ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়

সোনালি প্রজন্মের নিপাট ভদ্রলোকের বিদায়...

প্রকাশিত: ০১:০৫, ৩ জুন ২০২০

সোনালি প্রজন্মের নিপাট ভদ্রলোকের বিদায়...

জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে সবাই ভাল কিছু চাই। সবার প্রত্যাশা ভাল কিছু ঘটুক তার জীবনে। সবাই চাই সুখী হতে, মন ভাল রাখতে, সাফল্য পেতে। সবাই দেশের ভাল চাই; চাই দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাক। এই ‘ভাল’ শব্দটা প্রত্যেকের জীবনের সঙ্গে, বেঁচে থাকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। তবে বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাদামনের ভাল মানুষের অভাবটা যেন প্রকট হয়ে উঠছে! দেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে সদ্যই এমন একজন গুণী মানুষ চিরবিদায় নিয়েছেন। মৃত্যুর অমোঘ নিয়মের কাছে হার মেনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার, প্রখ্যাত ক্রীড়া সংগঠক গোলাম রাব্বানী হেলাল। ‘আবাহনীর হেলাল’ খ্যাত এই মানুষটি ছিলেন সবার প্রিয়। নিজের ব্যক্তিসত্তা দিয়ে জয় করেছিলেন সবার মন। যে কারণে নিপাট এই ভদ্রলোকের বিদায়ে কাঁদছে পুরো ক্রীড়াঙ্গন। অসুস্থ হেলালের ওপেন হার্ট সার্জারির পর কিডনি ডায়ালাইসিসও করতে হচ্ছিল। এসবের পাশাপাশি ব্রেন স্ট্রোক হলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলেন যান। শেষ পর্যন্ত জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে আর পেরে উঠেননি সাবেক তারকা এই ফুটবলার। গত ৩০ মে ৬৩ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান গোলাম রাব্বানী হেলাল। অসুস্থ অবস্থায় তিনি ভর্তি ছিলেন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে। ব্রেন স্ট্রোকের পর বাংলাদেশের সোনালি প্রজন্মের এই সদুর্শন সুপারস্টারকে রাখা হয়েছিল লাইফ সাপোর্টে। কিন্তু অবস্থার উন্নতি আর হয়নি। ডায়ালাইসিস করার জন্য নিয়মিত হাসপাতালে যেতে হতো হেলালকে। গত ২৮ মে হঠাৎ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। দ্রুতই রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায় স্ট্রোক হয়েছে। গোলাম রাব্বানী হেলাল বেশ কিছু দিন ধরেই ছিলেন অসুস্থ। ২০১৭ সালে তার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছিল। ব্যাংককে উন্নত চিকিৎসাও নিয়েছেন তিনি। এছাড়া কিডনির জটিলতার কারণে ডায়ালাইসিসও চলছিল তার। বরিশাল থেকে উঠে এসে ঢাকা আবাহনীর হয়ে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল মাতিয়েছেন সুদর্শন এই ফুটবলার। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত খেলেছেন আবাহনীতে। মাঝে অবশ্য কিছুদিন বিজেএমসির হয়েও মাঠ মাতান। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত খেলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। খেলা ছেড়ে আবাহনী লিমিটেডের পরিচালকও হয়েছেন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সদস্যও ছিলেন। বাংলাদেশের ফুটবলের একটি নেতিবাচক অধ্যায় হয়ত অনন্তকালই জেগে থাকবে হেলালের নামের সঙ্গে। ১৯৮২ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে (তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়াম) ফুটবল খেলতে গিয়ে জেলে যাওয়া আবাহনীর চার ফুটবলারের একজন