ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৬৭ কারারক্ষী আক্রান্ত

কারাগারের কর্মকর্তা কর্মচারীরা আতঙ্কে

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ৩ জুন ২০২০

কারাগারের কর্মকর্তা কর্মচারীরা আতঙ্কে

মশিউর রহমান খান ॥ করোনা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে দেশের ৬৮ কারাগারে কর্মরত কারা কর্মকর্তা কর্মচারী ও তাদের পরিবারবর্গ। কারাবন্দীর সুরক্ষা দিতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনকালীন ১ জুন পর্যন্ত মোট ৬৭ জন কারারক্ষী ও এক বন্দীর দেহে করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে। অতি দ্রুততার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর সংখ্যা। করোনা পজেটিভ রোগী ছাড়াও সারাদেশে করোনা রোগী সন্দেহে ও উপসর্গ থাকায় বন্দী, কারারক্ষী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ মোট ১৯০ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করা এসব নিরাপত্তাকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যরাও করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় এ আতঙ্ক আরও তীব্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এভাবে করোনা আক্রান্তের হার বাড়তে থাকলে বন্দীর নিñিদ্র নিরাপত্তা প্রদানে মারাত্মক সঙ্কট সৃষ্টি হবে। বন্দী নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কারারক্ষী ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের আবাসস্থল কারা সীমানায় হওয়ায় করোনা সংক্রমণের হার দ্রুত বেড়েই চলেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারারক্ষীদের আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দায়িত্ব পালনকালীন বাধ্যতামূলক পিপিই পোশাক পরছে না। বেশিরভাগ কারাগারে করোনা সম্পর্কে সচেতন করতে উন্নত কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। সকল কারারক্ষীকে পিপিই প্রদানের ব্যবস্থা না করা। তবে বেশ কিছু কারাগারে হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক ও পিপিই পোশাক পরিধান করার পরেও তারা রক্ষা পাচ্ছেন না করোনার হাত থেকে। প্রতিদিনই তা বেড়েই চলেছে। আশার কথা হচ্ছে আক্রান্ত কারারক্ষীরা নির্দিষ্ট সময় চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। মূলত কারাবন্দীর নিরাপত্তার মূল কাজটিই করেন কারারক্ষীরা। ফলে এভাবে চলতে থাকলে কারারক্ষীরা আক্রান্ত হতে থাকলে যে কোন সময় এ ভাইরাস কোনক্রমে কারাভ্যন্তরে প্রবেশ করে বন্দীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়লে করোনায় মৃত্যুর হার ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। যা কারা কর্তৃপক্ষ তথা সরকারের পক্ষে সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারা ফটকে বন্দীর সাক্ষাত কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ থাকার পরও আদালত থেকে আসামিদের আনা নেয়া করা ও বিভিন্ন কারণে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে চলাফেরার কারণে কারারক্ষীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। অপরদিকে কারা কর্তৃপক্ষের সর্বোচ্চ সতর্কতায় এখন পর্যন্ত কারাভ্যন্তরে পূর্ব থেকে আটক কোন কারাবন্দী আসামি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে কারাভ্যন্তরে যাতে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা নেয়া হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে কারা অধিদফতর। করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে অধিদফতরের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি বিভাগের উপ কারা মহাপরিদর্শককে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। উক্ত কমিটি প্রতিদিনই করোনার সকল আপডেট তথ্য অধিদফতরে প্রদান করে ও কারা কর্তৃপক্ষ সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়। কারাসূত্র জানায়, করোনায় সবচেয়ে বেশি কারারক্ষী আক্রান্ত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কারারক্ষীরা। তবে ঢাকা কারাগারের কারারক্ষীদের মধ্যে অনেকেই সুস্থ হয়েছেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বন্দীর চিকিৎসায় রাজধানীর ১৩ বিশেষায়িত হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা বন্দীর সুরক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কারারক্ষীরাই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনা প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে শুরুর পর প্রথমবারের মতো ২ জন কারারক্ষী ও একজন কারাবন্দী যিনি (কারাগারের বাইরের হাসপাতালেই চিকিৎসা গ্রহণ করছিলেন) করোনায় আক্রান্ত হন। পরবর্তীতে তাদের কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের তৈরি করা করোনা হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা প্রদান করে। বর্তমানে উক্ত আসামি ও কারারক্ষীরা সবাই সুস্থ রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও পরবর্তীতে আরও কয়েক দফা কারারক্ষীরা করোনায় আক্রান্ত হয়। ফলে এসব কারারক্ষীর আবাসস্থল পুরান ঢাকা কারাগারের ব্যারাকটি পর্যন্ত লকডাউন করে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারে একদিনে ১১ কারারক্ষী করোনায় আক্রান্ত হন। এর মধ্যে সঙ্গে সঙ্গেই ৭ জনকে করোনা চিকিৎসার জন্য সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কারা কর্তৃপক্ষ কয়েকধাপে সকল কারারক্ষী ও কারা কর্মকর্তা কর্মচারীর করোনা পরীক্ষার নির্দেশ দেয়। