ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হাজী কামাল কারাগারে ॥ আদম ব্যবসায় জড়িত ঢাকার কিছু ট্রাভেল এজেন্ট

৪৭০ জনের মানব পাচার সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ৩ জুন ২০২০

৪৭০ জনের মানব পাচার সিন্ডিকেট

শংকর কুমার দে ॥ লিবিয়ায় পাচার হওয়া ২৬ বাংলাদেশীর নির্মম ও নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনায় কেঁচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে আসছে। মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা কামাল হোসেন ওরফে হাজী কামালকে রিমান্ডের আবেদন না জানিয়ে আদালতে পাঠানোর পর তার জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারাদেশে মানব পাচার সিন্ডিকেটে জড়িত ৪৭০ পাচারকারী ও দালাল চক্রের সদস্য। শুধু ঢাকা বিভাগের ৯টি জেলায়ই রয়েছে তালিকাভুক্ত ৯৪ মানব পাচারকারী। কেবল সিআইডির হাতেই তদন্তাধীন আছে ৩ শতাধিক মানব পাচারের মামলা। সারাদেশে মানব পাচারকারী ও দালাল চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, বনানীসহ বিভিন্নস্থানে রয়েছে এক ডজন ট্রাভেল এজেন্ট নামক আদম ব্যবসায়ী যারা মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। চাঞ্চল্যকর কোন পাচারের ঘটনা ঘটলে কয়েকদিন হৈচৈ করে কিছু চুনো পুটি ধরা পড়ে। কিন্তু রুই কাতলা শ্রেণীর শক্তিশালী মানব পাচারকারী ও দালাল চক্রের সদস্যরা রয়ে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তদন্তের সঙ্গে সিআইডি, র‌্যাব ও পুলিশ সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশী নিহতের ঘটনায় মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা কামাল হোসেন ওরফে হাজী কামালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন জানায়নি তদন্ত কর্তৃপক্ষ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন না জানিয়ে তাকে আদালতে পাঠানোর পর কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছে আদালত। মঙ্গলবার হাজী কামালকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে ভাটারা থানা পুলিশ। এ সময় তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইনে করা মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওই থানার উপ-পরিদর্শক নুরুল ইসলাম। অপরদিকে কামালের পক্ষে তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম আবু সুফিয়াল নোমান তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে হাজী কামালকে। ঢাকা মহানগরীর ভাটারা থানার পুলিশ জানায়, সোমবার রাতে র‌্যাব বাদী হয়ে ভাটারা থানায় পাসপোর্ট আইনের ১১(৩) ধারায় মামলাটি করে। ভাটারা থানার পরিদর্শক (ভারপ্রাপ্ত) মুক্তার উজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, গ্রেফতারের সময় কামালের কাছে অবৈধ ৩১টি পাসপোর্ট পাওয়া গেছে। তাই র‌্যাব বাদী হয়ে পাসপোর্ট আইনে মামলা করে। অবৈধভাবে ইউরোপে প্রেরণকালে লিবিয়ার মিজদাহ শহরে গত ২৮ মে নৃশংস হত্যাকা-ে ২৬ বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। এছাড়া ১১ বাংলাদেশী মারাত্মকভাবে আহত হন। ওই ঘটনা দেশ বিদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে র‌্যাব-৩ ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। তদন্তে উঠে আসে এই হাজী কামালের নাম। এরপর সোমবার ভোরে র‌্যাব-৩ এর একটি দল গুলশান থানাধীন শাহজাদপুরের বরইতলা বাজার খিলবাড়ীরটেক এলাকা থেকে হাজী কামালকে (৫৫) গ্রেফতার করে। তিনি কুষ্টিয়া জেলা সদরের জামাত আলী ম-লের ছেলে। শুধু লিবিয়া নয়, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও অবৈধ প্রক্রিয়ায় শ্রমিক পাঠিয়েছেন ৪০০ জন। এর মধ্যে লিবিয়ায় নিহত হওয়া ২৬ বাংলাদেশীও আছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনায় মানব পাচারকারী ও দালাল চক্রের অন্যতম হোতা কামাল হোসেন ওরফে হাজী কামালকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে মানব পাচার ও দালাল চক্রের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাবে বলে লিবিয়ায় নিহত হওয়া ২৬ বাংলাদেশীর স্বজনদের দাবি। তবে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে তাতে বলা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদে রাজধানী ঢাকার মানব পাচারকারী বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্ট নামধারী আদম ব্যবসায়ী রয়েছে যারা মানব পাচার ও দালাল চক্রের সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে দিচ্ছে। সরকারের একটি দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি মানব পাচার সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরে পাঠিয়েছে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখিত মানব পাচারকারীদের তালিকা ও তথ্য পর্যালোচনা করে চমকপ্রদ সব তথ্য পাওয়া গেছে। এ সিন্ডিকেটটিতে জনপ্রতিনিধি ছাড়াও রয়েছেন একাধিক নারী। কিছু প্রতিষ্ঠানও এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত। পাচারে জড়িত বাহকরা ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালদের টিকি এখনও স্পর্শ করা যাচ্ছে না। এমন তথ্যের ইঙ্গিত করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, সিআইডির কাছে মানব পাচারের ৩০০ মামলা তদন্তাধীন। মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে এ অপরাধে মৃত্যুদ- থেকে সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদ- দেয়ার বিধান রয়েছে। মূলত বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকার লোকজন এভাবে ইউরোপে যায়। ওই এলাকার স্থানীয় দালাল ও মানবপাচার চক্রকে চিহ্নিত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তদন্ত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্র রয়েছে লিবিয়া বা অন্য দেশে তাদের বিরুদ্ধেও আন্তর্জাতিকভাবে আইনানগ ব্যাবস্থা নেয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়েছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের সমুদ্র এলাকায় নয়, বিভিন্ন সময় লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর থেকে ইতালি যাওয়ার পথেও একাধিক নৌকাডুবির ঘটনায় বহু বাংলাদেশী মারা গেছেন। এই অবৈধ কাজে সারাদেশে বিশাল এক জাল বিস্তৃত করেছে একটি মানব পাচার চক্র। এরা বাংলাদেশী নাগরিক ছাড়াও কক্সবাজারের ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে অবৈধ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। সারাবিশ্বে মানব পাচারের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় এখন শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। লিবিয়া থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে দেশে ফিরেছেন এমন অনেকে বলেছেন, ঢাকা থেকে লিবিয়া যেতে একজনকে দশ হাজার ডলারের বেশি অর্থ দিতে হয়। এরপর একটি চক্র ঢাকা থেকে তাদের দুবাই নেয়। সেখান থেকে লিবিয়া। লিবিয়ায় রীতিমতো প্রশিক্ষণ চলে কিভাবে সাগরপড়ি দিতে হবে। যাওয়ার আগে আবার টাকা দিতে হয়। এই টাকা আদায়ে জিম্মি করা বা নিপীড়নের ঘটনা ঘটে এখন প্রায় নিয়মিত।
×