তিনি। তার সঙ্গে জেলে গিয়েছিলেন বর্তমান বাফুফে সভাপতি কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, আশরাফউদ্দিন চুন্নু ও কাজী আনোয়ার। হেলালের মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েছেন তার পরিবার, আপনজন, স্বজনরা। তার এক সময়ের সতীর্থ ফুটবলাররাও শোকাহত, মর্মাহত। আবাহনীর এক সময়কার শ্রীলঙ্কান ডিফেন্ডার পাকির আলী ছিলেন হেলালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি বলেন, ‘হেলাল একজন ভাল মানুষ ছিল। আবাহনী ক্লাবকে সে নিজের বাড়ির মতোই মনে করত। তিনি ছিলেন একজন স্টাইলিশ খেলোয়াড়। তার আরেকটি গুণ ছিল নতুন খেলোয়াড়দের দেখে রাখতেন। এছাড়া অনেককেই ঢাকার মাঠে খেলার সুযোগও করে দিয়েছেন। আমরা দুজনেই ভাল বন্ধু ছিলাম। শ্রীলঙ্কায় আমাদের বাসায়ও গিয়েছেন তিনি। আমি ঢাকায় যখন যেতাম তার সঙ্গে দেখা হতোই। এই তো বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের সময় ওর বাসায় গেলাম। হাসপাতালে ভর্তির আগে হোয়াটসএ্যাপে নিয়মিত যোগাযোগ হতো আমাদের। আমি ও আমার পরিবার তাকে অনেক মিস করব। কখনও তাকে ভুলতে পারব না। তিনি ছিলেন একজন মজার মানুষ। নানারকম জোকস শোনাতে পছন্দ করতেন। সবসময় হাসি-ঠাট্টার মধ্যে থাকতেন। সবসময় চাইতেন আবাহনী যেন জিততে পারে, আবাহনী যেন ভাল করে। এমন আবাহনী অন্তঃপ্রাণ মানুষ কমই দেখেছি।’ আবাহনীর আরেক সাবেক ফুটবলার আশরাফউদ্দিন চুন্নু বলেন, ‘আবাহনীতে আমাদের পথচলা প্রায় একইসঙ্গে। একসঙ্গে অনেকদিন আকাশি-নীল জার্সি পরে খেলেছি। একজন ভাল ফুটবলারের পাশাপাশি ভাল মনের মানুষও ছিলেন হেলাল। তিনি মূলত স্ট্রাইকার ছিলেন। তবে দলের প্রয়োজনে অনেক সময় খেলেছেন মিডফিল্ডেও। আমাদের এই সতীর্থের চলে যাওয়াটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। আবাহনীকে তিনি অনেক ভালবাসতেন। আবাহনীর বাইরে অন্য কিছু চিন্তা করতেন না। অনুশীলনে তিনি ছিলেন সেরা খেলোয়াড়। কিন্তু মাঠের খেলায় কেন যেন অনুশীলনের ৭০-৮০ ভাগের বেশি দিতে দিতে পারতেন না। অনুশীলনে যা করতেন, সেটা যদি মাঠের খেলায় দেখাতে পারতেন, তাহলে তিনি থাকতেন দেশের সেরা কয়েকজন ফুটবলারের একজন।’ ১৯৮২ সালে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে গোলযোগ হওয়ায় শুধু আবাহনীরই যে চার ফুটবলারকে জেল খাটতে হয়, তাদের একজন ছিলেন হেলাল। এ প্রসঙ্গে চুন্নু বলেন, ‘সেই সময় আমাদের চারজনকে ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমাকে ও সালাউদ্দিন ভাইকে যশোরের এবং হেলাল ও আনোয়ারকে রাজশাহীর জেলে নেয়া হয়। ট্রেনে যাওয়ার সময় যখন পাবনার ঈশ্বরদীতে আমরা আলাদা হব, তখন হেলালের সে কী কান্না। অঝোরে কাঁদছিলেন। আমরা সবাই তখন ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। আসলে তিনি ছিলেন উদার মনের একজন মানুষ।’ ক্লাব ফুটবলে হেলাল আবাহনীতে খেলেন ১৯৭৫-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। আবাহনীতে খেলেন ৭ নম্বর জার্সি পড়ে। মাঝে ১৯৮১ সালে বিজেএমসিতে দুই মাস ১৫ দিন কাটিয়ে আবারও প্রিয় ক্লাব আবাহনীতে ফিরে এসেছিলেন। জাতীয় দলের জার্সিতে খেলেছেন ১৯৭৯-১৯৮৫ সাল পর্যন্ত। তার প্লেয়িং পজিশন ছিল রক্ষণ, মাঝমাঠ। আক্রমণভাগেও খেলেছেন মাঝে মধ্যে। হেলালের থ্রু পাস ও ব্যাকভলির অনেক সুনাম ছিল। আবাহনীর কর্মকর্তা হিসেবেও তাকে দেখা গেছে