-টি দেখি, তখন বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম যে, র‌্যাবের উর্ধতন কর্মকর্তাসহ অনেক সদস্য প্রকাশ্য দিবালোকে তাদের নাম পরিচয় বের হয়ে আসার ভয়কে কোন পাত্তাই না দিয়ে সরকারের উর্ধতন ব্যক্তির স্বজন হওয়ায় অতবড় অপরাধ করতে দ্বিধা করেনি! এরা সরকারের সদিচ্ছা এবং জনগণের চাপ থাকার কারণে গ্রেফতার হয়েছে, দ-িত হয়েছে, যদিও আপীল মীমাংসা এখনও হয়নি। একজন সৎ মানুষ, প্রকৌশলীকে সুরক্ষা দিতে ঐ সিটি কর্পোরেশনে তার উর্ধতন বস, অন্যেরা এগিয়ে আসল না কেন?-এ প্রশ্ন জনমনে না উঠে পারে না। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী তো দেখেছেন, আজকে যে রাস্তা মেরামত করা হলো, দেখা গেল সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই সেটির কোন এক দিকে রাস্তাটি ভেঙে গেল। এ দৃশ্য আমরা রাজপথের যাত্রীরা অহরহ দেখছি এবং চরম বিরক্ত বোধ করি। বহুবার লিখেছি- কাছেই ভারতের রাজ্যগুলোর রাস্তা, এমনকি সবচাইতে কাছের কলকাতার রাজপথ দেখে, তাদের মেয়রের কাছ থেকে কলকাতার রাস্তা তৈরির উপকরণ, কৌশল জেনে ঢাকার রাস্তা, যা পৃথিবীর অন্যতম ব্যয়বহুল বলে গণ্য, সেখানে অনুসরণ করা হচ্ছে না কেন? আমার চলাফেরার পথÑ হাতিরপুল বাজার এলাকা, কাঁটাবন রাস্তা, এনমকি পিজি ও আজিজ মার্কেট এলাকার রাস্তা মেরামতের সপ্তাহখানেকের মধ্যে যে অবস্থায় দেখছিÑ তাতে ঠিকাদারদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। অন্তত ন্যূনতম দু’বছরের গ্যারান্টি নেয়া হচ্ছে না কেনÑ বুঝতে পারি না। এক কথায় বলা চলেÑ বাংলাদেশে ঢাকার রাজপথের মতো এত নিম্নমানের কাজ অন্য কোন জেলায়ও সম্ভবত হয়নি। গাজীপুরের রাস্তাও নিশ্চিতভাবেই অতি নিম্নমানের। এ ঠিকাদারদের এত নিম্ন কাজের পর তাদের ডেমারেজ ধার্য করা উচিত নয় কি? মেয়রের দায়িত্ব কি এক্ষেত্রে কিছুই নেই? বরং রাজশাহীর রাস্তা অনেকটা ভাল মানের দেখেছি। এবার জনগণ চাল-চোর হিসেবে সরকারী স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের আধিক্য দেখে এদের সমালোচনা করাতে সড়কমন্ত্রীর আপত্তির কারণ বুঝলাম না। বিরোধী দলের হাতে নিজ দলের পরিচয় দানকারী চোরের দল যে একটি সমালোচনার অস্ত্র তুলে দিল- সেটি তো সরকারী দলের স্থানীয় পর্যায়ে সঠিক নেতা চিনতে না পারাকেই প্রমাণ করে। আমি যদি সমালোচনার যোগ্য কর্ম করি তা হলে সেই সমালোচনা মেনে নেব এবং নিজেকে সংশোধন করব- এটিই কি গণতন্ত্রের মৌলিক রীতি নয়? প্রধানমন্ত্রীকে আগে বলেছি, গণতন্ত্রে সরকার প্রধানসহ সরকারের সব নেতা মন্ত্রী সমালোচনার যোগ্য। স্বৈরতন্ত্রে সমালোচনা চলে না, যা স্বৈরশাসকেরা সহ্য করতে পারে না। সে জন্যই গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্দ্রে এত পার্থক্য। এখন দেখছি- সরকারপ্রধানকে সমালোচনা করা যাবে না বলে আমলা প্রভাবিত, অবশ্যই সরকারবিরোধী একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে, যেটি প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে অগণতান্ত্রিক গণ্য করার উদ্দেশ্যে জারি করা হয়েছে বলে জনগণ মনে করে। খুব দ্রুত এ প্রজ্ঞাপন দ্বারা সরকারপ্রধানের সমালোচনাকারীর সংখ্যা ও গ্রেফতার বাড়বে এবং তারা নকল-সমালোচক কিনা তা বোঝার আগে দ্রুতই প্রধানমন্ত্রীর গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ম্লান হবে- এটি ঐ দলের লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রীকে বলব- সব সরকারী বিজ্ঞাপনে ‘সরকার প্রধানের নির্দেশ’- এমন উল্লেখ থাকাটা বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে স্বৈরশাসক, একনায়ক বানাবার একটি গোপন অভিসন্ধি প্রকাশ পাচ্ছে, যেটি দ্রুত বন্ধ করবার নির্দেশ দিতে হবে। ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার হত্যায় ফিরে আসি। এমন যদি হতো-দেলোয়ারকে যখন ফোনে জানানো হলো আরএফএলের গাড়ি আসবে না, অন্য গাড়ি এসেছে এবং আজ সকালে অফিসে পৌঁছাতে বলেছে- এ তথ্যটি দেলোয়ার যেহেতু বাজে কাজ করে কোটি টাকার ঘুষের প্রস্তাব, ভয়ভীতি পেয়েছিলেন, যদি একবার তার বসকে ফোন করে যাচাই করে নিতেন, আরএফএলের যে চালক বা প্রেরককে গাড়ি কেন আসতে পারবে না, বসকে অফিসে সকালে পৌঁছাতে কেন হবে- ফোন করে জানতে চাইতেন, তাহলে কি এদের কোন একজন ঐ তথ্য সঠিক নয় বলে তাকে জানাতেন? তাহলে কি দেলোয়ার খুনীদের হাত থেকে রক্ষা পেতেন? এখন আর তা জানার উপায় নেই। একজন সৎ কর্মকর্তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না যে প্রশাসনিক কাঠামো ও উপরওয়ালা কর্মকর্তারা-সেই প্রশাসন চাল-চুরি কেন, হত্যাসহ সব রকম দুর্বৃত্তায়নকেও বাধা দিতে পারে না! এসব আর কত দেখবে জনগণ? এমনই উদাহরণ- গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত করোনা পরীক্ষার কিটটি নিয়ে যা চলছে, সে সবকে কি বলে ব্যাখ্যা করা যায়? জাতির কল্যাণের স্বার্থে করা কাজটিও জাতির সেবায় আসতে পারছে না। ঘটছে অদ্ভুত সব ঘটনা! ওষুধ প্রশাসনে সমস্যা আছে, বোঝাই যাচ্ছে। ওষুধ নিয়েও ঘটল আরেক ঘটনা। ‘রেমডেসিভির’ করোনা নির্মূল করে না শ্বাসকষ্ট বা ব্লাড ক্লট কমায় না। তারপরও কেন এ ওষুধ অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে তৈরি হয়ে একেবারে সরকারের ঔষধ প্রশাসনে জমা পড়ল? জানি, ওষুধ শুধু শিল্প নয়, এর সঙ্গে জড়িত বিপুল বাণিজ্য অর্থাৎ অর্থ। যাক, এসব আমাদের, জনগণের নিয়ন্ত্রণে নেই। আমাদের সম্বল- একটা মাত্র ভোট এবং সততা। সততা ও দুর্বৃত্তায়নের পেশীযুদ্ধে সততা মার খাচ্ছে, সাগর, রুনী, ত্বকীসহ আরও শত শত। কারা বাঁচাবে এদের? প্রধানমন্ত্রী? না, প্রধানমন্ত্রীকে যারা ‘একনায়ক’ করে তুলতে চাইছে, তারা যে দেশ ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষতি করছে, সেটি আমি বুঝি। তাই বলব- আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিলে দ্রুত ও কঠোর আইনী ব্যবস্থা নিন। নতুবা অনেক সৎ তরুণের জীবন সঙ্কটে পড়ে প্রশাসন সৎ হীন হয়ে উঠবে! সবশেষে সব রকমের সরকারী কর্মকর্তাদের একটি অনুরোধ জানাব- আমি যখন স্বেচ্ছায় অবসর নিলাম বায়ান্ন বছরে, তখন সরকারী অধ্যাপকের বেতন ছিল সম্ভবত সাড়ে চার হাজার টাকা। ’৯৭-এ অবসর নেয়ার সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ বেতন সাড়ে সাত হাজারে উন্নীত করেন। এ্যাকাউন্ট অফিস সে অনুযায়ী আমার পেনশন নির্ধারণ করে। বর্তমানে হঠাৎ এক বিরল সৌভাগ্য হলো। প্রধানমন্ত্রী আমার মতো যারা অসময়ে অবসরে গিয়ে অর্থ কষ্টে পড়েছে, তাদের পনেরো বছর অন্তে আবার পেনশন দিচ্ছেন! আমার প্রস্তাব হলো, প্রধানমন্ত্রী সরকারী চাকুরেদের প্রায় ত্রিশ হাজার থেকে লাখের কাছাকাছি বেতন দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে যারা সত্তর-আশি হাজারের মতো বেতন পাচ্ছেন, তারা জাতির এ মহা দুর্যোগে সরকারকে একটি আর্থিক সহায়তা দিয়ে নিজেরা মহৎ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন। ৬০% বেতন গ্রহণ করে ৪০% বেতন সরকারী কোষাগারে সারেন্ডার করে। এতে শিক্ষক- আমলা-চিকিৎসক- প্রকৌশলী-আইনজীবী, সব রকম নিরাপত্তা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারাসহ সকলে মিলে একটি সাময়িক বেতন নীতি পেশ করতে পারেন। এতে তাঁরা কেউ না খেয়ে থাকবেন না। বরং জাতির যে বিপুল সংখ্যক মানুষ অনানুষ্ঠানিক পন্থায় আয় করে জীবিকা নির্বাহ করছিল, বর্তমানে যারা আয়-কর্মহীন, তাদের বিশাল উপকার করতে সরকারের পক্ষে কিছুটা হলেও সহায়ক কা- তৈরি হবে। সরকারী কর্মকর্তাদের এ প্রস্তাবে এগিয়ে আসতে অনুরোধ জানাই। কেননা, এ মহামারী দ্রুত শেষ হবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে আয়-কর্মহীন কয়েক কোটি মানুষকে আরও বেশ কিছুদিন খাদ্য সহায়তা দিয়ে যেতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×