ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ২১:০৭, ২ জুন ২০২০

ঢাকার দিনরাত

ঢাকার রাস্তাঘাট অফিস আদালতে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এলো, কিন্তু মানুষের শঙ্কা আর ঝুঁকি কি একবিন্দু পরিমাণও কমল? রোববার থেকে অফিস আদালত খুলে যাওয়ার পর ঢাকা করোনাপূর্ব ব্যস্ত নগরীর চেনা চেহারায় ফিরবে এমনটি জানা কথাই। অর্থনীতির সঙ্গে মানুষের প্রতিদিনের মৌলিক মানবিক প্রয়োজন সরাসরি যুক্ত। ব্যয় আছে, আয় নেই। এ অবস্থা কতদিন চলতে পারে? তাই ৬৬ দিনের ছুটিশেষে আবার নিয়মিত অফিস শুরু। তবে আমরা গণমাধ্যমের কর্মীরাসহ জরুরী সেবার আওতাধীন হাজার হাজার মানুষের কোন ছুটি ছিল না। আমরা কাজেই ছিলাম। সে যাক, ঢাকা চেনা চেহারায় ফিরছে বটে কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষের ভোগান্তি কি কমবে? বাসে উঠলে বাড়তি সতর্কতা যারা কর্মস্থলে যোগ দেয়ার জন্য বাসে চড়তে বাধ্য তাদের ওপর ব্যয়ের নতুন বোঝা চেপেছে। বাসভাড়া বেড়েছে। এই বাড়তি টাকার যোগানো স্বল্পবিত্তের মানুষের জন্যে অনেক কষ্টের। ঢাকার লাখ লাখ মানুষ এই দলেই। একদিকে বাড়তি ব্যয়, আরেকদিকে উচ্চ ঝুঁকি। গণপরিবহনের যাত্রীরা পড়েছেন উভয় সঙ্কটে। করোনা সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকির তালিকা করতে গেলে প্রথমদিকেই আসবে গণপরিবহনের বিষয়টি। এখন দেশে প্রতিদিনই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে এমনটাই অনুমিত হওয়া স্বাভাবিক যে ভাইরাস সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্বে প্রবেশ করছে দেশ। এই সময়পর্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং নিজের সুরক্ষা বজায়ে করণীয় কড়াকড়িভাবে পালনের আবশ্যকতা রয়েছে। এখানে বিন্দুমাত্র শিথিলতা বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। গণপরিবহন বাস- মিনিবাসে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ অর্ধেক যাত্রী বহন করা হবে স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার স্বার্থে। তার মানে হলো একজন যাত্রীকে অপর যাত্রীর গা ঘেঁষাঘেষি করে বসতে হবে না। দুই আসনের স্থলে একজন এবং তিন আসনের জায়গায় দুজনকে বসানো হলে পাশাপাশি হয়তো তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু ঠিক পেছনের সিটে যে যাত্রী বসবেন তার কি এই অত্যাবশ্যকীয় দূরত্ব বজায় থাকছে? বিষয়টি পরিষ্কার নয়। এতে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। তার ওপর মাস্ক পরিধানও বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। কোন যাত্রী যদি তা পরিধান না করেন তাহলে তাকে কি গণপরিবহনে উঠতে বাধা দেয়া হবে? সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি সম্ভব কিনা। বাসের হ্যান্ডেল, রড এবং সিটের উর্ধভাগ হাতের স্পর্শ লাগবেই। তাই সার্বক্ষণিকভাবেই হাত জীবাণুমুক্ত করার তাগিদ থাকবে। করুণ অসহায়ত্ব আমাদের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই সত্তরোর্ধ মুরুব্বি রয়েছেন। বাড়ির বৃদ্ধ বাবা কিংবা মা যদি করোনাক্রান্ত হয়ে পড়েন, এবং তার বিশেষ চিকিৎসা জরুরী হয়ে ওঠে তাহলে রোগীর স্বজনেরা কতোটা অসহায় পরিস্থিতির শিকার হন তারই একটি বিবরণ পাওয়া যাবে নিচের লেখা থেকে। দুই ভাই-ই কবি, একজন বারডেম হাসপাতালের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, অপরজন একটি প্রধান দৈনিকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। সমাজে উভয়েরই রয়েছে নানামুখী সংযোগ। তাদের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন আকস্মিকভাবে। শেষ পর্যন্ত কয়েকদিন ভুগে মা মারা যান। বড় ভাইয়ের এ লেখা পড়ে আমরা বুঝতে পারি আমাদের এই মহানগরীর হাসপাতালের বাস্তব চিত্র। কবি ফরিদ কবির লিখেছেনÑ ‘শুক্রবার (ঈদের আগে) বিকেলে হঠাৎ করেই আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন! তিনি ছিলেন কেরানীগঞ্জে আমার নানা- বাড়িতে। সেখান থেকে আমার আত্মীয়রা জানালেন, সারাদিন কয়েকবার লুজ মোশন হওয়ায় তিনি আর একেবারেই নড়তে পারছেন না। শরীরে একটু জ্বরও আছে! কেরানীগঞ্জে আম্মা যেখানে ছিলেন, সেখানে কারোরই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি এখনও। আমারও ধারণা, একেবারেই সাধারণ ডায়ারিয়া! সঙ্গে হালকা জ্বর। যদিও এ দুটোই করোনার লক্ষণ। এমন লক্ষণ থাকলে বারডেমে রোগী ভর্তি করা যাবে না, এটা জানাই ছিল। খবর পেয়েই আমি আর সাজ্জাদ অন্যান্য হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খোঁজ নিলাম। কিন্তু কোথাও কোন ব্যবস্থা করা যাচ্ছিল না।... আম্মাকে পরে আমরা বারডেমে নিয়ে এলাম। বারডেমে নানা পরীক্ষা শুরু হলো। সেখানে অবশ্য তার শরীরে কোন টেম্পারেচার পাওয়া গেল না। কিন্তু এক্সরেতে বুকে নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা গেল। আম্মার কিছুটা শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল। ইমার্জেন্সি ডাক্তার বললেন, রোগীর অবস্থা খারাপ। তার আইসিইউর সাপোর্ট লাগবে। আপনি রিপোর্টগুলো নিয়ে একটু আইসিইউতে যান। সেখানকার ডাক্তাররা রিপোর্টগুলো নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা বসে রইলেন। ঘণ্টাখানেক পর তারা জানালেন, রোগী সাসপেক্টেড কোভিড। কাজেই তাকে আইসিইউতে নেয়া সম্ভব না। তার শরীরে যদি করোনা থাকে তাহলে আইসিইউর বাকি রোগীদের জীবন বিপন্ন হবে। আমি সাততলা থেকে নিচে নেমে আবারও ইমার্জেন্সিতে ফিরলাম। ডাক্তার জানতে চাইলেন, আইসিইউর ডাক্তাররা কী বললেন? আমি তাদের বক্তব্য জানালে ইমার্জেন্সি ডাক্তার বললেন, রোগীর তো করোনা আছে। আমরা তাকে ভর্তি দিতে পারব না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বারডেমের যুগ্ম পরিচালক (হাসপাতাল) ডাঃ নাজিমকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, ফরিদ ভাই, আমি আইএমওর সঙ্গে কথা বলে আপনাকে একটু পরেই জানাচ্ছি। তিনি মিনিট পাঁচেক পর ফোন করে জানালেন, করোনা সাসপেক্টেড হলে তিনি হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করতে পারবেন না। তিনি বিনয়ের সঙ্গেই জানালেন, আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন, খালাম্মার যদি করোনা থাকে তাহলে অন্য রোগীরাও বিপদে পড়বেন! আমি বললাম, দেখেন, আমার ধারণা, আম্মার করোনা হয়নি। করোনা হওয়ার সম্ভাবনা তার নেই বললেই চলে। আপনি তাকে এখানেই ভর্তির একটা ব্যবস্থা করেন। নাকি আমি আজাদ স্যারকে বলব? তিনি বললেন, আমাকে একটু সময় দেন, আমি জানাচ্ছি। আমি বললাম, বেশ, তাড়াতাড়ি আমাকে জানান। মিনিট দশেক পর তিনি জানালেন, ফরিদ ভাই, একটা ব্যবস্থা করেছি। নয় তলায় ৯০১ নম্বর কেবিনে দিতে বলেছি। দেখা যাক কী হয়! ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হতে হতেই রাত ১১টা বেজে গেল। ফিরেই আমি আইসোলেশনে চলে গেলাম। মানে, গেস্টরুমে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। গোসল সেরে বেরোতেই বারডেম থেকে ফোন। ডিউটি ডাক্তার বললেন, রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে ইমেডিয়েট আইসিইউতে নেয়া দরকার। কিন্তু আইসিইউতে সিট থাকলেও ডাক্তাররা তাকে নিতে চাইছেন না। অন্য কোথাও জলদি শিফট করেন। রাত তখন প্রায় বারোটা। এত রাতে আইসিইউ কই পাব? বললাম, আজকের রাতটা থাকুক। কাল সকালে দেখি, কোথাও আইসিইউ পাওয়া যায় কি-না। ডাক্তার বললেন, দেখুন, এখানে রাখা কিন্তু খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কিছু ঘটলে তার দায় কিন্তু আমরা নিতে পারব না। আমরা রোগীর ফাইলে লিখে দিয়েছি, অবিলম্বে রোগীকে আইসিইউতে নেয়ার জন্য। সাজ্জাদকে ফোন দিয়ে বললাম, কী করব এখন? না। আমাদের আসলে করার কিছুই নেই। কোভিড হাসপাতালগুলোতে আইসিইউতে কোন সিট নেই। নন-কোভিড হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর বেড খালি থাকলেও সেখানে কোভিড সাসপেক্টেড রোগীকে কেউ ভর্তি নিচ্ছে না! সবচেয়ে বড় কথা, কোন কোভিড হাসপাতালেই আইসিইউতে কোন বেড খালি নেই। খুবই অসহায় লাগছিল। সমাজের বিভিন্ন স্তরে আমাদের দু’ভাইয়ের কানেকশন খুব একটা মন্দ না! তারপরেও আমরা অসহায়। সাধারণ মানুষেরা সেখানে এ সময়ে কতটা চিকিৎসা পাচ্ছে, সেটা অনুমান করা যায় সহজেই। শনিবার সকাল থেকে নানামুখী চেষ্টা শুরু হলো। বহু চেষ্টার পর রাত নটার দিকে আম্মাকে অবশেষে গ্রিনলাইফ হাসপাতালের আইসিইউতে শিফট করা সম্ভব হলো।’... যারা করোনা রোগী নন বৈশ্বিক মহামারীকালে সংশ্লিষ্ট রোগটিই হয়ে ওঠে সবকিছু ছাপিয়ে প্রধান ফোকাসবিন্দু। তাতে চাপা পড়ে যায় আর সব রোগের ভুক্তভোগীরা। এটা খুব যে অস্বাভাবিক, তাও নয়। এখন নতুন রোগ কোভিড-১৯ নিয়েই যত আলোচনা ও আলোকপাত। কয়েক মাস আগেও এ রোগটির অস্তিত্ব ছিল না। অল্প কিছু সংক্রামক রোগের বাইরে মূলত কয়েকটি প্রধান অসংক্রামক রোগÑ যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও রক্তচাপই ছিল চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার বিশেষ মনোযোগের কেন্দ্র। এ কয়টি রোগে ভুগে থাকেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। বিশ্বের এক নম্বর হন্তারক রোগ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে হৃদরোগকে। প্রতিবছর পৌনে দুই কোটি মানুষ মারা যাচ্ছেন এই রোগে। অন্যদিকে ম্যালেরিয়া, এইচআইভি এইডস এবং যক্ষ্মাÑ এই তিনটি রোগ মিলে প্রতিবছর গোটা বিশ্বে মারা যাচ্ছেন ৩৮ লাখ মানুষ। অথচ এ তিনটি রোগকেই ভয়ঙ্করভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে হৃদরোগের ভয়াবহতার ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা অনুপস্থিত। যাহোক, দেশে ডায়াবেটিসের রোগীর সংখ্যাও প্রায় এক কোটি। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এখন বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ রোগটিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশেও এই রোগে আক্রান্ত রোগীর বাইরেও যে লাখ লাখ রোগী রয়েছেন, যারা দীর্ঘকাল যাবত নানা অসুখে ভুগছেন, তাদের চিকিৎসা সেবা যেন গৌণ হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকেই ব্যক্তিগত চেম্বারে বসছেন না দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকেই। তারা হাসপাতালের ডিউটিতেও আসছেন না। প্রতিদিন নানা দুর্ঘটনার শিকারও হচ্ছে মানুষ। তাদের জরুরী চিকিৎসাসেবার প্রয়োজন হচ্ছে। অথচ বেশির ভাগ মানুষই তাৎক্ষণিকভাবে সেবা পাচ্ছেন না। কিডনি রোগীদের দুরবস্থা অবর্ণনীয়। লাখ লাখ সন্তানসম্ভবার স্বাস্থ্যের যত্ন কি ঠিকঠাক নেয়া সম্ভব হচ্ছে? নতুন সংক্রামক ব্যাধি এসে অন্য সব ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে বরং কিছুটা বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যেই ফেলে দিয়েছে। এজন্যে জরুরী হয়ে উঠেছে সঠিক মেডিক্যাল ব্যবস্থাপনা। ৩১ মে ২০২০ [email protected]
×