লম্বা সময়। ১৯৭৮ সালে লীগে আবাহনী ‘আইলো ওয়ারী’ খ্যাত ওয়ারীরর কাছে দু’বার হেরেছিল পরের বছরই লিগে ওয়ারীকে আবাহনী হারিয়ে প্রতিশোধ নেয়। সেই ম্যাচেই হেলাল দারুণ এক হ্যাটট্রিক করেন, যা তার লিগ-ক্যারিয়ারের প্রথম। ১৯৭৮ সালে ঢাকায় এশীয় যুব ফুটবল দিয়ে জাতীয় স্তরে খেলা শুরু হেলালের। পরের বছরই ডাক পান সিনিয়র দলে। ১৯৮২ সালে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে গোলযোগের অপরাধে আবাহনীর যে চার ফুটবলারকে জেলে নেয়া হয়, গোলাম রাব্বানী হেলাল তাদেরই একজন। বাকি তিনজন কাজী মোঃ সালাউদ্দিন, আশরাফ উদ্দিন চুন্নু ও কাজী আনোয়ার। হেলাল বাফুফের নির্বাহী কমিটির সদস্য হন ২০০৮ সালে। হেলালকে নিয়ে এখন সবার মাঝে চলছে শোকগাথা, স্মৃতিচারণ। তবে তার একটা পরিচয়ের কথা অনেকটাই অন্তরালেই রয়ে যাচ্ছে। নিজের স্পোর্টিং সেলিব্রিটি ইমেজ কাজে লাগিয়ে হেলালই প্রথম বাংলাদেশে নিখুঁত ব্যবসায়িক বুদ্ধি দিয়ে আশির দশকে ঢাকার বুকে দাঁড় করিয়েছিলেন সবচেয়ে অভিজাত ও জনপ্রিয় চায়নিজ ফুডের রেস্তরাঁ ‘বেইজি’। এলিফ্যান্ট রোড বাটা সিগনালের মোড়ে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী এম কে আনোয়ারের বাড়ির বিপরীতে একটি ভবনের দোতালার পুরো ফ্লোরজুড়ে ছিল বেইজিং। দুরন্ত ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন, মাঝারি সাদের খাদ্য সম্ভার। কিন্তু সেই রেস্তরাঁয় খাবার জন্য লাইন পড়ে যেত। দুপুর ১২টা থেকে রাত ১০টা-একটা টেবিল খালি পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। কারণটা হলো-রেস্ট্ররেন্টের আরেক অংশীদার ছিলেন পিডাব্লিউডি, মোহামেডান, বিজেএমসি ও জাতীয় দলের তারকা গোলরক্ষক এবং ওই সময়ের জাসদ ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত ডাকসু ক্রীড়া সম্পাদক ওয়াহিদুজ্জামান পিন্টুসহ হয়ত আরও দুয়েকজন। ওই সময় চিরবইরি দুই ক্লাবের দুই তারকার যৌথ মালিকানায় রেস্তরাঁ মনোযোগ কেড়েছিল সবার। আরও একটা আকর্ষণ ছিল। সন্ধ্যার পর বেইজিং বসত হেলাল, পিন্টুদের সমবয়সী তারকা ফুটবলারদের তুমুল আড্ডা। সালাম মোর্শেদী, বাদল রায়, গাফফার, টুটুল,আশিস ভদ্র, খোরশেদ বাবুল পাকির আলি, বাবলু, ওয়াসিম, মোহসিনসহ সব তারকারা এক টেবিলে বসে আড্ডা দিতেন নিজেদের দলের খেলা না থাকলে। বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় ফুটবলের হার্টথ্রুব তারকাদের কাছ থেকে দেখতে, সযোগ পেলে ছবি তুলতে অটোগ্রাফ নিতে সারা ঢাকার কিশোর তরুণ-তরুণীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ত বেজিং এ। রেস্তরাঁর সঙ্গে জড়িত ছিলেন বিসিবির পরিচালক আউয়াল চৌধুরী ভুলু। ফুটবলার ছাড়া তারকা ক্রিকেটাররাও যেত সেই আড্ডায়। তবে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে তখন তারা ছিল হরিজন! ঢাকায় অন্য চায়নিজ রেস্তরাঁর কি দুর্দশা বোঝাই যায়! এমনও হয়েছে আবাহনী কোন ট্রফি জেতার পর খেলোয়াড় অফিসিয়ালদের ডিনার পার্টি হয়েছে বেজিংয়ে। ভক্তদের বিজয় মিছিলে এলিফ্যান্ট রোডে তুমুল ট্র্যাফিক জ্যাম। ঢাকা শহরের বাইরে থেকেও আসত অনেকে। অন্যান্য ক্লাবও সাফল্য উদযাপন করতে বেজিং এ খেলোয়াড়দের সম্মানে পার্টি দিত। পরে হেলালেল নাম হয়ে যায় ‘বেজিং হেলাল’। এর আরেকটা কারণও আছে। কেননা ক্রীড়াঙ্গনে আরেক হেলাল ছিলেন মোহামেডানের আনোয়ারুল হক হেলাল।
×