ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

করোনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানবতার আরেক শত্রু

প্রকাশিত: ২০:৪৪, ৩ জুন ২০২০

করোনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানবতার আরেক শত্রু

যে দেশে একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট দুদফায় হোয়াইট হাউসে বাস করেছেন, যে দেশের সাদা কালো ভোটদাতারা সংখ্যালঘু কালো মানুষদের একজনকে ভোট দিয়ে দু’দুবার প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়েছেন, সে দেশে এখনও সাদা পুলিশ শ্বাসরোধ করে কালো মানুষকে হত্যা করে, এ কথা কি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়? কালো এবং অর্ধ মুসলিম বারাক ওবামা যেদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন, সেদিন নিইউয়র্কে টাইমস পত্রিকায় এক মার্কিন কলামিস্ট লিখেছিলেন, ‘রেসিস্ট কান্ট্রি হিসেবে যে দেশটির সর্বাধিক দুর্নাম ছিল, সেই আমেরিকায় একজন কালো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, এটা পৃথিবীতে বর্ণবাদের অবসানের শুভ লক্ষণ।’ আরেক সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘মানবতার সবচাইতে বড় শত্রু ফ্যাসিবাদ এবং বর্ণবাদ। ওবামার নির্বাচনে মনে হচ্ছে মানবতার এই দুই শত্রু পরাজিত হতে চলেছে।’ এই দুই আশাবাদী মার্কিন কলামিস্ট এখন ট্রাম্পের আমেরিকাকে দেখে কী ভাবছেন জানি না। দেশটিতে আবার বর্ণবাদ ফিরে এসেছে। নব্য ফ্যাসিবাদ তো ফিরে এসেছিল বুশ প্রেসিডেন্সির আমলেই। ১৯৩৯ সালে তুচ্ছ অজুহাতে হিটলারের পোলান্ড আক্রমণের সঙ্গে পরবর্তীকালে আমেরিকার বুশ ও ব্রিটেনের টনি ব্লেয়ারের মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণের তুলনা করা চলে। মার্কিন ঔপন্যাসিক স্টেইনবেকের ‘ট্রাবল ইন জুলাই’ উপন্যাসে আমেরিকায় কালো মানুষের ওপর সাদা মানুষের নিত্যনিয়ত বর্বর অত্যাচারের বিবরণ আছে। হিটলারের জার্মানীতে ইহুদীদের ওপর অত্যাচারের চাইতে তা কম নয়। শুধু অত্যাচার নয়, কালোদের নাগরিক অধিকার নানাভাবে খর্ব করা হয়েছে। তাদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হয়েছে। দীর্ঘকাল আন্দোলন ও কঠোর সংগ্রামের পর কালো শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের নানা অধিকার লাভে সক্ষম হয়। ওবামার প্রেসিডেন্সির আমলে মনে হয়েছিল আমেরিকা বর্ণবাদের অভিশাপমুক্ত হতে চলেছে। আর আমেরিকা যদি বর্ণবাদমুক্ত হয়, তাহলে গোটা বিশ্ব বর্ণবাদমুক্ত হওয়ার পথে এগুবে। বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা ফ্যাসিবাদেরই একটি অংশ। গত শতকের ইউরোপেÑ বিশেষ করে জার্মানীতে ফ্যাসিবাদ জন্ম নিয়েছিল বর্ণবাদকে ভিত্তি করে। হিটলারের ইহুদী-বিদ্বেষকে ভিত্তি করে জার্মান ফ্যাসিবাদের জন্ম। বর্তমান আমেরিকায় যে নব্য ফ্যাসিবাদ আরও ভয়াবহভাবে দেখা দিয়েছে, তার উৎস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কারের নীতি। ইমিগ্রেসন ও মুসলিমবিদ্বেষ সারাদেশে ছড়িয়ে, এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ, অর্ধশিক্ষিত সাদা মার্কিন ভোটারদের অসাধু প্রোপাগা-া দ্বারা উত্তেজিত করে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়েছেন