ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরী

লকডাউন শিথিল করতেই হতো

প্রকাশিত: ২১:০৭, ২ জুন ২০২০

লকডাউন শিথিল করতেই হতো

করোনা নিয়ে নানাজনের নানা মত বিরাজ করছে। কেউ বলছেন আগে জীবন তারপর জীবিকা। এই অবস্থান থেকেই কঠোর আইসোলেশন ও লকডাউনের সূচনা। কঠোর লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধি পালন করে এবং আত্ম-সংযমের মাধ্যমে কেউ কেউ সুফলও পেয়েছে। বাস্তবতার কষাঘাতে কেউ বলছেন যে, জীবন ও জীবিকা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ধীরে ধীরে লকডাউন শিথিল হচ্ছে। করতেই হতো। আমাদের সংস্কৃতিও তা সমর্থন করছে। আমাদের দেশে কেউ কেউ বলছেন যে, বাঙালীরা স্বর্গবাসী হলেও মাঝে মাঝেই নরকে কি ঘটছে তা দেখতে যাবে। অন্ধ ধর্ম বিশ^াস লকডাউন না মানার অন্যতম কারণ। এখন অনেকেই করোনাকে সক্ষমতা দিয়ে সামলানো এবং করোনাকে প্রতিবেশী হিসেবে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে পরামর্শ দিচ্ছে। বেশ ক’দিন আগে আমিও সেকথা বলেছি। এক টেলিভিশন টকশোতে আমি বলেছিলাম যে, আইসোলেশনের ব্যাপারে আমাদের সতীত্ব যখন বিনষ্ট হয়েই গেছে তখন তাকে আর পুনরুদ্ধারের প্রয়াস বৃথা। বরং মিশ্র অর্থনীতির দেশে এখন করোনার ব্যাপারেও মিশ্র নীতি অনুসরণই বাঞ্ছনীয়। সংক্রমণের হার, মৃত্যুর হার ও বিদ্যমান সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে এবং প্রয়োজনের তাড়নায় আমাদের লকডাউন শিথিল করতেই হতো। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইতালীসহ বেশ কিছু দেশ অশেষ ক্ষয় স্বীকার করেও এ পথ ধরেছে। ট্রাম্প নির্বাচনে হারার শঙ্কা নিয়ে শিথিল লকডাউন মেনে নিয়েছেন। তার ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রয়োজনেও আইসোলেশনে যাচ্ছেন না। আমাদেরকে অবশ্য অত শিথিলতা টানতে অন্তত করোনার প্রতিষেধক বা প্রতিরোধক প্রাপ্তি বিবেচনায় নিতে হবে। আমার ধারণা শীঘ্রই বাজারে ফলদায়ক ইনজেকশন, টিকা বা ট্যাবলেট চলে আসবে। বাংলাদেশের রেমডিসির উৎপাদন হচ্ছে এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন সাপেক্ষে সুলভে এই ইনজেকশন বাজারে এসেছে। আরও কিছু ওষুধ বা ইনজেকশন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থায় দেশের মানুষের বহির্মুখী প্রবণতা, ধর্মচেতনা ও জীবিকার বহুমুখী সঙ্কটের কথা মাথায় নিয়ে আমাদের লকডাউন শিথিল করতেই হতো। আমরা যে স্থানে এসে পৌঁছেছি সেখান থেকে উৎপত্তিস্থলে ফিরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। যা হয়ে গেছে তাকে ভিত্তি ধরেই এগোতে হবে। যেমন এগোচ্ছে মন্ত্রণালয়, বিচার বিভাগ, রেস্তোরাঁ, দোকানপাট, শপিং মল। শিক্ষাঙ্গনও খুলে দিতে হবে। বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে সঙ্গত অসঙ্গত সমালোচনা হচ্ছে। ইউজিসি প্রণীত ও জারিকৃত নির্দেশিকার অন্তত কিছু ধারা বাস্তবায়িত হলে ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে সিজর ক্রাইসিস বা কাঁচি সঙ্কটের মতো কিছু জন্ম হতে পারে। কারণ, ইউজিসির সাধারণ নির্দেশনার তিন ও চার ধারা বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। প্রথমটিতে বলা হয়েছে শিক্ষক, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা অব্যাহত রেখে এবং কাউকেও ছাঁটাই না করে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হবে। পরের ধারাটিতে বলা আছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি’য়ের জন্য কোন চাপ দেয়া যাবে না এবং তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির পথ অবধারিত রাখতে হবে। অন্য ধারাগুলো আলোচনা না করেও বলা যায়, এই দুটো ধারার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় কাঁচি সংকট অবধারিত হবে, যদি না ইউজিসি বা সরকার স্বল্প মেয়াদের জন্য হলেও বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়গুলোর অর্থায়নে এগিয়ে আসে। তারপরও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বাস্তব ও কল্পিত সীমাবদ্ধতার কথা আসবে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার পর শিক্ষায় হিউম্যান টাচ বা মানবিক স্পর্শের কথা এসেছে। মূল্যায়নের স্বচ্ছতার-অস্বচ্ছতার কথা এসেছে। এর মাঝে অজ্ঞতা, পশ্চাদপদ মানসিকতা ও অপতৎপরতার কথাও এসে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে কেউ কেউ অন্তত শিক্ষা কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার কথা বলছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ টানছেন কেউ কেউ। প্রধানমন্ত্রী স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষাঙ্গন সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লকডাউনের কথা বললেও তিনি অবশ্য বিশ^বিদ্যালয়ের কথা স্পষ্ট করে বলেননি। তারপর বিভিন্ন ধারার পানি বিভিন্ন দিকে গড়াচ্ছে। কতিপয় সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে, যেগুলো সামলানো কোভিড সামলানোর চেয়ে কম গুরুত্বের নয়। ভা-ারের স্ফীতি না বাড়াল ক্রমশ রাজভা-ারও ফুরিয়ে যায়। আমাদের অনেক কিছু ক্ষয়িঞ্চু হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন পর খাদ্য সঙ্কট ছাড়া অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। বাগানে আম ও লিচু পচে যাবে। রফতানি বাজার হাত ছাড়া হলে আগের মতোই ধার করতে হতে পারে বিদেশ থেকে। বেকারত্ব অসহনীয় হয়ে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি এমনকি জঙ্গীবাদ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে। এসব অবস্থা সামলাতে ও করোনাকে সহনীয় করতে হলে লকডাউনে শিথিলতা আনতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে তার সূচনা পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশসহ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাও গ্রহণ করা যাবে। তবে স্বাস্থ্যবিধির প্রতি গতানুগতিক অনীহা শিথিল না করলে লকডাউনে শিথিলতা আগামীতে কাল হয়ে দেখা দিতে পারে। লেখক : শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এর উপাচার্য
×