ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনেক দেশ দিনে এক লাখ পরীক্ষা করলেও এ দেশে ১০ হাজারের নিচে

টেস্টের সীমাবদ্ধতা- করোনা নিয়ন্ত্রণে বড় চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ৩ জুন ২০২০

টেস্টের সীমাবদ্ধতা- করোনা নিয়ন্ত্রণে বড় চ্যালেঞ্জ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ টেস্টের সীমাবদ্ধতা কাটছেই না। প্রাণঘাতী করোনার ছোবল থেকে মানুষের জীবন রক্ষায় বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার ‘টেস্ট টেস্ট টেস্ট’ নীতিকে গ্রহণ করে উন্নত অনুন্নত বহু দেশ সাফল্য পেলেও সফলতা দেখাতে পারছে না দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। টেস্টের সংখ্যা কোন কোন দেশে কোটি ছাড়িয়ে গেলেও বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে। আবার ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়লেও সেভাবে বাড়ছে না টেস্টের সংখ্যা। বহু দেশই প্রতি ২৪ ঘণ্টায় টেস্ট করছে এক লাখেরও বেশি। অথচ দেশে অধিকাংশ দিনই টেস্ট হচ্ছে ১০ হাজারের নিচে। মোট সংখ্যার বিবেচনায় তো বটেই, প্রতি ১০ লাখ লোকের মধ্যে টেস্টের সংখ্যা বিবেচনাতেও বহু অনুন্নত দেশের থেকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। সময় পেলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে আগে থেকে যথেষ্ট ‘টেস্টকিট’ সংগ্রহসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না থাকা এবং নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে কাজের প্রতিটি স্তরে দক্ষ জনবলের অভাবে টেস্টের মান ও সংখ্যা আশানুরূপ পর্যায়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। করোনা শনাক্তের তিন মাসের মাথায় এসেও টেস্টের এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘করোনা টেস্টই বড় চ্যালেঞ্জ অথচ কোভিড আক্রান্তদের চিহ্নিত করে জীবন রক্ষায় টেস্টের কোন বিকল্প নেই। সীমিত টেস্টে যেমন দেশের আসল চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না, তেমনি আক্রান্তরা তার অবস্থা জানতে না পারায় জনসমক্ষে ঘুরে বেড়িয়ে আক্রান্ত করছেন অন্যকে। তাই দুর্বলতাগুলো দূর করে টেস্ট বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। সময় অনেক চলে গেছে। সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। এখন যে কোন পদক্ষেপে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা পরিহার করতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব টেস্ট বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ নমুনা সংগ্রহের জন্য দক্ষ, প্রশিক্ষিত মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। ল্যাবের সীমাবদ্ধতা, টেস্ট বৃদ্ধির অন্তরায় ॥ গত ৮ মার্চ দেশে যখন প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় তখন থেকেই নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সার্বিক বিষয় তত্ত্বাবধান করে আসছিল জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তবে দুই সপ্তাহ ধরে এই দায়িত্বটি পালন করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। করোনা শনাক্তের পর থেকেই দেশে টেস্টের সংখ্যা কম নিয়ে সমালোচনায় পড়তে হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ পুরো স্বাস্থ্য প্রশাসনকে। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেন, ‘চলতি মাসের মধ্যেই দৈনিক টেস্টের সংখ্যা ১০ হাজারে উন্নিত করা হবে’। ঘোষণা অনুসারে প্রায় তিন মাসের মাথায় দৈনিক টেস্টের সংখ্যা ১০ হাজারে নেয়া সম্ভব হয়। এই সময়ে বেড়েছে ল্যাবের সংখ্যা। বেড়েছে নমুনা সংগ্রহের বুথের সংখ্যাও। একটি ল্যাব দিয়ে শুরু করা প্রক্রিয়ায় মঙ্গলবার পর্যন্ত যুক্ত হয়েছে ৫২টি ল্যাব। তবে এরই মধ্যে সমস্যার খবর দিচ্ছে অনেক ল্যাব। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন ল্যাবে আরটিপিসিআর মেশিন নষ্ট হওয়া, ঠিকভাবে কাজ না করা, কিট সঙ্কট, জনবল সঙ্কটসহ নানা কারণে মাঝে মাঝেই নমুনা সংগ্রহ ও টেস্টে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। কখনও কখনও টেস্টের সংখ্যা ১১ হাজার হচ্ছে আবার পরের দিন এসব সমস্যার কারণে সংখ্যা বৃদ্ধি না পেয়ে কমে যাচ্ছে। দশ হাজারেরও বেশি টেস্ট হওয়ার পরের দিন সাড়ে পাঁচ হাজার টেস্টের মতো ঘটনাও ঘটেছে। গত ৫ মে থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ল্যাবে শুরু হয়েছিল নমুনা পরীক্ষার কার্যক্রম। কিন্তু সোমবার থেকে সে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ল্যাব পরিচালনায় আর্থিক সঙ্কট, নিরাপত্তাহীনতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের দাফতরিক কাজ শুরু হওয়া, গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি একাডেমিক কাজে ব্যবহারসহ কয়েকটি কারণে এ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে দেশের এমন সঙ্কটের সময়ে ল্যাবের কার্যক্রম বন্ধ করা ঠিক হয়নি বলে মনে করছেন শিক্ষক কর্মকর্তারা। আর্থিক সঙ্কট থাকলে তা যে কোন খাত থেকে সংগ্রহ করার কথাও বলছেন শিক্ষকরা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল জনকণ্ঠকে বলছিলেন, ল্যাবের কার্যক্রম শুরুর সময় থেকে শিক্ষক সমিতির সহযোগিতা ছিল। এখন কি কারণে বন্ধ হয়ে গেল তা আমি জানি না। তবে শুনেছি আর্থিক কারণে নাকি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে বন্ধের আগেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানিয়েছেন উপাচার্য মোঃ আখতারুজ্জামান। গবেষণাগারে দুটি পিসিআর মেশিনে প্রতিদিন প্রায় চার’শ নমুনা পরীক্ষা করা হতো। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলেছেন, আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এটি বন্ধ করে দিচ্ছি। আমাদের কথা ছিল ৩১ মে পর্যন্ত আমরা এটা চালিয়ে যাব। এর মধ্যেই গত সপ্তাহেই হঠাৎ কিট সঙ্কটের কারণে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। ক্যাম্পাস সূত্রে জানা যায়, ১১ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবে করোনা পরীক্ষা শুরু হয়। ২৪ ঘণ্টায় ১৯৪টি নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে ল্যাবটিতে। অন্তত পাঁচ লাখ টেস্টিং কিট সংগ্রহ জরুরী ॥ কিট সঙ্কট নতুন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। করোনা টেস্টের জন্য কিট সঙ্কট নতুন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা। করোনা সংক্রমণের প্রথমদিকে আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে করা প্রেস বিফিংয়ে অধিদফতরের কাছে মজুদ থাকা পিপিই ও কিটের সংখ্যা জানিয়ে দেয়া হতো। তবে এখন কিটের সংখ্যা কত মজুদ আছে তা আর বলা হয় না। টেস্ট সংখ্যা বাড়ানোর পথে ভবিষ্যতে কিট সঙ্কটের কথা মাথায় রেখেই ইতোমধ্যেই স্বল্প মেয়াদে পাঁচ লাখ টেস্টিং কিট সংগ্রহ করা জরুরী বলে সরকারকে জানিয়েছে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শ কমিটি। কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, নোভেল করোনাভাইরাস শনাক্তে টেস্ট আরও বাড়ানো দরকার। যে জায়গাগুলোতে এখন পরীক্ষা করা হচ্ছে সেখানে টেস্টের পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে এবং টেস্টের জন্য স্থানও বাড়াতে হবে। যাতে আক্রান্তরা দ্রুত শনাক্ত হন। বর্তমানে শুধু করোনার উপসর্গ নিয়ে আসাদেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কমিউনিটিতে যেসব মানুষের উপসর্গ আছে, কিন্তু রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে আসছেন না, তাদের খুঁজে বের করে টেস্টর আওতায় আনতে হবে। টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশে বলা হয়, রেফারেন্স ল্যাবরেটরিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নমুনা পাঠিয়ে প্রতিটি ল্যাবরেটরির কোয়ালিটি এ্যাসুরেন্স করা জরুরী। স্যাম্পল কালেকশন, ট্রান্সপোর্টেশন স্টোরেজ যথাযথ হওয়ার জন্য জনবলকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ল্যাবরেটরি যাতে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। টেস্টের কেন্দ্র সংখ্যা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনে উন্নয়ন সহযোগীদের সাহায্য নিতে হবে। কমিটি আরও বলেছে, ‘কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিয়োজিত হাসপাতালগুলোয় অতিপ্রয়োজনীয় টেস্টের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয় (যেমন সিবিসি, ক্রিয়েটেনিন, সিআরপি, চেস্ট এক্সরে, ইসিজি) এবং এসব পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এ হাসপাতালগুলোর ল্যাবরেটরিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ভাইরোলজিস্ট পদায়নের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে।’ টেস্টে যোজন যোজন দূরে বাংলাদেশ ॥ বিশেষজ্ঞদের এ উদ্বেগের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে করোনাভাইরাসের টেস্টের হার বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। আবার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ে পরিসংখ্যান তুলে ধরা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দেয়া তথ্য মিলিয়ে এ চিত্রই পাওয়া গেছে। ‘টেস্ট বাড়ান’-আহ্বান দেশের উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ॥ করোনা শনাক্তের তিন মাসের মাথায় দেশে টেস্টের এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডাঃ ইকবাল আর্সলান বলছিলেন, হ্যাঁ, কোভিড আক্রান্তদের চিহ্নিত করে জীবনরক্ষায় টেস্টের কোন বিকল্প নেই। যতবেশি টেস্ট তত বেশি রোগীকে আমরা চিহ্নিত করতে পারব। এটা করতে পারলে সে রোগীতে যেমন আলাদা করা যায় তেমনি সেও অন্যদের থেকে আলাদা হতে পারে। টেস্টের কোন বিকল্প নেই। টেস্ট আমাদের কম। বেশি দরকার ছিল। তবে প্রক্রিয়াটা অটোমেশন দরকার। আমরা বলেছি এন্যালগ না করে অটোমেশন করতে হবে। তাহলে আরও দ্রুত ইতিবাচক ফল আমরা পাব। টেস্ট কিট সংগ্রহ নিয়ে কমিটির সুপারিশ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা সুপারিশ করেছি। কিন্তু বাস্তবায়ন তো মন্ত্রণালয় করবে। এখনও জানি না কতদূর কি করেছে।
×