এবং তার চন্ড নীতি অনুসরণ করছেন। করোনাভাইরাসের মতো ট্রাম্প প্রেসিডেন্সিও বিশ্ব মানবতার জন্য এক অভিশাপ। ওবামা প্রেসিডেন্সির আমলে হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট মার্কিন এডমিনিস্ট্রেশনে মানবতার যেটুকু সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল, ওবামার স্বাস্থ্য ও অন্যান্য ওয়েলফেয়ার প্রোজেক্ট আমেরিকায় সাধারণ মানুষকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার যেটুকু সুযোগ দিয়েছিল, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে বসে সেসব প্রোজেক্ট বাতিল করেছেন। তার আন্তর্জাতিক নীতি বিশ্বে প্রবলভাবে যুদ্ধ-উত্তেজনা ছড়িয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চলছে কোভিড-১৯ ভাইরাসের অত্যাচার। এই ভাইরাসের কবল থেকে রক্ষার জন্য তৈরি হয়েছে বিশ্ব ঐক্যজোট। ট্রাম্প তাতে যোগ দেননি। তার ভ্রান্তনীতিতে আমেরিকায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। তিনি তাতেও বেপরোয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি তিনি মানেন না। বরং তুচ্ছ অজুহাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যপদ থেকে আমেরিকাকে সরিয়ে এনেছেন। করোনাভাইরাসকে প্রতিহত করার জন্য গোটা বিশ্বের সম্মিলিত উদ্যোগে যোগ না দিয়ে এই ভয়ঙ্কর ভাইরাস বিশ্বে দেখা দেয়ার জন্য চীনের ওপর একতরফা দোষারোপ করছেন। চীনের ওপর হামলা চালানোর পরোক্ষ হুমকি দেয়া হচ্ছে। করোনার ভয়াবহ সংক্রমণে সারা বিশ্বে যখন চলছে লকডাউন, একটি ভয়ানক অর্থনৈতিক মন্দার আবির্ভাবের আশঙ্কায় বিশ্বের মানুষ কম্পিত, তখন আমেরিকার ট্রাম্প সাহেব রণবাদ্য বাজাচ্ছেন। তার সরকারের অনুসৃত বর্ণবিদ্বেষী নীতি ও করোনা সম্পর্কিত নীতিতে সারা আমেরিকা এখন করোনাভাইরাসের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় জ্বলছে। একজন কালো মানুষকে হত্যার জন্য ক্ষুব্ধ আমেরিকার সাদা-কালো মানুষ যখন প্রতিবাদ জানাচ্ছে, ট্রাম্প তখন তাদের টেররিস্ট আখ্যা দিয়ে আগুনে ঘি ঢালছেন। আফগানিস্তানের বাচ্চা-ই-সাক্কোর রেকর্ডও ট্রাম্প ভাঙতে চলেছেন। আমেরিকার মিনোসোটা রাজ্যের মিনিয়াপোলিসের ঘটনাটি দুঃখজনক। জর্জ ফ্লয়েড নামের এক কালো ব্যক্তিকে সাদা পুলিশ জাল ডলার রাখার অপরাধে আটক করে। পুলিশের এক কর্মকর্তা ফ্লয়েডের ঘাড়ের ওপর হাঁটু দিয়ে তাকে চেপে ধরে। ফ্লয়েড চিৎকার করে বলে, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।’ এই অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ে প্রথমে মিনিয়াপোলিসে বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং তা সারা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। সারা আমেরিকা আগুনে জ্বলছে। এমনকি রাজধানী ওয়াশিংটনও। এই সময় হোয়াইট হাউস অস্থায়ীভাবে লকডাউন করে দেয়া হয়। আমেরিকায় এই গণবিক্ষোভে ১৬টি রাজ্যের ২৫টি শহরে কার্ফু জারি করতে হয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশদের বিরুদ্ধে অবশ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে চারজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। হত্যাকারী হিসেবে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শেভিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিক্ষোভ তাতে প্রশমিত হয়নি। কালো আমেরিকানদের দাবি, প্রশাসনিক ও সামাজিক বর্ণবাদের অবসান। একজন-দুজন মানুষকে লোক দেখানো শাস্তি দিয়ে আপাতত গণবিক্ষোভ প্রশমন করা যেতে পারে, কিন্তু তার অঙ্কুর থেকে যাবে। আবার একটি-দুটি ঘটনায় তা বিস্ফোরিত হবে। আমেরিকায় সেটাই এখন হয়ে আসছে। গণবিক্ষোভের আগুনে যখন সারা আমেরিকা জ্বলছে, ট্রাম্প তা প্রশমনের জন্য কার্যকর শান্তিবাদী ভূমিকা গ্রহণের বদলে সেই আগুন আরও উস্কে দেয়ার জন্য বিক্ষোভকারীদের আখ্যা দিচ্ছেন টেররিস্ট। তাতেও তিনি হয়তো এখন পার পেয়ে যাবেন। বিক্ষোভ আপাতত প্রশমিত হতে পারে। কিন্তু ট্রাম্পের নীতি আমেরিকাকে বাঁচাবে না। গত শতকে হিটলারও ভেবেছিলেন, তার ইহুদী-বিদ্বেষ নীতি জার্মানীকে সারা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ দেবে। তার নীতি সাময়িকভাবে সফলও হয়েছিল। তিনি সারা ইউরোপ দখল করেছিলেন। ইহুদীদের হত্যা ও দেশ ছাড়া করেছিলেন। তার ঝটিকা বাহিনী ইংলিশ চ্যানেলের ওপারে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেই বলদর্পী হিটলার আজ কোথায়? হিটলারের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত সারা জার্মান জাতিকে ৪০ বছর ধরে করতে হয়েছে। একটাই ভরসা। আমেরিকা এখনও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। হিটলারের জার্মানির মতো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র নয়। আমেরিকার গণতন্ত্রে চেক এ্যান্ড ব্যালান্স আছে। এজন্য ট্রাম্প এখনও একজন স্বৈরাচারীর মতো ভয়ানক চেহারায় আত্মপ্রকাশ করতে পারছেন না। আগামী নবেম্বর মাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাতে যদি একজন সুস্থ বুদ্ধির মানুষ বিশ্বের সর্বশক্তিধর রাষ্ট্রটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার নিওকন্ বা নিও-ফ্যাসিস্ট সহকর্মীরা নির্বাচনে পরাজিত হন, তাহলে আমেরিকার বাঁচোয়া এবং বিশ্ব মানবতারও বাঁচোয়া। একদিকে করোনা, অন্যদিকে বর্ণবাদ বা বর্ণবিদ্বেষ। এই বিদ্বেষের শিকার হচ্ছে আমেরিকায় মুসলমানরাও। এজন্য বিশ্বে করোনাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্ব শান্তি আন্দোলনও জোরদার করা প্রয়োজন। পৃথিবীর শান্তিবাদী দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মপন্থা নির্ধারণ করা উচিত। গত শতকের মধ্যভাগে শক্তিশালী বিশ্ব শান্তি আন্দোলন গড়ে ওঠা এবং বার্ট্রার্ন্ড রাসেলের মতো মনীষীদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণে একটি প্রলয়ঙ্কর আণবিক যুদ্ধ থেকে পৃথিবী বেঁচে গিয়েছে। বর্তমান বিশ্ব গত শতকের চাইতেও বড় বিপদের সম্মুখীন, করোনার অভিশাপ থেকে পৃথিবী কবে মুক্ত হবে, আদৌ মুক্ত হতে পারবে কিনা, তা এখনও মানুষের জানা নেই। গোটা মানব সভ্যতার জন্য আজ অভূতপূর্ব এক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এই সময় বর্ণবাদ ও বর্ণবিদ্বেষের প্রশ্রয় দান, জাতি বিদ্বেষ প্রচার এবং বিশ্ব শান্তির জন্য যারা নতুন হুমকি তৈরি করেন, তাদেরও প্রতিহত করা বিশ্বের প্রতিটি সভ্য মানুষ, শান্তিকামী মানুষের কর্তব্য। এটা নতুন পৃথিবী গড়ার যুদ্ধ, তা ধ্বংস করার নয়। [লন্ডন, ২ জুন, মঙ্গলবার, ২০২০]
×