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ কারাগারে সর্বাধিক ৩৪ জন কারারক্ষীর করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে। আরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জনকণ্ঠকে জানান নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের সুপার সুভাষ ঘোষ। বর্তমানে যাদের করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে তারা চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এছাড়া আইসোলেশনে রয়েছেন কেউ কেউ। একই ব্যারাকে কারারক্ষীরা আক্রান্ত হওয়ায় অন্য কারারক্ষীরা কখন কে আক্রান্ত হন তা নিয়ে এক মহা আতঙ্কে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। কারা এলাকার আবাসিক কোয়ার্টারের বাইরেও ভাড়া বাসায় বসবাসকারী অনেক কারারক্ষী করোনা আতঙ্কে স্ত্রী সন্তানকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে সূত্র জানায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সকল কারারক্ষীকে বাধ্যতামূলকভাবে পিপিই পোশাক পরিধান, হ্যান্ড গ্লাভস ও মাস্ক পরে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম। পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকার ব্যারাকে থাকা রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দীর দায়িত্ব পালনে থাকা কারারক্ষীরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর কারাভ্যন্তরে বন্দীদের মাঝে করোনা সংক্রমণ রোধে এমন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে কোন বন্দী যাতে করোনা আক্রান্ত না হন সেজন্য সরকারের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। সর্বশেষ তথ্যমতে ১ জুন পর্যন্ত সারাদেশে মোট ৬৭ জন কারারক্ষী ও একজন বন্দী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩ জন কারারক্ষী, নারায়ণগঞ্জ ৩৪ জন, নরসিংদী ২ জন, গাজীপুর ১ জন, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫ জন, চাঁদপুর ১ জন, বগুড়া ১৫ জন, পঞ্চগড় ২ জন, সিলেট ৩ জন কারারক্ষী ও নেত্রকোনা কারাগারে ১ জন সিভিল ড্রাইভারের করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে। তবে এ পর্যন্ত খুলনা জেলা কারাগারে মাহমুদুল হাসান নামের ১ জন বন্দী যিনি বাইরে থেকেই করোনা আক্রান্ত ছিলেন পরে তাকে নারী নির্যাতন মামলায় খুলনা কারাগারে পাঠায় আদালত। পরে তার করোনা পরীক্ষায় রিপোর্ট পজেটিভ আসে। বর্তমানে তিনি খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন খুলনা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স মোঃ ছগির মিয়া। এর বাইরে করোনা সন্দেহে বা উপসর্গ দেখা দিয়েছে এমন কর্মকর্তা কর্মচারীকে সারাদেশের ৮ স্থানে তৈরি করা আইসোলেশন সেন্টারে রোগীদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। বর্তমানে বন্দী, কারারক্ষী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ মোট ১৯০ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জের মোট ২৮ জন কর্মচারী ও তাদের সন্তান, ৮ জন বন্দী, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি প্রিজন্সের ৩ জন বন্দী, কিশোরগঞ্জ জেলা কারাগারের ১ জন বন্দী, মাদারীপুর জেলা কারাগারের ২ জন কারারক্ষী ও ৩ জন বন্দী, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ১৯ জন কারারক্ষী ও ২৮ জন পুরুষ ও ১ জন নারী বন্দী, কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১৫ জন কারারক্ষী, পঞ্চগড় জেলা কারাগারে ২৩ জন বন্দী বর্তমানে করোনার কারণে আইসোলেশনে রয়েছেন। এছাড়া বগুড়া জেলা কারাগারে ৮ জন কারারক্ষী, পাবনা জেলা কারাগারে ৬ জন কারারক্ষী ও ৪ জন বন্দী। খুলনা জেলা কারাগারের ৪ জন কারারক্ষী ও ৩৭ জন বন্দী আইসোলেশনে রয়েছেন। তবে তাদের গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে কারা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মন্জুর হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ১ জুন পর্যন্ত দেশের ৬৮ কারাগারে কারারক্ষী, স্টাফ ও একজন বন্দীসহ মোট ৬৮ জন কারা কর্মকর্তা কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া বন্দী, কারারক্ষী, স্টাফ এবং কারারক্ষীর পরিবারসহ মোট ১৯০ জনকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। যাদের পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমরা করোনায় আক্রান্তদের জরুরী চিকিৎসার জন্য দেশের আটটি বিভাগে আট জন ডিআইজ প্রিন্সের নেতৃত্বে ৮টি টিম গঠন করে ৮টি আইসোলেশন সেন্টারও স্থাপন করা হয়েছে।
×